মেঘলা আকাশ আমার একটুও ভাল্লাগেনা....
তোমার অনেক পছন্দের ছিলো,মনে আছে তোমার??আকাশে একটু মেঘ ধরলেই কি যে
ছেলেমানুষী করতে !! গোঁ ধরে বসে থাকতে বৃষ্টি এলে,বৃষ্টিতে ভিজবে
বলে....অথচ একটু ভিজলেই ঠান্ডা লেগে যেত তোমার....
তোমার কথা অনেক ভাবি,জানো??
তোমার সাথে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে,প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা..প্রথম হাত
ধরা,দুজনের একসাথে প্রথমবার ফুচকা খাওয়া আরো কত কি!!
ভার্সিটির দিনগুলোর কথা মনে আছে তোমার??
প্রথম দিন থেকেই আমি ক্লাশের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়াতাম...আর
তুমি??ক্লাশের এক কোণায় চুপটি করে বসে থাকতে....তোমাকে তো আমি কখনো
খেয়ালই করিনি । অবশ্য তুমি বোধহয় এটাই চাইতে । প্রথম যে দিন তোমাকে আমি
খেয়াল করি,সেদিন ছিলো ১৪ই ডিসেম্বর,আমার জন্মদিন । ক্লাশের সবাই আমার
জন্য সারপ্রাইজ পার্টি দিয়েছিলো ।
খুব মজা করেছিলাম সেদিন ।
সব আয়োজোন শেষে যখন কেক খাওয়ানোর পালা এলো,তখন
সবাই মারামারি করে কেক খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে গেলো । অবাক হয়ে
দেখলাম,তুমি সেদিনও জানালার পাশের বেঞ্চটিতে মাথা নিচু করে বসে আছ
.....এত হইচই,এত আনন্দ,কোন কিছুর সাথেই যেন তোমার কোন যোগাযোগ নেই.....
আমি এক পিস কেক নিয়ে তোমার কাছে দাঁড়ালাম । তুমি আমায় খেয়ালই করলেনা ।
তোমার কাছে গিয়ে বললাম-
-এই যে শুনছেন ? সবসময় এভাবে মাথা নিচু করে বসে থাকেন কেনো ? সবসময় এভাবে
থাকলে তো ঘাড় থেকে মাথা খুলে পড়ে যাবে...
তুমি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালে । তোমার তাকানোয় কি কিছু ছিলো ? তা
নাহলে,বুকের ভেতরটায় এমন করে উঠল কেনো ?
নিজের অজান্তেই সেদিন আমি তোমার মাথা নিচু করে থাকার অধ্যায়ের ইতি টেনেছিলাম ।
এরপর ক্লাশের দুষ্টামির ফাঁকে ফাঁকে আমি তোমার দিকে তাকালেই,তোমার সাথে
চোখাচোখি হত । তুমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিতে ।
কয়েকদিন পর,আমি নীনা কে হাসতে হাসতে বলেছিলাম,
-কিরে,ক্যাবলাকান্ত তো মনে হয় আমার প্রেমে পড়েছে ....কিভাবে যেন তাকায় ....
নীনা কে চিনেছ তো ? তোমার বাসার কাছেই যেন কোথায় থাকত । গত বছর বিয়ে
করেছে সে । স্বামী নিয়ে এখন দিব্যি আছে ।
সেদিন ও আমায় খুব বকেছিল ।
আমার বাবা বেশ বিত্তশালী মানুষ ....কখনো কোন কিছুর অভাব আমায় বুঝতে দেননি
। তাই বোধহয়,সমাজের অসঙ্গতি গুলো আমার কখনো চোখেই পড়েনি .... নীনার কাছে
তোমার সব কথা শোনার পর খুব লজ্জা পেয়েছিলাম ...ওর কাছ থেকেই জানলাম,খুব
কষ্ট করে পড়ালেখার খরচ জোগাতে তুমি...ক্লাশ শেষে বেশ কয়েকটা টিউশনী করে
কষ্টে-সিষ্টে দিন কাটত তোমার ...
আমার মনের শ্রদ্ধার জায়গাটি অনেক আগেই দখল করে নিয়েছিলে তুমি । আমি
প্রায়ই তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম,তোমার সাথে একটু কথা বলব বলে ...
বিরক্ত হতে কিনা জানি না,তবে লজ্জা পেতে বেশ । একটু এড়িয়েও চলতে চাইতে
.... আমাকে ভয় পেতে,তাই না ? আমার মাথা তো একটু না,অনেক বেশিই খারাপ
ছিলো,এজন্যই হয়তো ...
এরপর কি জানি হল,পরপর ২-৩ দিন তোমার কোন দেখা নেই ...তোমার সেলফোন ও ছিল
না ।
খুব অস্থির হয়ে গেলাম,তোমার একটু খোঁজ পাওয়ার আশায় ...নীনা কে বলে
কয়ে,তোমার সাথে দেখা করানোর জন্য সেদিন জ্বালিয়ে মেরেছিলাম ।
তোমার মেস মেম্বাররা আমায় দেখে খুব বিরক্ত হয়েছিল... পুরোটা মেস কি যে
নোংরা !! একটা মেয়ের সামনে এভাবে মনে হয়,তারা পড়তে চায়নি ...সবার সব রাগ
গিয়ে পড়ল তোমার উপর ।
একটু পাগলই ছিলাম,তাই না ?? এজন্যই তো তোমার অবস্থা দেখে কেঁদে বুক
ভাসিয়েছিলাম । সেদিন জ্বর তেমন ছিলো না তোমার । কিন্তু গায়ে ছেঁড়া কাথা
দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে আর সহ্য হল না ...
তুমি বেশ বিব্রত হয়েছিলে......
এরপর যেদিন তুমি ক্লাশে এলে,আমি তোমায় কি বলেছিলাম মনে আছে ? আমার তো বেশ
মনে আছে ।
বলেছিলাম-
-তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও ? না বলতে চাইলে সমস্যা নেই । আমি ই
বলি,তুমি চুপ করে শোন । আমি প্রতিটা বর্ষায় তোমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে
চাই । তুমি না চাইলে সমস্যা নাই । আমি চাই সেটাই ইম্পর্টেন্ট ।
তুমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে । হয়তো ভাবছিলে,এই পাগলটাই শেষমেষ কপালে জুটল !!!
তোমার একমাত্র কাজ ছিলো আমাকে পাহারা দিয়ে রাখা...বেশিরভাগ সময়ই আমার হাত
ধরে রাখতে তুমি...যা লাফ-ঝাপ দিতাম...ভাবতে হয়তো,কে জানে,লাফালাফি করতে
গিয়ে যদি আবার গাড়ির নিচে পড়ে-টড়ে যাই...
ভার্সিটির দিনগুলো দেখতে দেখতেই কেটে গেলো...কি চমৎকার ছিলো সেই
দিনগুলো....তুমি অবশ্য পড়ার পোকা ছিলে....সারাদিন পড়া আর পড়া....এতকিছুর
মাঝেও আমাকে কখনো আমার ভাগের সময়টুকু থেকে বঞ্চিত করনি...করবেই বা
কেনো???তোমার সবটুকু সময়ই তো আমার....
যেদিন তোমার রেজাল্ট দিলো,কি যে খুশি হয়েছিলাম !! কার সাধ্য আছে তোমার
চাকরি ঠেকায় ??
সেদিন তোমায় বলেছিলাম,"আমাকে বিয়ে কর । নইলে কিন্তু আমি তোমার ঠ্যাং
ভেঙ্গে রাস্তায় বসিয়ে দিব । চাকরি-বাকরি ছেড়ে ভিক্ষা করতে হবে তখন । "
সেদিনই বিয়ে করলে তুমি আমাকে ।
আমাকে নিয়ে যাওয়ার মত কোন জায়গা তোমার
ছিলো না । তাই বিয়ের কথা বাসায় জানালাম না । তুমি যেদিন চাকরি পেলে,তার
কয়েকদিন পর আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে বাসা ছেড়ে আসতে গিয়েই মার সামনে পড়লাম
।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,"কিরে মিতুল,কই যাস ? "
আমি বলেছিলাম,"মা,আমি আকাশ কে বিয়ে করেছি । ও চাকরি পেয়েছে,তাই ওর কাছে
থাকতে যাচ্ছি ।
"
মা খাবি খেতে খেতে বললেন,"তুই বিয়ে করেছিস?"
বাবা-মা খুব রাগ করেছিলেন । আমাকে সাথে করে কিছু আনতেই দিলেন না । তাতে
কি ? তুমি আছ,এই তো অনেক...
তুমি আমাকে আমাদের নতুন বাসায় নিয়ে গেলে । টিনের চালওয়ালা ছোট্ট একটা
বাসা । থাকার জন্য হয়তো একটু ছোটই ছিলো ..... কিন্তু,ঘরের প্রতিটা কোণ
ছিলো ভালবাসায় আর্দ্র ।
যেটুকু ফার্ণিচার না হলেই না,সেটুকু আমরা দুজন কত যত্ন নিয়েই না
কিনেছিলাম ... আমার ছোট বোন টুশি আমাদের সাজানো ঘর দেখে বলেছিল,"ইশ
আপু,তোরা যে কি লাকি!!"
বাবা-মা ও একসময় আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলেন । বাবা তোমাকে কত করে
বলেছিলেন,"এই ছোট্ট বাসায় থাকার দরকার কি ? আমার একটা বাড়ি তো খালিই পড়ে
আছে । তোমরা সেখানে থাক না কেন?"
তুমি বলেছিলে,"বাবা,আপনার মেয়ে যদি একবার বলে,সে আমার সাথে এই ছোট্ট
বাসায় অসুখি আছে,তাহলে আপনার প্রস্তাব মেনে নিতে আমার আপত্তি থাকবে না । "
বাবা একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যা বুঝার তা বুঝে নিলেন ।
বিয়ের পরের দিন গুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো ।
প্রতি মাসে একবার
করে ঘুরতে যাওয়া,বৃষ্টি হলে দুজনের একসাথে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ
শোনা,বারান্দায় বসে রাতের তারাগুলোকে নাম দেয়া ...সব কেমন যেন স্বপ্নের
মত ছিলো,তাই না??
যেদিন তুমি জানলে,তুমি বাবা হবে কি যে খুশি হয়েছিলে তুমি !! কাঁদতে
কাঁদতে আমায় বলেছিলে,"বাবা-মা মারা যাওয়ার পর,ছোট চাচার সংসারে থেকে অনেক
কষ্টে লেখাপড়া করেছি । আমার বাচ্চাকে আমি অনেক অনেক আদর করব,দেখো । "
সেদিন ছিলো ৫ই অগাষ্ট । তুমি আমায় বললে,"এস, তুমি,আমি আর আমাদের বাবু
তিনজন মিলে,দিনটাকে সেলিব্রেট করি । তুমি জলপাই রঙের শাড়িটা পরে নাও ।
আমরা সারাদিন রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াব । "
জলপাই রঙ টা তোমার অনেক পছন্দের ছিলো । বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমি তা
হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম । আমাদের ছোট্ট কাঠের আলমারিটা তুমি জলপাই রঙের
শাড়িতে ভর্তি করে দিয়েছিলে ।
বাইরে কেমন মেঘ মেঘ করছিলো ।
এর মধ্যেও আমরা বের হয়েছিলাম...তোমার প্রিয়
শাড়িটাই পরেছিলাম সেদিন । পুরোটা রাস্তা আমার হাত ধরে ছিলে তুমি । এরপর
হাতটা এমন ভাবেই ছাড়লে,আর চাইলেও এখন তোমায় ছুতে পারি না । আমার বাবুটাও
তোমার সাথে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো । আচ্ছা,ও থাকলে কার মত হত ?? তোমার
মত নিশ্চয়ই ...
জানো,আকাশ ভেঙ্গে যখন বৃষ্টি নামে,কেন যেন মনে হয়,আমাকে একা ফেলে ভাল নেই
তুমি...তাই হয়তো তোমার চোখের জল,বৃষ্টি হয়ে আমাকে ছুয়ে দিতে চায়....
প্রতিটা বর্ষায় আমি অপেক্ষা করি তোমার চোখের জলে ভিজব বলে......
মেঘলা আকাশ আমার একটুও ভাল্লাগে না...
তবুও চাতক পাখির মত বৃষ্টির অ্পেক্ষায় দিন কাটে আমার...
****************************************************************
৫ই অগাষ্টের রোড এক্সিডেন্টে মিতুল পা হারালেও বেঁচে যান এবং বাবা-মার
সাথে ফিরে যান তাদের বাড়িতে ।
আজকাল,বিছানায় শুয়ে জানালায় দেখা ছোট্ট এক টুকরো আকাশের সাথে কথা বলে দিন
কাটে মিতুলের । মিতুল কেমন আছে জানিনা...কিন্তু শুনেছি, যেদিন আকাশে মেঘ
করে,কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে মিতুল ।
- ফারহানা নিম্মী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।