যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
অনেক দিন অন্ধকারে থাকতে থাকতে সুরত আলী অনেকটা মাকড়সা টাইপের হয়ে গেছে। ছোট্ট ঘরের মধ্যেই নিজের জাল বিছিয়ে থাকে। গতি মন্থর। এক জায়গায় স্থাণুর মত বসে থাকে।
খুব সামান্যই পিলপিল করে এ কোনায় ও কোণায় হাঁটে। মানুষ আর মাকড়সার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে হলে বলতে হবে,সুরত আলী অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ দুটো ঠিক আলো সহ্য করতে পারে না।
দিনকাল ভালো না, বাইরের আতণ্ক সুরত আলীকে খুব ছোট করে ফেলেছে। মাকড়সার মত সরু পেট। কাঠি কাঠি হাত পা।
চেহারায় লাবণ্যহীন খসখসে ভাব। চেহারাটা মাকড়সার মতই বিশ্রী।
দেশটাতে একবার যুদ্ধ হয়েছিল, তখন খুব সাহস ছিল সুরত আলীর। কারণ শত্রুগুলো ছিল চেনা। বিদেশ থেকে আসা কিছু ভাড়াটে খুনী আর তাদের সহযোগী, দেশের ভেতরের কিছু জানোয়ার।
ওই মানুষ খেকো হায়েনা আর শকুনেরা ছাড়া সবার কাছে পৌঁছানো যেত। ক্ষুধা, তেষ্টা কিম্বা গল্প করার জন্য তখন মানুষ পাওয়া যেত।
নিজের বারান্দায় গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে, দেখেছে বউটা লাল শাড়ির মত বারান্দার গ্রীল ধরে ঝুলে আছে। রোদে জ্বলে জ্বলে বুকের ক্ষতটা কটকটে লাল।
বউটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুদল রাজার লোকেদের শ্লোগান শুনছিল।
ওরা বলছিল,"-------রক্ত বৃথা যেতে দেব না। " দুদলের মারামারিতে বেশী নয়, একটা বুলেট বউটার বুক চিঁড়ে বৃথাই বের হয়ে গেল। কত রক্ত যে বারান্দা ছাড়িয়ে মেঝেতে এসে থকথকে কাদার মত জমে রইল, সে আর কেউ দেখল না। অযথাই বউটা লালপেড়ে শাড়ির মত লটকে রইল বহুকাল।
৭১ এ নিজের শত্রুদের বিচার সুরত আলী নিজের হাতে করেছিল।
এখন আর পারেনা। এখন অনেক মানুষ। সুরত আলী হিসোব শুনেছে, ষোল কোটি মানুষ সবাই এরা সবার শত্রু, সবাই সবার বিচার করে।
বছর দুয়েক আগে সুরত আলী রাস্তায় নেমেছিল,হাঁটতে পারেনি। থিকথিকে ময়লা আবর্জনার মত মানুষের ভিড়।
শ্যেন দৃষ্টিতে লোকগুলো সুরত আলীকেই দেখছিল। সুরত আলী চলতে চলতে অজানা শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাঙ্কারের মত অনেক গর্ত দেখেছিল, একবার ভেবেছিল লুকিয়ে পড়ে কিন্তু মানুষের বর্জ্য থাকায় আর ঢুকতে পারেনি।
একটা শিশু বাবার আঙ্গুল ধরে কি সুন্দর করে হাঁটছিল। কাঁধে নীল ব্যাগ। পরনে ঝকঝকে সাদা শার্ট।
হঠাৎ গর্তটায় হারিয়ে গেল। বাবা'টা কাঁদতে কাঁদতে ঝুঁকে ঝুঁকে কি বাচ্চাটাকে খুঁজছিল- সুরত আলী এক ঝটকায় বাবা'কে সরিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিল--মানুষের বর্জ্যে ভেসে যাওয়া বাচ্চাটা পাওয়া যায় কিনা!পুতি গন্ধময় গর্তটায় নাক চেপে সুরত আলী উপুর হয়ে ছিল, হঠাত একদল লোক চোর চোর বলে, লাঠি হাতে এগিয়ে এল। কেউ কেউ সুন্নতি দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সফেদ পাঞ্জাবিতে ছিল, মাথায় টুপি, চোখে সুরমা। কারো কারো পরনে ম্লেছদের মত শার্ট-প্যান্ট। কারো পরনে রাম-মন্দিরের পুরোহিতের মত ধূতি ছিল কারো কারো।
দু-একজন খাকি পোষাকেও ছিল। আশ্চর্য হল, যখন দেখল সবার লাঠির রঙ হুবহু এক ।
সুরত আলী আতঙ্কে উপুর হয়েই ছিল, কিন্তু বাচ্চার বাবাটা এক ঝটকায় ঢ্যাঙ্গা সুরত আলীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েই বলল, "পালাও পালাও। "
সরু সরু হাত-পা নিয়ে পালাতে পালাতে সুরত আলী দেখল, লোকগুলো বাবাটাকে পিটিয়ে মতিচূরের লাড্ডু বানিয়ে ফেলেছে। লাল ছোপ ছোপ রক্তে মানুষটাকে দূর থেকে লাড্ডুর মতই লাগছে।
লাড্ডুর কথা ভাবতে ভাবতে সুরত আলীর ক্ষুধাটা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বাজারে ঢুকতেই দেখল সব খাঁ খাঁ করছে। বাজারে নাকি আগুন। কিছু মানুষ ভয়ে পালিয়েছে আর কিছু মারা গেছে। ঐ যে যারা মাছ-ভাত, শাক আর ফল খেয়েছিল অনেক অনেক বেশী, যারা বাজারের আগুনকে ভয় পেত না, তারা প্রচুর ফর্মালিন খেয়েছিল সাথে ইউরিয়া সার আর অনেক বর্জ্য।
তারাই মরেছে। যারা খেতে পারেনি, তারা বাজারের আগুনের ভয়ে পালিয়েছে।
বাজার ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় উঠল সুরত আলী। শুনেছে মানুষ মরছে আকছার, কিন্তু কত মানুষ মরছে তার হিসেব জানে না সে। বিস্তর মানুষ যে বেঁচে আছে, এটাতে সে নিশ্চিত।
নাহলে এত গাড়ি আসবে কোত্থেকে। পিল পিল সারি সারি গাড়ি কার আগে কে যাবে, অনেক ঠেলাঠেলি। এগুলো ভর্তি শুধু গিজগিজে মানুষ।
রাস্তাটা পার হতে গিয়ে একটা ট্রাক সুরত আলীর গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। একটুর জন্য বেঁচে যাচ্ছিল, কিন্তু ট্রাকটা পিছিয়ে এসে আবার চাপা দিল সুরত আলীকে।
রাস্তায় লোক জমে ছিল, কর্পোরেশনের আবর্জনার মত। কিছু লোক হই হই করে ছুটলো ট্রাকের পেছনে। কিছু লোক ছুটলো মিডিয়াকে খবর দিতে। অনেক অনেক মানুষ। এক কাজ সবাই করে।
মানুসের হাতে অফুরন্ত সময়। কিছু লোক বিলাপে বসল। কিছু লোক হাতড়াচ্ছিল, সুরত আলীর পকেট। রাজা-গজাদের গাড়ি হুইসেল দিতে দিতে আগে এল। পেছনে জনস্রোতে, গাড়ির স্রোতে আটকে রইল প্রাণ রক্ষাকারী গাড়ি।
তার পোঁ পোঁ আর্তনাদ সুরত আলী দূর থেকেই শুনল।
এসব দেখতে দেখতেই সুরত আলী কেমন মজা পেয়ে গেল। নিজের লাশটাকে উতসাহী মানুষের কাছে জমা রেখে সে একছুটে পালিয়ে এল। নিজের বাড়িতে ঢুকতেই দেখল, তার আগেই পৌঁছে গেছে একটা দল। সে মরেছে শুনে-মানুষগুলো মচ্ছপ করছে।
বউটার কটকটে লাল থকথকে রক্ত দলে ওরা পাক হানাদারদের মত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুলছে, বাক্স-পেটরা।
সুরত আলী ভয়ে দরজা দিয়ে না ঢুকে দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল। এ ঘরে ভেন্টিলেটর নাই। এক টুকরো ফুটো ছিল সিলিং এ তাও পাশের বাড়ির দেয়াল দিয়ে ঢাকা। বদমাশ গুলো যাবার আগে, ঘটাং করে পুরোনো দরজাটা আটকে দিয়ে গেল।
সুরত আলীর আর পালানোর পথ রইল না।
সে এ শহরে আর পালাবে কোথায়, সেই অবধি ১৩ নাম্বার রোডের ২৩ বাড়িতে সুরত আলী একাই থাকে। একা একা অনেক ভেবে দেখেছে সুরত, মানুষকে সে ঘৃণা করেনা-আসলে মানুষকে সে ভয় করে।
ইদানীং সুরতের একটা রোগই ধরা পড়েছে, সেটাকে ডাক্তারেরা বলছে,"মানবাতঙ্ক"। যখন রোগের বাড়াবাড়ি দেখা যায়, তখন সুরত একা ঘরে অন্ধকারে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদে।
সুরত তার ঝাপসা চোখে দেখতে পায়, এ শহরের মানুষগুলো তার মতই আটকে আছে, মানবাতঙ্কে অথবা মাকড়সার জালে। সুরতের তবুও অন্ধকার সিলিং আছে, এরা পালাবে কোথায়? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।