আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণপিটুনী: আনন্দদায়ক হত্যাকান্ড

ধূলো পড়া ব্লগ..... ‘গণ ধর্ষণ’ কখাটা শুনলে আমাদের মধ্যে যারা একটু সচেতন, সুস্থ, মানসিক বিকৃতি বিহীন স্বাভাবিক মানুষ তাদের অনেকেরই মুখ শুকিয়ে যায়, চোখদুটা করুণ হয়ে আসে এবং চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কারণ ‘গণ ধর্ষণ’ বলতেই চোখে ভাসে একটি অসহায় মেয়ে এবং একদল মানুষরূপী পশু। কিন্তু ‘গণ পিটুনী’ কথাটা শুনলে আমাদের মধ্যে যারা সচেতন এবং যারা অসচেতন তাদের অনেকেরই মুখে কঠোর একটা হাসি ফুটে ওঠে- কারণ হয়তো এই যে গণপিটুনীর কথায় কল্পনায় আসে একটা দুর্ধষ ডাকাত আর একদল সাহসী , শক্তিশালী , ন্যায়পরায়ণ ভালোমানুষ। টেলিভিশনে গণপিটুনীর সংবাদ পরিবেশনের পর অনেককে বলতে শুনেছি, ‘ঠিক হইসে’ ‘উচিত শাস্তি হইসে’। মনে হয আমাদের মধ্যে অনেকের কাছেই গণপিটুনী মানে হল অপরাধীর হাতে হাতে সাজা প্রাপ্তি, যে বিচার ব্যবস্থায় আইনের নানা ফাক ফোকর গলে ধুরন্ধর সব অপরাধীরা পিছলে বেরিয়ে আসে, তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে এটা যেন একরকম নিপীড়িত মানুষের জেগে ওঠা, বিচার ব্যবস্থাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যে, দ্যাখ্ অপরাধীর বিচার কোনরকম ট্রাইব্যুনাল ছাড়াই কতো দ্রুত করা সম্ভব।

এই গত সেমিস্টারের মাঝা মাঝি আমাদের হলে (রশীদ হল- বুয়েট) এক শার্ট প্যান্ট পরিহীত ভদ্রবেশী মোবাইল চোর ধরা পড়লো এবং চোর ধরার সঙ্গে সঙ্গে পুরো হল জুড়ে উত্তেজনা আর আনন্দের এক অভূতপূর্ব বন্যা বয়ে গেল; ঘন্টাব্যাপী চললো ধুরন্ধর সেই চোরের মারধোর সেশন এবং ‘মাইর’ শেষে কোয়ার্টার মৃত অবস্থায় সেই চোরকে পুলিশে দেয়া হল। এরপরের কয়েকদিন হলের ছেলেপিলের মুখে চোর ছাড়া আর কোন কথা নাই, কে চোরকে কত জোরে মেরেছে, কার মারে চোর ব্যাথা পায় নি অথচ অযথাই জোড়ে চিৎকার করেছে তাই নিয়ে তর্ক, বিতর্ক এমনকি মন কষাকষি পর্যন্ত হয়ে গেল। এর কিছুদিন পর এক রাতে টিউশনী থেকে ফিরে বন্ধুর রুমে গিয়েছি পড়াশোনা করতে, হাল্কা হাল্কা পড়ার মুড আসবো আসবো করছে সেই সময় নিচ থেকে চিৎকার শোনা গেল ‘চোর চোর’ ‘ধর্ ধর্’। আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দেখলাম আমার ঐ বন্ধু সহ রূমের সিনিয়র ভাই এবং জুনিয়র পিচ্চিটা তিনজনই অঘোষিত এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিল, কে কার আগে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পড়তে পারে এবং যথাসম্ভব দ্রুত নিচে রওয়ানা হতে পারে। তারা এবং তাদের মত শত শত চোর পিপাষু তরুণদেরকে হতাশার সাগরে ভাসিয়ে (না-কি ডুবিয়ে?) দেখা গেল যে, এবারেরটা পুরাই পলিটিকাল কেস, অপোনেন্ট পার্টির কর্মীকে পেটানোর জন্য খামাখা হলেরই এক ছাত্রকে দেখিয়ে ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করেছে আর সেই বেচারাও প্রাণ ভয়ে দৌড় দিয়েছে।

বারান্দায় দাড়িয়ে আমি সেই হল জুড়ে জেগে ওঠা ছাত্র জনতার ছোট ছোট দলে নিজেদের রুমে ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই ঘটনার উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল বাঙালীর গণপিটুনী প্রিয়তার ছোট একটা উদাহরণ দেয়া। আমাদের সাধারণ মানুষ, মাস পিপল, গণ পিটুনীর প্রতি একরকমের দুর্নিবার আকর্ষণ এবং ভালোবাসা পোষণ করে বলে আমার ধারণা ‌। খুব সহজ এবং সত্যি একটা কথা হল, একজন মানুষকে ধরে পিটানো হচ্ছে এই দৃশ্যের মধ্যে অন্য যে কোন মানুষের জন্য উত্তেজনার এলিমেন্ট আছে, অবশ্যই ভিকটিম যদি আপনজন না হয়। একজন সাধারণ মানুষ, যার নৃশংসতার বিষয়ে তেমন একটা অ্যালার্জি নেই, সে যখন একটা মারধোরের দৃশ্যের মুখোমুখি হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই সেথানে সে দাড়াবে, একই কারণে কিমবা অন্যদেরকে দাড়াতে দেখে আরো মানুষ দাড়াবে।

এইভাবে পিটানোর দৃশ্যে ‘গণ’ জমা হতে থাকে, এই গণ অর্থাৎ জনগণের কেউ কেউ পিটানোতে অংশ নেয়, কেউ কেবল চোখে দেখে এবং অন্যান্যদের পরাক্রম উপভোগ করে তথনকার মতো সন্তুষ্ট থাকে। মধ্যে থেকে এই হয় যে সাধারণ একটা পিটানোর দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যে, কেবল মানুষের কৌতুহলী স্বভাবের কারণে গণপিটুনীর দৃশ্যে পরিণত হয়। মাত্র কয়েকজন মিলে যে কাজটা করলে সেটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, অনেকে মিলে করলে সেটাই যেন একটা অনিবার্য ঘটনা- আসলে গণপিটুনী হল সীমিত পরিসরে গণতন্রের সবচাইতে কুতসিৎ রূপ, আইন এই ব্যাপারে উদাসীন, এবং সবচাইতে হতাশা এবং দু:খের ব্যাপার হল জনমত এই বিষয়ে দ্বিধা বিভক্ত। গণপটুনীর দৃশ্যে অনেক মানুষ জমা হওয়ার আরেকটা খারাপ দিক হল বিশাল একটা জনতা যখন মজা দেখতে দাড়ায়, তখন তারা মজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নড়ে না। তাদের একটা বিশাল অংশের সমর্থন এবং আরো মজা পাওয়ার প্রত্যাশা গণপিটুনীর মূল কান্ডারীদের উপর অদৃশ্য চাপ তৈরি করে, মাঝে মধ্যেই মজার শেষটা হয় দু:খ জনক একটা হত্যাকান্ড সম্পাদনের মাধ্যমে।

রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘কিলিং দ্য এলিফ্যান্ট’‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ গল্পে এরকম একটা সত্যি ঘটনার বর্ণনা আছে যেখানে লেখককে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেবলমাত্র মজা দেখতে আসা জনতাকে তৃপ্ত করার জন্য একটা হাতিকে গুলি করে মারতে হয়েছিলো। গণপিটুনীর সময় বা জায়গাটাকে আমার মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট একটা সিস্টেম মনে হয়, এরকম সিস্টেম যেখানে মানুষের ভেতর বাস করা পশুটাকে টেনে বাইরে বের করার সব রকমের আয়োজন থাকে, যেমন নৈতিক সমর্থন- সে অপরাধী, তাকে মারা প্রয়োজন, নাহলে এরকম অপরাধ আরো হবে, এই অপরাধীর পরিণতি দেখে অন্য অপরাধীরা সাবধান হবে ইত্যাদি, এবং অবশ্যই সুযোগ- এ্র্যাতো মানুষ আমরা, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ টাইপের ব্যাপার আরকি। গণপিটুনী এবং গণহত্যার মোটিভেশন একই ধরণের, একাত্তরে নিরীহ বাঙালীদের উপর পাকিস্তানী সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেয়ার আগে তাদেরকে বলা হয়েছিলো যে তারা ইসলামের পক্ষে জিহাদ করছে, তাদেরকে বাঙালী হত্যার অনুমতি এবং আদেশ দেয়া হয়েছিলো এবং হাতে দেয়া হয়েছিলো সেই সময়ের আধুনিকতম মানুষ হ্ত্যার সরন্জাম। অনেকের ধারণা এই যে গণপিটুনীতে অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে এটা ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক সহীহ বা শুদ্ধ কাজ। এটা হয়তো ঠিক যে ইসলাম অপরাধীদের কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলে, কিন্তু ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় আগে অপরাধের সব উৎস মুখ বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়, যাকাতের মাধ্যমে সমাজে ধনী আর গরীবের দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়, অভাবের অভিশাপ থেকে মানুষের মুক্তির পাকা বন্দোবস্ত করা হয়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে একদিকে সম্পদের মাউন্ট এভারেস্ট আর অন্যদিকে দারিদ্রের পচা ডোবা, সেখানে বিচ্ছন্নভাবে ইসলামী রাস্ট্রের নিয়ম মানার কোন সুযোগ নেই। যদিও আমার জানা মতে অপরাধীকে ধরা মাত্র পিটিয়ে মেরে ফেলা, ইসলাম দূরের কথা, পৃথিবীর কোন ধর্মই সমর্থন করে না। এটা ঠিক যেসব মানুষ গণপিটুনীতে আহত বা নিহত হয়, তারা নিজেরাও নৃশংস, হয়তো ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের পুলিশ রেকর্ড অনুসন্ধান করা হলে অপরাধের লম্বা ফিরিস্তি পাওয়া যাবে, কিন্তু তার অপরাধ বিচার এবং শাস্তি কার্যকর করার আমি কে? গণ পিটুনীর সময় কোন কোন অতি উৎসাহী যখন হিংস্র উল্লাসে হাতের কাছে ইট বা লাঠিসোটা যা পায় তাই দিয়ে ভীকটিমের মাথা ঘাড় এইসব দুর্বল জায়গায় হত্যার উদ্দেশ্যে পেটাতে থাকে, বুকের উপর উঠে পাড়াতে থাকে তখন বিষয়টা আর অপরাধীর শাস্তির মত মামুলী থাকে না, যারা পিটায় তারা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য পিটায় না, তাদের ভেতরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা পশুটার তৃপ্তির জন্য পিটায়, যারা কাছ থেকে গণপিটুনীতে সমর্থন দেয় তাদেরও ন্যায়ের প্রতি দরদ উপচে ওঠে না, তারা সমর্থন দেয় একটা রোমহর্ষক মজার ঘটনাকে। তাই গণপিটুনী কোনভাবেই সমাজের জন্য ভালো কিছু আনবে না, কারণ এখানে একজন বা কয়েকজন অপরাধীর শাস্তি হয় বা মৃত্যু হয়, কিন্তু ঠিক সেই জায়গায়, সেই সময়ে অসংখ্য অপরাধী এবং খুনীর জন্ম হয়। মোদ্দা কথাটা হল সভ্য সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা গণপিটুনী, কিমবা গণপিটুনীর কোন জাতভাই, যেমন ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হতে পারে না।

দেশের আইন , আদালত , বিচার ব্যবস্থা কেন সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না- এসবের মধ্যে তাহলে সমস্যা আছে, সেসব সমস্যাকে একটা একটা করে খুজে বের করে তার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে সব পুরনো ব্যবস্থাকে সংস্কার , এমনকি দরকার হলে রিপ্লেস করতে হবে। সবচাইতে বেশী যেটা প্রয়োজন তা হল জাতি হিসেবে আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন। আমরা বর্বর নই, পৈশাচিক কোন ঘটনা, তা সেটা যত বড় অপরাধীর সঙ্গেই ঘটুক না কেন, আমাদের সমর্থন পাবে না। মনে রাখতে হবে অপরাধীরা কোন ভিন গ্রহের আগন্তুক না, তারা এই সমাজ থেকে তৈরি হচ্ছে।

গণপিটুনীর মত সামাজিক হত্যাকান্ড গুলো অপরাধের বীজকে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়, আইনের বিরুদ্ধাচারণকে একরকমের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে অপরাধকেই উৎসাহ দেয়, এসব ঘটনাকে বন্ধ করতে না পারলে বীজ থেকে একদিন যে মহীরূহ হবে তার মুখোমুখি হবার জন্য আমাদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।