কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর! টেলিফোনটা অনেকক্ষন থেকেই বেজে চলছে কিন্তু কেউ ধরছে না,মিলনের মা কয়েকবার শব্দ শুনে রুমে এসে চলে গেছেন,অবশেষে মিহিক বেরিয়ে এলো নিজের রুম থেকে,মায়ের রুমে রাখা টেলিফোন টা রিসিভ করতে এসে দেখে সেটের পাশেই মা বসে আছেন,খুব অবাক হয় মিহিক!! কোন মানে আছে এর?ফোন বাজছে অথচ পাশে থেকেও ধরছে না,কিছু বলতে যেয়েও থমকে দাড়াল,রং নাম্বারের ফোন নাতো...?তাহলে অফ করে রাখলেই হয়,একটু বিরক্তি গলায়ই বলল,
;আম্মু,কি ব্যাপার ফোন ধরছ না কেন?
কোন কথা নেই মিলির মুখে,এক মনে পেপার পড়ছে সে। আবার বলল মিহিক,
;আম্মু কি হইছে ?তুমি ফোন ধরছ না কেন?!!!
এবার ও কোন বিকার নেই মিলির চেহারায়,মিহিক তা দেখে মহা ক্ষেপে গেল,
খুব জোরে কিছু বলতে নিল ঠিক তখনই মিলি ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
;তোর ক্লাসে যাওয়ার ভাড়া ডাইনিং টেবিলের ক্লথ এর নিচে রেখে দিয়েছি আজ গাড়ি নেই আসার সময় তোর বাপী নিয়ে আসবে এ্কসাথে আসিস,এখন যা দেরি হয়ে যাবে নাহলে।
খুবই অবাক হল মিহিক,মায়ের এমন ব্যাবহার দেখে!এমন করার মানে কি?...
আবার ফোনটা বেজে উঠল,এবার ফোনের দিকে তাকালো মিলি,এক দৃষ্টিতে,যতক্ষন ফোন বাজল ততোক্ষন তাকিয়েই থাকল,আস্তে আস্তে মিলির বড় বড় চোখে অশ্রু জমা হতে লাগল,একটা সময় ফোন বাজা বন্ধ হয়ে গেল,আর মিলির চোখ থেকে ঝরে পড়তে লাগল নীরব অশ্রু ধারা...রিসিভারটা কানে লাগালো শুনতে পেল বড়পার গলা,
;মিলি,প্লিজ একবার আয়,মাহিন খুব খুশি হবে অন্তত আদরের ছোট ভাইটির এমন খুশীর দিনে তুই আয়...
;বললাম তো বড়পা,আমি আসব না,সন্ধায় মিহিক যাবে,রাখি...
অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে লাই কেটে দিল । অঝোরে ঝরতে লাগল অশ্রু ঠিক সতের বছর ধরে যেভাবে ঝরছে..
মিলির বাবা মজিদ সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। ছয় মেয়ে দুই ছেলের জনক।
অবসর নেয়ার পর বড় ছেলে মুহিবকে নিয়ে ব্যাবসা করছেন,তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন,তার চার নম্বর মেয়ে মিলিকে তিনি আর সব ছেলে-মেয়েদের থেকে একটু বেশি আদর করেন তিনি,এই মেয়েটা সব সময় বাবা-মাকে অনুসরন করার চেষ্টা করে। মনে মনে এই মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তিনি,অনেক বড় হবে তার এই মেয়ে,তার বাকি মেয়েরা সবাই গৃহিনী তিনিও চান এই মেয়েও আদর্শ গৃহিনী হোক তবে তার মনে হয় এই মেয়ে চাইলে আরও অনেক কিছু হতে পারবে।
প্রতিদিনের মতো সেদিন ও সকালে নামাজ পড়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন,আজ একটু চি্ন্তিত তিনি তার তৃতীয় মেয়ে মায়া কাল রাত থেকে হাসপাতালে দ্বিতীয় বারের মতো মা হবে মায়া,মায়ার স্বামী তারেক একজন বড় ব্যাবসায়ী,তরুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী হিসেবে সমাজে পরিচিত। মায়ার মা কাল বিকেল থেকেই মায়ার পাশে আছেন,শেষ রাতের দিকে ছেলে হয়েছে মায়ার কিন্তু মায়ার অবস্থা বেশি ভাল না,কোন ভাবেই ডাক্তার রক্তক্ষরন বন্ধ করতে পারছেনা খুবই চিন্তায় আছে সবাই,ডাক্তার কোন আশার বাণী শুনাতে পারছেন না,চিন্তা করতে করতে বাসায় ঢুকলেন তিনি,মিলি চা বানিয়ে বাবার সামনে রেখে বলল,
;বাবা,একটা কথা বলার ছিল।
মজিদ সাহেব মিলির মুখের দিকে তাকালেন,চোখ দুটো ফুলে আছে,চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে বোনের জন্য,তার বুকটা যেন কেমন করে উঠল অজান্তেই...কাঁপা গলায় বললেন,
;বল
;বাবা,আমি কার শেষ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি,দেখলান,মায়া আপু খুব সুন্দর করে সেজে গুজে কোথায় যেন যাচ্ছে,আর আমরা সবাই একসাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছি...আমার কোলে ওর ছোট ছেলেটা আর আম্মুর কোলে মিশুক...স্বপ্নটা কেমন অদ্ভুদ তাই না বাবা? ভেতরে ভেতরে খুব অবাক হলেন মজিদ সাহেব!এই একই স্বপ্ন কাল রাতে উনি নিজেও দেখেছেন,মিলিও দেখেছে তার মানে...যা মনে মনে ভাবছেন তাই কি সত্যি হবে...?!অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল... কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি ।
অবশেষে তাদের বাপ-মেয়ে দুজনের আশংকাই সত্যি হল,বেলা দশটার দিকে ছোট দুটি অবুঝ শিশু,আর স্বামী সংসার রেখে চলে গেল মায়া । অনেক কষ্ট হয়েছে মজিদ সাহেবের সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে কিন্তু কিছুই করার ছিল না।
আজ প্রায় পনের দিন হল মায়া আপু চলে গেছে,এই পনের দিন মনে হয়েছে ঝড়ের বেগে কেটেছে । তারেক ভাই পাগলের মতো কেঁদেই চলেছেন,অন্যদিকে অবুঝ শিশু দুটো কে সামলাতে ব্যাস্ত মিলি আর ছোট বোন মীম। বাচ্চা গুলোর মুখের দিকে তাকালে বুক ফেঁটে কান্না চলে আসে মিলির ।
কি থেকে কি হয়ে গেল,মনে হচ্ছে এই সেই দিন মায়া আপুর বিয়ে হল মহা ধুমধামে,কত সুখের সংসার ওর,দেখতে দেখতে মিশুকের জন্ম হল তার বছর দুয়েকের মাথায় এলো মিহিক কিন্তু চলে গেল আপু,চার বছরের সংসার,কত শত ঘটনা এখন সবই স্মৃতি...। বড়পা আর মেঝপার একটু আগে বিয়ে হওয়াতে মায়া আপুর সাথেই বেশি ভাব ছিল মিলির,সুখে দুঃখে সব সময়ই ভাল বন্ধুর মত একসাথে থেকেছে,খুব কষ্ট হচ্ছে মিলির মায়াপুর চলে যাওয়া মেনে নিতে,কিন্তু কি আর করা... দুপুরের দিকে মীমের কাছে বাচ্চা দুটোকে রেখে কোচিং এর উদ্দেশ্যে বের হল মিলি,সামনে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা ওর,এ কয়দিনে অনেক পড়ার গ্যাপ হয়ে গেছে । রেডী হয়ে মায়ের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ থমকে দাড়াল মিলি,ধীর পায়ে দরজার কাছে এসে দাড়াল...
;এসব তুমি কি বলছ মীরার মা। এ কি করে সম্ভব?!ওরা বললেই হল? না না এ কখনই হবার নয় তুমি ওদের বলে দাও
;না ভেবে আমি বলছিনা,তুমিই বরং ভালো করে ভেবে দেখ,তুমি মেয়ের বাবা হয়ে কি করে পারছ না করতে?এমনতো না যে আমরা আমাদের মেয়েকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছি,যা করছি তাতে সে সুখীই হবে,হয়ত এখন একটু সময় লাগবে কিন্তু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
;কি ঠিক হবে?মিলি কো্নদিনই পারবে না তারেকের সাথে এ্যাডজাস্ট করতে তার উপর ছোট দুটো বাচ্চা,আর মিলির বয়সই বা কত,এখন কি সময় ওর ছোট ছোট দুটো বাচ্চার দায়িত্ব নেবার?
;তাহলে কি বসে বসে মায়ার সংসার শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে বল আমাকে? তুমি পারলেও আমি তা পারব না,আর মিলি পারবে না কে বলল একটু চেষ্টা করলেই পারবে,তাছাড়া আমরাতো আছিই,আমি চাইনা মায়ার সংসারে অন্য কোন মেয়ে আসুক,তারেকদের বাসার কেউও তা চায় না।
;কিন্তু মিলির কি শখ আহ্লাদ বলে কিছু নেই?ওর নিজের ওতো কত স্বপ্ন থাকতে পারে,তুমি নিজেওতো ওর বয়সে ছিলে তুমি কি সব না দেখতে বল?
এবার একটু চুপ হয়ে গেলেন মিলির মা। দরজার পাশে দাঁড়ানো মিলি ততোক্ষনে কি এক রাগে কাঁপতে লাগল যেন কোন রকমে টলতে টলতে নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিলি । সারা দুনিয়াটা কেমন যেন ঝাপসা মনে হতে লাগল,মনে হতে লাগল খুব জোরে একটা ঝড় হোক,প্রবল সে ঝড়ে সব শেষ হয়ে যাক। কিন্তু কোন ঝড় হলো না,শুধু হারিয়ে যেতে লাগল এত দিন ধরে আগলে রাখা সব কিছু,সব স্বপ্ন,সব পাওয়া...বুক ভাঙ্গা সে কান্না দেখে সান্তনা দিতে আসেনি কেউ,কেউ পরম আদরের হাত বুলিয়ে বলেনি,''কাঁদিস না সব ঠিক হয়ে যাবে''।
দেখতে দেখতে পাড় করেছি একটি মাস,কতবার মনে হয়েছে আত্নহত্যা করি শেষ করে দেই নিজেকে,কিন্তু পারেনি মনের ভেতর ভেসে উঠেছে মায়া আপুর হাসিমাখা মুখখানি,কচি দুটো বাচ্চার ছবি ।
এভাবেই কি মায়া আপু ওর দেয়া এতদিনের ভালোবাসার প্রতিদান নিল? একমাস নিজেকে একটা ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে অথচ একটা মানুষ ও এসে বলল না,''মিলি,আমরা এ হতে দিবনা''কাছের মানুষগুলো কি এভাবেই পর হয়ে যায়?একদিন বাবা এসেছিল অনেক্ষন পাশে বসে থেকেছেন কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি,অবশেষে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন,''আমাকে মাফ করে দিস মা,আমি আসলে তোর অনেক অযোগ্য বাবা,আজকে মেয়ের জীবনের এমন কঠিন সময়ে বাবা হয়েও কোন কিছুই করতে পারছিনা...''।
একমাস পর আঠার বছরের সব আশা-আকাঙ্খা,আর শখ গুলোকে কবর দিয়ে জীবন সাথী হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল আটত্রিশ বছরের দুলাভাইয়ের পাশে । নাহ,এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না মিলির,পরিবার,বোনের সংসার আর বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু ত্যাগ করতে হয়েছিল । আর বিনিময়ে...?বিনিময়ের হিসেব আর কখনো করেনি মিলি,শুধু সব ছেড়ে মিশুক আর মিহিককে নিজের সব ভালোবাসা,মমতা উজাড় করে দিয়েছে,একই বাড়ীতে থেকেও মিলি আর মিহিকের বাবা দুই নদীর মোহনার মত পাড় করে আসছে সতেরটা বছর,বাবার বাড়ী কিংবা ভাই-বোন কারো বাড়ীই আর কোনদিন যায়নি মিলি । ওদের সুখের সংসার দেখতে ইচ্ছে হয়নি,শুধু দোয়া করেছি যেন ওরা ভালো থাকে সব সময়।
আর তাইতো আজ একমাত্র ছোট ভাইয়ের বিয়েতে সবার শত রিকোয়েস্টে ও গেলনা,ছোট ভাইয়ের বউয়ের লাজুক মুখখানা ভেসে উঠল চোখের সামনে...নাহ,জ্বালা করছে চোখ,ওর জীবনেতো এমন দিন কখনো আসেনি,ওর বধু সাজের পাশে ওর চাওয়া মতো কেউ তো ছিল না...
মায়া'পু প্রায়ই ওর স্বপ্নে আসে,কেমন যেন বিষন্ন মুখে...কখনো ওর পাশে বসে নীরবে অশ্রু ফেলে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।