Footprint of a village boy! দশ নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর, বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর | মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে, দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে | ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে, দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে | আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান | ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় | আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে | আজকে রূপার বড় কাজ---কাজ---কোন অবসর নাই, মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই | সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি, সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি | আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে, নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে | সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী, শুধু কাজ---কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি | সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান, কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান | আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা, ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা | কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ; এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো! আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই, পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই! অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা, বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা | দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি, ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি | কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান, কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান | হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি, টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি | এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা, গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া! রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে, বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে | আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি, শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী | সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি, ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি | নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে, দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে! নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর, সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়! বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ, তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ | সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী, মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি! ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার, "পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |" রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে, "ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |" বউ রাগ করে, "দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে, কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে | ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী, সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি | দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল, আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |" বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার, কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার | কহে জোড় করে, "শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি, মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি | আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল, সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের---ভোরে হাসিবে না ফুল! এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী, এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!" হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে, কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে | বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি, "বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?" পুনঃ জোর করে রূপা কহে, "এই অধমের অপরাধ, ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!" রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি, কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি | পরে কহে, "দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে, এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!" বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার, "আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার? এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর," তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর! দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, "এরি মত, তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |" চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে, ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে | এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি, বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি | সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে, তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে | তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে, বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে | কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি, মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি | ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল, রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল! হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি, এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি! ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল, সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল! বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে, উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে | ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে, বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে | "ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল? একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল? ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?" বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল! বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে, "শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!" "সে দূর কোথায়?" "অনেক---অনেক---দেশ যেতে হয় ছেড়ে, সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে | তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে, যাই---যাই---ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে | বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!" "নয়! নয়! নয়!" বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল | রূপা কয় "শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর, তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর | তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু, আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু | আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই, তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |" এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে, ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে | এগার "ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে? বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |" "কি বলিলা বছির মামু ?" উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া, আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া | পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে, বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে! লম্ফে রূপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা, ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা | কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা, সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া! বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর-গাঁয়ে, এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে? "আলী-আলী" হাঁকল রূপাই হুঙ্কারে তার গগন ফাটে, হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে! ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি ; ডাক শুনে তার আসল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা, আসল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আঁচড় দিয়া | আসল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পড়ি, এক নিমেষে গাঁয়ের লোকে রূপার বাড়ি ফেলল ভরি | লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে, এক লাঠিতে একশ লোকেরমাথা যে জন আস্ ল দলে | দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী, গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি | গর্জি উঠে গদাই ভূঁঞার ; মোহন ভূঁঞার ভাজন বেটা, যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা | সব গাঁর লোক এক হল আজ রূপার ছোট উঠান পরে, নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ-খেলানো বাঁশীর স্বরে! রূপা তখন বেরিয়ে তাদের বলল, "শোন ভাই সকলে, গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে |" বছির মামু বলছে খবর---মোল্লারা সব কাসকে নাকি ; আধেক জমির ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায় : আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায় |" থামল রূপাই---ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া, নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া | গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ায় লাঠি, রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি | রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, "থাল বাজারে থাল বাজারে, থাল বাজায়ে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে | হানরে লাঠি---হানরে কুঠার, গাছের ছ্যন্ আর রামদা ঘুরা, হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয় রে তোরা |" "আলী! আলী! আলী! আলী!!!" রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি, ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি | তারি সুরে সব লেঠেল লাঠির, পরে হানল লাঠি, "আলী-আলী" শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি | আগে আগে ছুটল রূপা---বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে, কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে | লল পাছে হাজার লেঠেল "আলী-আলী" শব্দ করি, পায়ের ঘায়ে মাঠের ধূলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি! চলল তারা মাঠ পেরিয়ে, চলল তারা বিল ডেঙিয়ে, কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে | চলল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়, বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূল্ পথ ভরি হায়! দুপুর বেলা এল রূপাই গাজনা চরের মাঠের পরে, সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে! লম্ফে রূপা শূণ্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে, থকল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে | মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে, "আলী! আলী!" শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে | হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় "আলী আলী হজরত আলী," সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি! তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান, "আলী আলী" শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান! সামনে চেয়ে দেখল রূপা সার বেঁধে সব আসছে তারা, ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া | রূপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে, তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও ইটে নানান কলে | এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন রূপা বলে, "এমন করে "কাইজা" করা হয় না কখন |" তাল ঠুকিয়ে ছুটল রূপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি, "আলী-আলী --- হজরত আলী" কণ্ঠ তাদের যয় যে ফাটি | তাল ঠুকিয়া পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে, লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে | "মার মার মার" হাঁকল রূপা, --- "মার মার মার" ঘুরায় লাঠি, ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি | আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে, জীবনের এক সত্য মহান্ লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে! মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে, মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে | নাচে রূপা---নাচে রূপা--- লোহুর গাঙে সিনান করি, মরণরে সে ফেলছে ছুড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি | নাচে রূপা---নাচে রুপা---মুখে তাহার অট্টহাসি, বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি | ---হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন, কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধতে নারে তারি মাতন | বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু, রূপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাসছে লোহু | বার রূপাই গিয়াছে ‘কাইজা’ করিতে সেই ত সকাল বেলা, বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকার মেলা | কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ, তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ! বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া, আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই ? নেচে ওঠে তার হিয়া | এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়াবে হাত, কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাৎ | আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে না সে ত ও নয়, আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয় | লোহুর সাগরে সাতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা, রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা | পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শত গুণ, রাত এসে তা ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন! ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা, সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা | পাতায় পাতায় খস্ খস্ খস্, শুনে কান খাড়া করে, যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে | তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার ; আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার | কেন আসে নারে! সাজুর যদি গো পাখা আজ বিধি, উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি | নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল, প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল | আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি, এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি | দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে---রূপাই আসিছে বটে, ”এতক্ষণে এলে ? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে | আর জাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো, তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো |” রূপাই কহিল কাঁদিয়া, “বউগো ফুরায়েছে মোর সব, রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব | লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে, আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে | লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী, বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি! আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানতাম, হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম !” বউ কেঁদে কয়, “কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা, দেখি ! দেখি !! দেখি !!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝু তার ব্যথা !” “লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়, তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়! তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার, তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর | আজ ‘কাইজায়’ অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু | এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রহিছে লহু | থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি, খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি | সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা-তথা, আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা | আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়, যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়! হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক, সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ | ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি, বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি! ভাই থাকিলেও ভাইয়ের বউরে রাখিত যতন করি, তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি | আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা, এযে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা!” সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি, হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি | সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া, এ পোড়া রূপেরে কি দিয়া ঢাকিব---ভেবে মরে মোর হিয়া | তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে, তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্ খানে!” রূপা কয়, “সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই, সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই | মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে, তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে |” এমন সময় ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি, রূপা কয়, “সখি! যাই---যাই আমি---রাত বুঝি নাই বাকি!” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায় ; সাজু কয়, “ ওগো শোন, আর কি গো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন ? দীঘল রজনী---দীঘল বরষ---দীঘল ব্যথার ভার, আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার ?” রূপা ফিরে কয়, “না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর, ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার |” “এই শেষ কথা!” সাজু কহে কেঁদে, “বলিবে না আর কিছু ?” খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু, “মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে, দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে | সিন্দুরখানি পরিও ললাটে---মোরে যদি পড়ে মনে, রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে | মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল, আলসে হেলিয়া খোপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল | যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে---না শুনি আমার বাঁশী, বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি | চেয়ো মাঠ পানে---গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান ; কান পেতে থেকো, যদি শোনো কভু সেখায় আমার গান | আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া, মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!” ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে, দিনের তরণী পূর্ব-সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে | রূপা কহে, “তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আধার বাকি, তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি |” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায় ; সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতল বায় | তেরো একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি, দিনে দিনে নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি | কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁয়, তারা ফিরিয়াছে বাড়ী, শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি | স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে, তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে | একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত, প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত | ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়, খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায় | প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি, তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি | রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ | কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ, কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান! কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন, মনের-মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙালী” হেন ? সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা, দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা | কোন্ জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তায় কড়ি, তারি অভিশাপ ফিরেছে কি তার সকল পরাণ ভরি ! কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে, তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে ! তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি কোন্ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি | নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা, যে ব্যাথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা ? এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে, আমেনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে | কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে---দুপুর কাটিয়া যায়, সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়ে | তবু ত আসে না ! বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে, পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে | মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে, রূপারে তোমরা দেখেছ কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে | গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়, কোন দিন কিগো রূপাই তাদের চক্ষে পড়ে নি হায় ! খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে, রূপাই কোথাও পলাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে | ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার | জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ, যখন যখানে যাও, রূপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও |” বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে, বুড়ী ডেকে কয়, “রূপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে !” বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা, কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা | চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে, মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে | সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে, তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে ; “তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে, নিটল তাহার গঠন গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে |” এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,--- রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয় ! যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়, তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায় ? কেউ কেউ বলে, “তাহারি মতন দেখেছিন একজনে, আমাদের সেই ছোট গাঁয় পথে চলে যেতে আনমনে |” “আচ্ছা তাহারে সুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী, পরদেশে সে যে কোম্ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি ?” গাঙে-পড়া-লোক যেমন করে তৃণটি আঁকড়ি ধরে, তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে | মিথ্যা করেই তারা বলে, “সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে, খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে |” এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা, মুহুর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা | মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে, “ভাবিস না মাগো আর, বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোর---খবর পেয়েছে তার |” মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে ; কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে | গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস, বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস | আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা, ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা | আজকে কত না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীনে, সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে বদনা-বিয়ের দিনে | তারপর সেই হাট-ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে, ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে | নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে যে দিত আনি, সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি | সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে, কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে ; তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জালে জড়াইয়া টানে, যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে | আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে, ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানক মুকুতা মাঙে | এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ, এতটুকু হাসি খেলা, তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা ! হায় অভাগিনী ! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল, তারাই আজিকে ভুজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল | যে বাঁশী শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি, দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী | মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী--- “মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি |” আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই, সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই |” হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ; সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন | গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে, পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে | হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ; কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা | হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে, আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে ! দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা, পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা | হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি, আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি | সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস, বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস | নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি, ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি | অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা, তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা | এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন, কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন | স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ; গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে | সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই, সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই | খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি, খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি | আঁকিল কাঁথায়---আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী, দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি | আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে, বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে | এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে, তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে | তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে, এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে | কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ; শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার | হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও, এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও ! ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম, দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম ! মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি, তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি ! সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা, ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা ! একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে, শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |” পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে, আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে | কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি, তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ; রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে, অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে | মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি, দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি | দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি, “সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ; এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে, ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে ! সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল, জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল | হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে, হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে | এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে, তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে | মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই, আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই ! মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে, জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |” বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা, অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা | কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়, “সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?” “আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে, “দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !” দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি, উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !! “সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে, তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !” দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে, রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে | চৌদ্দ আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে | মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি, ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি! নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি, কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি ! বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান, মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান! সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে, মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে! মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল, এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল | লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে, বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে | তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে, কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে | মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ; সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ! এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ, যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা | সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি | বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা, খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা | রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে, তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে | মরিবার কালে বলে গিয়েছিল --- তাহার নক্সী-কাঁথা, কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা! বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে, শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে | প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়, রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়! শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী, রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি! সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,--- আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা | কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,--- মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ; হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে, তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে | সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ, ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ |
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।