আমি বেশ চুপচাপ!! দুরবস্তার সুযোগ নিয়ে মানুষই যে মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়-জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার প্রায় শতাধিক মানুষ দালালদের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রির ঘটনা তার বাস্তব উদাহরন। তবে শুধু কিডনিতেই লালসা মেটেনি দালালচক্রের। তারা কিডনির পাশাপাশি কলিজা বেচতেও প্ররোচিত করেছে একই উপজেলার দরিদ্র এক যুবককে। দালালদের লালসার শিকার ওই যুবক এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত। তাকে বাঁচাতে হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছন স্থানীয় চিকিৎসকরা।
কালাই উপজেলায় কিডনি বিক্রির পর লিভার বিক্রির ঘটনা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় সংবাদ ফাঁস হওয়ায় ওই এলাকার মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় ও আতংক সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, কালাই উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের হতদরিদ্র মাহতাব উদ্দীনের ছেলে মেহেদী হাসান অভাবের তাড়নায় গ্রামের অন্যদের মতো দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিডনি বিক্রি করতে গিয়েছিলেন ঢাকায়। কিন্তু দালালদের ভাষ্য অনুযায়ী কিডনি ‘ম্যাচিং’ না হওয়ায় তার কিডনি বিক্রি করা হয়নি। তবে হাত ছাড়া করেননি তারা। বরং দালালরা শিকারের কাছ থেকে একটু বেশিই আদায় করে নিযেছেন কৌশলে।
।
দালালদের প্ররোচনায় কিডনির পরিবর্তে মেহেদী তার শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ(যদিও শরীরের কোন অংশই গুরুত্বহীন নয়) অংশ লিভারই বিক্রি করে দিয়েছেন।
তবে মোটা অংকের টাকার অফারে লিভার বিক্রির চুক্তি হলেও দালালরা তাকে অর্ধেক টাকা দিয়ে সটকে পড়ে। ।
মেহেদী হাসান জানান, দারিদ্র্যের কারনে বাবা-মা হারা তার ছোট দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ ও ভোরনপোষন যোগাতে না পেরে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
এক সময় দালালদের প্ররোচনায় তিনি কিডনি বিক্রি করতে চান। কিন্তু দালালরা তাকে লিভার বেচতে উৎসাহিত করে।
মেহেদী জানান, লিভার বিক্রি করা যায় এটা তার জানা ছিল না। দালালরা তাকে সাহস দেওয়ায় তিনি ৩ লাখ টাকায় তা বেততে সম্মত হন । কিন্তু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিভারের অংশবিশেষ দেওয়ার পর দালালরা তাকে মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে সড়ে পড়ে।
পরে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। এমনকি তার কোনো খোঁজখবরও তারা নেয়নি বলে তিনি আক্ষেপ করেন মেহেদী।
মেহেদী বলেন, স্থানীয় দালাল সাত্তারের (বর্তমানে পুলিশের কাছে আটক ) মাধ্যমে প্রথমে সে ঢাকা যায় এবং পরে সাইফুলের (বর্তমানে পুলিশের কাছে আটক) কাছে হাত বদল হয়ে চলতি বছরের ৬ মে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৮মে ভারতের ডাক্তারদের মাধ্যমে তার অস্ত্রোপচার হয়।
সেখানে ল্যাবএইড হাসপাতালের ডা. সাইফ, রবিন, জুলফিকার আলী উপস্থিত ছিলেন বলে জানান মেহেদী।
দালাল সাইফুল তাকে জানিয়েছিল লিভারের একটু অংশ দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না।
কয়েকদিনের মধ্যেই তা পূরণ হয়ে যায়। দালালের এমন কথায় তিনি কিডনি বিক্রিতে সম্মত হন এবং ঢাকার মীর গিয়াস উদ্দীন নামের এক লোককে মামা পরিচয় দিয়ে অস্ত্রোপচারের আগে লিবার দেওয়ার অঙ্গীকারপত্রে সই করেন।
মেহেদী জানান, অপরিচিতকে শরীরের কোনো অঙ্গ দেওয়া যাবে না জেনেই হাসপাতালের চিকিৎসকরা মিথ্যে আত্মীয় পরিচয় দিতে বলে। এদিকে অঙ্গীকারপত্রে মেহেদীর সই নেওয়া হলেও সেটির কোনো কপি তাকে দেয়নি ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ।
তবে ল্যাবএইডের দেওয়া অন্যান্য কাগজপত্র থেকে জানা যায়, মেহেদীর হেমাটোলজি করেছেন ডা.শারমিন জামান উর্মি।
তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের প্যাথলজি কনসালট্যান্ট। কালার ডপলার করেছেন একই হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুব ইমাম হোসেন। মেহেদী বলেন, লিভার বিক্রির পর অসুস্হ হয়ে পড়লে তিনি জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রকিবের শরনাপন্ন হয়েছেন এবং বর্তমানে তার অধীনেই এখন তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভিটেমাটিহীন আদরের ছোটভাই বোনকে লালন-পালন, লেখাপড়া ও বোনের বিয়ের খরচ যোগাতে মেহেদী লিভার বিক্রি কললেও তিনি যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে তিনি বাড়ির জমি কিনবেন, বোনের বিয়ে দেবেন, ভাইয়ের পড়ার খরচ দেবেন, না নিজের চিকিৎসা করাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না এখন। কারণ লিভার বিক্রির পর থেকেই তিনি অসুস্থ।
ভারী কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না।
নিজের শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মেহেদী বলেন, ‘আমি বর্তমানে কিছুই খেতে পারি না। পানি খেলেও ব্যাথা হয়, ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, পায়খানা করতে প্রচ- কষ্ট হয়। সামান্য খেলেই পায়খানা চাপে এরকম অনেক সমস্যা এখন আমার শরীরে। ’
তিনি বলেন, ‘সংসারের অভাব দূর করার জন্যই শরীরের এতো বড় ক্ষতি করেছি।
এখন আমি কী করে সংসার চালাবো?’- বলেই অঝোরে কেঁদে ফেলেন মেহেদী।
এ ব্যাপারে থানা-পুলিশের শরনাপন্ন হয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে মেহেদি জানান,’লজ্জায় এবং ভয়ে থানা-পুলিশের শরনাপন্ন হয়নি।
এ বষয়ে জানতে চাওয়া হলে ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসক সাইফ বলেন, নিকটত্মীয়ের জন্য দিতে রাজি হয়েছে জেনে মেহেদীর লিভারের অংশ বিশেষ নেওয়া হয়েছে। ’ এ কথা বলেই মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রকিব বলেন, মেহেদী লিভার বিক্রির প্রমান পাওয়া গেছে এবং তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
’ মেহেদীর উন্নত ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দরকার বলে জানান ডা. রকিব।
আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদ বৃহস্পতিবার সিনিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের আদালতে কিডনী পাচারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। স্বেচ্ছায় দেয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে তিনি বাংলাদেশ, ভারত থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুরে ৩০ থেকে ৪০টি কিডনী পাচারে সহযোগিতা করার কথা জানান ।
কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফজলুর করিম আজকালের খবরকে জানান, সাইফুল তার জবানবন্দীতে দেশের নামীদামী ৮/১০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, তার সহযোগি এবং বেশকিছু ডাক্তারের নাম বলেছেন যারা কিডনী ও লিভার পাচার চক্রের সাথে জড়িত। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশে রাজী হননি।
জয়পুরহাটের মেহেদী নামের এক ছেলের কাছ থেকে একটি লিভার পাচারের কথাও জবানন্দীতে উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য যে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ১৫ টি গ্রামের প্রায় শতাধিক কিডনী ও ১টি রিভার পাচারের মামলায় আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদ গত মঙ্গলবার বাগেরহাটের ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে জয়পুরহাটের কালাই থানা পুলিশ তাকে কালাই থানায় কিডনী পাচার মামলায় জিঙ্গাসাবাদ করছে। এ পর্যন্ত দালাল চক্রের ৫ জন গ্রেফতার রয়েছে। এদের মধ্যে ৩ জনকে ২ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
সত্যতায় এখানে দেখুন.........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।