আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে দুর্নীতি: ধারণা, প্রেক্ষিত ও প্রাতিষ্ঠানিক মোকাবিলার হালচাল

(কিস্তি:৩) দুর্নীতি আলাপ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কেন? পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার শুধু ঘুষই লেন - দেন হয়, বছরে যার পরিমাণ দাড়ায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমান। ১৯৮৪-৮৫ থেকে ১৯৯৩-৯৪ সালে এদেশে দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ মোট উন্নয়ন বাজেটের চেয়েও বেশি বলে ঞওই তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়, ঐ সময়ে দুর্নীতির কারণে এনজিও, ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতি হয় তার পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতিতে আছে বিদেশীদের ভূমিকা বাংলাদেশে দুর্নীতি ও তা দমনকে বুঝতে দুটো দিক গুরুত্বর্পূণ। একটি হল, বাংলাদেশের দুর্নীতিতে বিদেশীদের ভূমিকা এবং বিদেশী অভিযোগকারীদের চরিত্র।

বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে যেই পল উলফউইজ মুখর হয়েছিলেন তিনি বিশ্বব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হন ব্যক্তিগত নারী কেলেংকারি এবং দুর্নীতি করে তার বান্ধবীকে অর্থ পাইয়ে দেয়ার জন্য। বাংলাদেশে বড় আকারের দুর্নীতি শুরু হয় এবং তা প্রসার লাভ করে বিদেশীদের প্ররোচনায়। দুর্নীতির সিংহভাগ মুনাফাও যায় পেটে। তাদের দুর্নীতিতে সহায়তা করার জন্য তারা যে দালাল সৃষ্টি করে এ তো এখন জানা কথা। ক্ষমতাবানরাই সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক, আমলা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকরাই এ দেশে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ শ্রেণী।

দুর্নীতির কূটকৌশল এবং এর অস্বাভাবিক বিস্তারকার্য সাধারণ মানুষের বোধশক্তিকেও বিনষ্ট করেছে। অনেকেই আজ বুঝতেও সক্ষম নন কোনটি দুর্নীতি এবং কোনটি দুর্নীতি নয়। আপাত বৈধতার আবরণে চলছে লুণ্ঠনের তাণ্ডব। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই মূলত সেসবের হোতা। বিভিন্ন সরকার তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ও সমর্থকদের জন্য যেসব অনুগ্রহ বণ্টন করে থাকে, তাও একধরনের বকশিশের কালচারে পরিণত হয়েছে এবং এই কালচারের খেসারত দিতে হয় জাতিকে।

বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত একটি শ্রেণীর প্রসার ও বিস্তৃতি লক্ষণীয়। আমলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক টাউট, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, এমনকি দেশের এলিট সম্প্রদায় সরকারের অনুগ্রহভাজন এই শ্রেণীটির অন্তর্ভুক্ত। তারা তাদের ঘিরে ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের অপরিহার্যতার ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে রেখেছে, যার ফলে ক্ষমতার দরদালানে তাদের অবাধ বিচরণ। সামাজিক সংযোগ, কিছুটা জালিয়াতি এবং স্তাবকতা এসবই তাদের ক্ষমতার বলয়ে টিকে থাকার আশ্চর্য শক্তি জোগায়। শুধু তা-ই নয়, এসব বৈশিষ্ট্যই বিভিন্ন সরকারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

যার ফলে এরা প্রায় সব সরকারের আনুকূল্যলাভে সমর্থ হয়। এদের জন্য বিভিন্ন পদ, পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে সরকারের কোনো ধরনের কার্পণ্য নেই। উদ্দেশ্য শুধু একটাই, এই অনুগত-স্তাবকদের সতত মোসাহেবির বিনিময়ে কিছু 'বকশিশ'-এর ব্যবস্থা| বিভিন্ন সরকারের আমলে কত রকমারি বোর্ড ও কমিশনের গঠন এবং পুনর্গঠন হয়, যার মাধ্যমে সরকারের অনুগ্রহভাজনদের জন্য কিছু বকশিশের ব্যবস্থা করা,তাতে দেশ ও সর্বসাধারণের কোনো মঙ্গল নিহিত থাকুক বা না থাকুক। এমনকি, বিদেশে অনর্থক, অহেতুক দূতাবাস বা মিশন খোলা হয়েছে, যাতে এদের কেউ কেউ সেগুলোতে নিয়োগ পেতে পারে। এই স্তাবকরা একটি বিশেষ সম্প্রদায় এবং এদের টিকে থাকার শক্তি অপরিসীম ও এরা কদাচিৎ ব্যর্থ হয়।

দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থেই দুর্নীতি হয় দুর্নীতির দায় সরকারপ্রধান ও সরকারকে নিতে হয়| রাষ্ট্রীয় ও সরকারের কর্মকাণ্ড যখন বিভিন্ন পন্থায় সরকার ও মন্ত্রীদের কর্মকাণ্ডের নিয়ামক হলো, তখনই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যবস্থা নিতে অপারগতাকে ভোক্তারা দুর্নীতি-প্রভাবিত বলে মনে করে। টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজ, বৃক্ষনিধনকারী, নদী-জমি দখলকারীদের উচ্ছেদে গড়িমসি দেখে জনগণ বলে, ডালমে কুছ কালা। এই কালো ডালের ভেতরই লুক্কায়িত আছে দুর্নীতি গুজব। এসব গুজব-গুঞ্জরণ অভিযোগ আকারে উত্থাপন বা প্রকাশ করা যায় না বলেই দুর্নীতি নাই বলা যায়।

দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা মন্ত্রিসভার বৈঠক করে হয় না, অথবা নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রীর দুর্নীতি উচ্চপর্যায়ে আলোচিত হয় না। সেসব নিয়ে সচিবালয়ের করিডরে অথবা হাট-বাজারের চায়ের দোকানে রসাল আলাপ হয়। অপরদিকে জনগণ দুর্নীতির অভিযোগে যখন সোচ্চার হয়, তখন শুধু কোনো মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় আনে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতিবাজ ছাপ মারতে কয়েকজন বিশেষ মন্ত্রী নয়, সরকারের সব পদক্ষেপ, নীতিনির্ধারণ, সার্বিক কর্মকাণ্ডকে বিবেচনায় আনে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতির সঙ্গে যখন প্রভাবশালী অথবা সরকারের কর্মকাণ্ডের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রকের দুর্নীতির বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা ঘটে, তখন দুর্নীতির দায় এককভাবে সরকারপ্রধান ও সামগ্রিকভাবে সরকারকে নিতে হয়।

সরকারি পৃষ্টপোষকতায়ই বড় বড় দুর্নীতি সম্ভব স্বাধীনতা পরবতর্ীকালে বাংলাদেশ বিমানে লুটপাট শুরু হয় এরশাদ সরকারের সময়ে। এধারা বিএনপি ও আওয়ামীলীগের সময়ও অব্যাহত ছিল। জোট সরকারের সময় দুর্নীতি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে অলিখিত নির্দেশ ছিল বিমান ক্রয় বিক্রয়ের দায়িত্ব পালন করবেন শামীম এস্কান্দার। জোট সরকারের পাচ বছরে যাবতীয় কমিশনমুখী কার্যক্রম, নিয়োগ বদলি বাণিজ্য তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

এজন্য তিনি গড়ে তুলেন একটি সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। দুর্নীতি সীমাহীন দুভের্াগের কারণ জেনেভা ভিত্তিক সংস্থা 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম' বাংলাদেশের ৮১ টি কোম্পানীর ওপর এক জরিপ চালায়। এসব প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৯৭ জনই বলেন যে, রাজনীতিবিদদের সততার ওপর তাদের কোন আস্থা নেই। শতকরা ৬৮ জন বলেন যে, বিচার বিভাগও রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত নয়।

২০০৩ সালের জুলাই মাসে মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড সেন্টার এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়- বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হয় না কায়েমী স্বার্থবাদীদের চাপে নীতি বদলে যায় এক সরকারের চুক্তি অন্য সরকার বাতিল করে এবং চাদাবাজদের পিছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা ২০০৩ সালের জুলাই মাসেই বিশ্ব ব্যাংকও বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্নীতিযুক্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ২০০৩ এ বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দুর্নীতিই হলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম সবের্াচ্চ বাধা। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে জাপানী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও বিভাগের বিনিয়োগে খোলাখুলি ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারী কে টমাস ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর আমেরিকান ক্লাবের এক সমাবেশে বলেন, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

৩০ অক্টোবর ২০০৩ হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক সমাবেশে বৃটিশ হাইকমিশনার ডেভিড কার্টার বলেন, বিদ্যমান আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, ঘুষ-দুর্নীতি, রাজনৈতিক হ্স্তক্ষেপ, লালফিতার দৌরাত্ব ইত্যাদিতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ঢাকাস্থ আবাসিক প্রতিনিধি শিবুইচি বলেছেন যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়ই হলো আইন শৃঙ্খলার অবনতি , ঘুষ - দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রস্থ ইউনাইটেড ট্রেড সেন্টারের ' কান্ট্রি কমার্শিয়াল গাইড ২০০৩' এ বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয় যে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ঘুষ দাবি করা বাংলাদেশে একটি সাধারণ বিষয় বা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। জাপান কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কতর্ৃক পরিচালিত এক জরিপ থেকে বেরিয়ে আসে যে, ঘুষ না দিলে জাপানী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে মাল্টিপল ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটই দেয়া হয়না। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ২০০২-২০০৩ এক অর্থ বছরেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কালো টাকা পাচারের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার সিংহভাগই পাচার হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে।

জনাব আব্দুল আউয়াল লেখেন, বাংলাদেশে কাস্টমস বিভাগ প্রতি বছর যে দুর্নীতি করে তা দিয়ে এদেশের একশটি কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা সম্ভব। (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.