(প্রথম কিস্তি)
বাংলাদেশে একপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ , অন্যদিকে তাদের বুকে পিঠে পা রেখে উপরে উঠে যাওয়া দুর্নীতিবাজ যারা ক্ষমতাকে উপার্জনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে অর্থ সম্পদ করেছেন, কিন্তু আইনসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। দুর্নীতিগ্রস্ত এ দেশে দুর্নীতিবাজরা বলেন,তাদের ক্ষমতাকালে বাংলাদেশে দুর্নীতি হয় নাই; হলেও সেটা তারা করেন নাই; করেছে হয়তো অন্য কেউ ? দুর্নীতি মানুষকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে । দুর্নীতিকে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারলে রাষ্ট্রের প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে। সিঙ্গাপুরে ১৯৬৫ সালেও আমাদের চেয়ে বেশি দুর্নীতি ছিল। তারা পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটাতে পেরেছে।
গত কয়েক দশকে সমাজে একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে যে দু-একজন দুর্নীতি করতেন তাদের ছোট হয়ে থাকতে হতো; অনেকে এমন লোকের বাসায়ও যেতনা । আর এখন যারা দুর্নীতি করেনা, তারাই চুপেচাপে থাকে। তাদের ছেলে মেয়েরা ভালভাবে পড়াশুনাও করতে পারেনা। সরকারি ও বেসরকারি খাতে যেভাবে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে তা নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক।
ঘুষ , দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট, জালিয়াতি বেড়েই চলছে। প্রতিদিন নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
দুর্নীতি বাড়ছে। সমাজ জিম্মী হয়ে পড়েছে দুর্নীতিবাজদের হাতে। স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও চলাফেরা করতে পারছে না স্বাধীনভাবে।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে ক্যান্সার আকার ধারণ করছে এ সমস্যা। দুর্নীতির কারণে অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই দেশের সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সর্বজনীনভাবে প্রচারিত। এখানে দুর্নীতি এত ব্যাপক যে দুর্নীতির কথা চিন্তা করেই এবং উদ্ভূত অতিরিক্ত ব্যয় জেনেই সকলে ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসেন।
ক্রমপ্রসারমাণ দুর্নীতি : ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
'দুর্নীতি দমন , দুর্নীতি বিরোধী অভিযান আ্ন্তর্জাতিক ও দেশীয় অঙ্গনে অত্যন্ত আলোচিত বিষয় ।
বাংলাদেশের মত 'দরিদ্র, দেশে 'দুর্নীতির আধিক্য বেশী হওয়ায় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরহীন মনে করা হয় । প্রাথমিক সময়ে 'দুর্নীতি' প্রশাসনিক 'দুর্নীতি' হিসেবে চিহ্নিত হতো । প্রায় সকল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতেই 'দুর্নীতির' কমবেশী উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় । রাজনৈতিক 'দুর্নীতির ' বৈশিষ্ট্যই প্রশাসনিক এলাকার 'দুর্নীতির' চেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্লেটো শাসকদের 'স্বার্থপরতা ' ও 'দুর্নীতিমুক্ত ' রাখার জন্যে তার Republic এ তাঁদেরকে সম্পত্তি ও পরিবারহীন জীবন যাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন ।
এছাড়া 'ঘুষ' সম্পর্কেই The Laws গ্রন্থেও প্লেটো জাতীয় কর্মচারীদেরকে উপহার সামগ্রী গ্রহণ ব্যতিরেকে দায়িত্ব পালনের ওপর গু্রুত্ব আরোপ করেছেন । প্রাচীন চীন দেশীয় ম্যানডারিন আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যাযে নিয়োগ ব্যবস্থার কড়াকড়ি এবং আদর্শিক কারণে 'দুর্নীতি ' চর্চা কম হলেও নিম্ন পর্যায়ে 'দুর্নীতির' সন্ধান পাওয়া যায় । উদাহারণ হিসেবে প্রাচীন চীনে সরকারী কর্মচারীদের 'দুর্নীতিমুক্ত' রাখার জন্যে Yang–Lien (দুর্নীতিমুক্ততার পুরষ্কার) নামক এক ধরনের অতিরিক্ত ভাতা দেয়া হতো।
ইবনে খালদুন শাসক গোষ্টীর জাঁকজমকপূর্ন জীবন যাপনের অদম্য আগ্রহকে 'দুর্নীতির' মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন । ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৎকালীন সরকারী কর্মচারীদের 'দুর্নীতির' চর্চা ধরা পড়ে ।
মোঘল আমলে 'মথুযার ফৌজদার' আব্দুন নবী অবৈধ কর সংগ্রহ এর মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি সঞ্চয় করেছিলেন । ব্রিটিশ আমলের প্রশাসনও ছিল দুর্নীতিপূর্ণ। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের এ প্রশাসনের 'দুর্নীতি' ও লুটপাটের তীব্রতা দেখে অনেক সময় ইংরেজ আশ্রিত নবাবরাও "অ্ক্ষম আর্তনাদ" করেছেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির পর ভারত বা পাকিস্তান কেউই 'দুর্নীতি' সীমিত করার ব্যাপারে সফলতা পায়নি। 'স্বজনপ্রীতি' 'ঘুষ' 'রাজনৈতিক প্রভাব' ইত্যাদির প্রভাব উভয় দেশের প্রশাসনে উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্রেইবা্ন্তীর উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্মটি থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানী আমলে শুধুমাত্র ১৯৫৯-৬০ 'দুর্নীতিপরায়নতার ' জন্যে ২৫৪ জন সরকারী কর্মচারীদের বরখা্স্ত, ৬০ জনকে বদলি এবং ৮৭৭ জনকে চাকুরী থেকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর দেয়া হয়। পাকিস্তানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি দমন করার জন্য Constituent Assembly ১৯৪৯ সালে public and Representative offices Disqualification Act পাশ করে ।
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এই ধারনায়নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাচ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা তাদের নীতি নির্ধারনে প্রধানতম বিষয় হিসেবে দুর্নীতিকে নিয়ে এসেছে। ১৯৯৩ সালে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলের বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন পরিচালকের হাত ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনালের যাত্রা শুরু করে।
১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাংকের তাৎকালীন প্রেসিডেন্ট আফ্রিকার প্রধানতম সমস্যা হিসেবে দুর্নীতিকে Cancer of Corruption রুপে অভিহিত করে এবং এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার প্রধানতম সমস্যা হিসেবে দুর্নীতিকে অভিহিত করা হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বিভিন্ন সময়ে বেসামরিক ও সামরিক সময়ে 'দুর্নীতি ' কথা শোনা গেছে । সামরিক সরকারগুলো বিভিন্ন কায়দায় 'দুর্নীতিকে' ব্যবহারও করেছেন । সামরিক সরকারগুলোর 'দুর্নীতি ' ধারনায়ন ব্যবহার করার পরে বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে বৃহত্তর পরিসরের আলোচনা শোনা যায় নব্বই দশকে এসে । নব্বই দশকে এসে ব্যাপক 'দুর্নীতি' আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারনা সূচকে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত সর্বাধিক দুর্নীতিযুক্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে ।
একইভাবে ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই চারবারও বাংলাদেশ এই ধারনা সূচকে একই স্থানে অটুট থাকে। ২০০৬ সালে ৩য়, ২০০৭ সালে ৭ম,২০০৮ সালে ১০ম, ২০০৯ সালে ১৩ তম, ২০১০ সালে ১২ তম স্থানে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই দুর্নীতি ধারনায়নে সরকার , সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং কতিপয় নাগরিকের অনিয়মের প্রেক্ষিতে পুরো রাষ্ট্রকে দুর্নীতিযুক্ত হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় । রাষ্ট্র যেখানে নূন্যতম পর্যায়ে হলেও তার আইন কানুন বলবৎ করে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রন করে এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে সেই রাষ্ট্রকেই কতিপয় সুচক ব্যবহার করে দুর্নীতি পরায়ন রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয় । বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বিগত উপদেষ্টা সরকারের প্রধান এজেন্ডা ছিল।
দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী ,আমলা,রাজনৈতিক কর্মী সহ বিভিন্ন স্তরের লোকজন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রন সংস্থা (যৌথবাহিনী সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিডিআর) দ্বারা গ্রেফতার হয়েছিল। যৌথবাহিনীকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল । একই সময়ে বিভিন্ন সংস্থা ,প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুর্নীতি বিরোধী কনফারেন্স হয়েছিল ,যারা এ যাবৎকাল ক্ষমতাসীন হতে পারেননি তারা দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছিল । পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন মিডিয়া, টকশোতে এমনকি ইন্টারনেটে দুর্নীতি বিরোধী ব্যাপক লেখালেখি হয়েছিল , এখনও হচ্ছে ।
দুর্নীতি বর্তমান বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা
সর্বাধিক দুর্নীতিযুক্ততার কালিমাটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনলের বদৌলতে লেগেছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নামে ।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযান যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হলে সেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রনী কর্তা হিসেবে আবিভুত হয় সেটি স্পষ্টত: প্রতীয়মান হয়েছে । দুর্নীতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা একথার মধ্যে কোনরুপ সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়।
দুর্নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ
দুর্নীতি সমাজের জন্য মহামারী এবং অভিশাপতুল্য। দুর্নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের সাধারণ জনগণ এবং সৎ ও ভদ্র শ্রেণী। দুর্নীতির মাধ্যমে কাউকে অধিক সুবিধা দেয়া হয়, আবার ন্যায্য পাওনাদার হয় অধিকার বঞ্চিত।
আবার দুর্নীতিবাজেরা অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে অন্যের প্রাপ্য অধিকার আত্মসাৎ করে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক প্রয়োজনটুকুও পূরণ থেকে বঞ্চিত হয়। সর্বোপরি সামাজিক দুর্নীতির জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমাজকল্যান দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করে এবং সমাজে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন বিপন্ন হয়।
দুর্নীতি কোনো সমাজের বা কোনো পরিবেশের জন্যই কাম্য হতে পারে না।
তথ্যসূত্র :
০১.০৯.২০০৭ তারিখে জাতিয় প্রেসক্লাবে বাতেন শাইখের দুনর্ীতি প্রতিরোধ আন্দোলন ও দ্বিতীয় মুক্তি সংগ্রামের ডাক শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে।
Alatas, Sayed Hussein, The Sociology of corruption: The Nature , Fuction, Causes and Prevention of Corruption ( Singapore; Times Books, 1980:p-9)
Philip, Mark 1997: 26
Malinowski, Bronislaw, Argonauts of the western Pacific, New York: Dutton & Co. Inc 1961 (1922)
(চলবে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।