মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে প্রথমেই বলে নিই যে এটি মূলত একটি সমন্বিত রিপোস্ট এবং যে কারণে এই রিপোস্ট - তার কারণ হল অন্য একটি ব্লগের লেখক ইমরান০০৭ ভাই কর্তৃক আমাকে দীর্ঘ মন্তব্যের পরিবর্তে আলাদাভাবে লিখে লিংক প্রদানের অনুরোধ। যদিও লেখকের সেই ধারাবাহিক লেখার প্রথম অংশের পুরোটাই আমার আগের ব্লগে মন্তব্য হিসেবে এখনো লিখা আছে [যেটি অন্য তৃতীয় একজন ব্লগার মুহসীন৮৬ ভাই সম্পূর্ণ Copy-Paste করেছিলেন এবং বেশ বিভ্রান্তিকরভাবেই, যার প্রেক্ষিতে সেইসময় ঐ প্রথম অংশটির প্রকৃত উৎসের সন্ধানে বেশ খোঁজাখুঁজি শেষে আমি লেখকের ব্লগে গিয়েছিলাম]।
তারপরও বলব যে ব্লগে সেরকম কোন পূর্বশর্ত/পূর্বসতর্কতা না থাকায় অন্তত প্রথমবার হিসেবে মন্তব্যটুকু না মুছলেও হতো। ভবিষ্যতে ছোট আকারে মন্তব্য লেখার এই বিশেষ অনুরোধ আমার খেয়ালে থাকবে। পরবর্তীতে লেখককে বলেছিলামও যে ঐ সময় point by point খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সেই অনু্যায়ী জবাব লিখতে গিয়ে অমনটা হয়েছিল।
পরিশেষে নিচের প্রশ্নটিও রেখেছিলাম [আমার একটি প্রিয় উদ্ধৃতিসহ] – যার উত্তর এই লেখাটি লেখা পর্যন্ত যে কোন কারণেই হোক আর পাওয়া হয় নি।
[প্রশ্নটি ছিল]
‘একটি বড় মন্তব্য যদি ভাগ ভাগ করে ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট পাঁচ-ছয়টি মন্তব্যের মধ্য দিয়ে লিখিত হয় [যেটি প্রায় সময়ই করা হয় এবং এখানেও (অর্থাৎ সেখানে লেখকের ব্লগে করা অন্যান্য কমেন্টগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এমনটা বলা) ইতোমধ্যে করা হয়েছে], সে ক্ষেত্রে কি কোন আপত্তি আছে?’
[এবং উল্লেখিত সেই প্রিয় উদ্ধৃতি]
“I have only made this letter longer because I have not had the time to make it shorter.”
-- Blaise Pascal
যাই হোক, কোন উত্তর না পেলেও নিঃসন্দেহেই এই রিপোস্টটি সেই ব্লগটির লেখক ইমরান০০৭ ভাইকে পড়ার অনুরোধ থাকবে।
আমার ঠিক আগের লেখাটির শিরোনাম - “জাফর ইকবাল স্যারের একটি মন খারাপ করা কলাম ও ঝানু রাজনীতিবিদদের শর্ট টার্ম মেমোরি লস্”
এবং লেখার শিরোনামের সার্থকতা রক্ষার্থে নিচের *স্প্যাশাল* ছবিটি সেখানে দিয়েছিলাম, ছবিটিতে এ দেশে প্রচলিত নির্লজ্জ নোংরা দ্বিমুখী (ত্রিমুখী, চতুর্মুখী বা আরো বেশিও হইতে পারে!) রাজনীতির ব্যাপারটি নগ্নভাবেই স্পষ্ট।
সুতরাং যার বক্তব্যের জের ধরে সবখানে এত ক্যাঁচাল বাধলো, দেখা যাচ্ছে সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নিজেও ভালই বোঝেন-জানেন এদেশে আদিবাসী বলতে আসলে কাদের বোঝানো হয়, কিন্তু রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই!!
এখন মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
লেখকের দেয়া সেখানকার রেফারেন্সগুলোতে হয় কোথাও এরকম বলা হয়েছে যে,
আদিবাসী হতে হলে আগে আসতে হয় – নয়তো তারা আদিবাসী না!! [অথচ মূল ব্যাপার যে মোটেও এইরকম না তা একটু পরেই দেখবেন];
আবার হয় কোথাও শুধু এটুকুই বলা হয়েছে যে – ‘Hill tribes’/‘tribal people’রা এ দেশে আগে আসে নি [অথচ এজন্য আদিবাসী হিসেবে তাদের কিন্তু অস্বীকারও করা হয় নাই; এখানে নিচে Wikipedia-তে উল্লেখিত "hill tribes"/ "tribal group" শব্দগুলো একবার বিশেষভাবে খেয়াল করে দেখুন]
এখন এখানে Wikipedia-তে দেখুনঃ
Wikipedia_Link
Origins of phrase:
Because of the varied and changing contexts in which Indigenous Peoples live and because there is no universally accepted definition of “Indigenous Peoples,” this policy does not define the term. Indigenous Peoples may be referred to in different countries by such terms as "indigenous ethnic minorities," "aboriginals," "hill tribes," "minority nationalities," "scheduled tribes," or "tribal group."
সাধারণভাবে এদের সবাই "Indigenous Peoples"
এখন দেখুন - জাতিসংঘের মতে আদিবাসী কারা:
United_Nations_Link
Understanding the term “indigenous”:
Considering the diversity of indigenous peoples, an official definition of “indigenous” has not been adopted by any UN-system body. Instead the system has developed a modern understanding of this term based on the following:
• Self- identification as indigenous peoples at the individual level and accepted by the community as their member.
• Historical continuity with pre-colonial and/or pre-settler societies
• Strong link to territories and surrounding natural resources
• Distinct social, economic or political systems
• Distinct language, culture and beliefs
• Form non-dominant groups of society
• Resolve to maintain and reproduce their ancestral environments and systems as distinctive peoples and communities
সুতরাং, কে আগে বসবাস করল – শুধু এরকম অর্থে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘আদিবাসী’ নির্ধারিত হয় না।
আশা করি আমি বুঝাতে পেরেছি কেন এদেরকে আদিবাসী বলা ঠিক হবে।
[আর আমি এও বুঝতে পারছি, যারা আদিবাসী – তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে প্রাপ্য অধিকার দেয়া উক্ত লেখকসহ অনেকে ঠিকই সমর্থন করেন; শুধু ‘আদি হতে বসবাসকারী’ না হয়েও কেন তারা ‘আদিবাসী’ হতে যাবে – সেই ব্যাপারটুকু মানতে পারছেন না। ]
জাফর ইকবাল স্যারও কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটির যথার্থ আন্তর্জাতিক অর্থটিই গ্রহণ করে কলামটা লিখেছিলেন।
[অনেকেই আবার আমার এমন কথায় জাফর ইকবালের প্রতি সন্দেহাতীতভাবে অন্ধ পক্ষপাতিত্ব খুঁজে পান, আগের লেখাতেই তেমন অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিও। তো এখন তাদেরকে তাদের ভাষাতেই বলি - আইচ্ছা মানলাম যে জাফর লোকটা খারাপ, চরম খ্রাপ, এমনকি সে আরেকটা জাফর ঐ মীরজাফর বা রাজাকারদের বাপ গো. আযমের থেকেও অধম! কিন্তু আমি তো এখানে শুধু আদিবাসী ইস্যু নিয়েই কথা বলতেসি, আমার মূল লেখা তো চরম খ্রাপ জাফর ইকবালের বন্দনা করে লিখা হই নাই!!!]
যদি কোনভাবে একজন সেনাসদস্যও পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে মানবতাবিরোধী কাজে জড়িত থাকে, তবে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে ও পুরো সেনাবাহিনীকে খুশি করতে গিয়ে ভুলোমনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও তার সরকার দেশের অন্যতম নাগরিক সকল আদিবাসীদের অস্বীকারের যে কুটকৌশল অবলম্বন করল, বর্তমান সরকারের বিরোধীতা করে লেখা এরকম একটি বিষয় একজন অধম কলমজীবী জাফর ইকবাল ততোধিক অধম একটি পত্রিকা প্রথমালুতে লিখছে বলেই তো শুধু নাজায়েজ বা উপেক্ষিত হয়ে যায় না!!!
এখন প্রশ্ন হল - আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া হলে কী হতে পারে?
সেজন্য এখন একটু তাকান আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশগুলোর দিকে, যেখানে ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
সেখানে কি স্বায়ত্তশাসনের নাম করে আরেকটি ‘পৃথক রাষ্ট্র’ বা ‘পৃথক রাষ্ট্রের ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার’ গঠিত হতে পেরেছে, নাকি সেগুলো ‘পৃথক রাষ্ট্র’ বা ‘পৃথক রাষ্ট্রের ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার’-এর পর্যায়ে পড়ে…
আর দেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা বলতে গেলে সংক্ষেপে যা বলতে হয়, সেখানে তারাই আদিবাসী, তাদের রাজ্য-রাজত্ব ছিল বলেই রাজাও ছিল, এমনি এমনি তো আর সেখানে রাজা হয় নাই! দেশের মধ্যে অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামে তো এমনটা ছিল না যে - আগে থেকেই ঐসব পাহাড়ি অঞ্চল বাঙ্গালি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল, তারপর একসময় এইসব আদিবাসীরা সেখানে উপস্থিত হয়ে বাঙ্গালিদেরকে তাদের বসবাস ও চাষাবাদের উপযোগী করে গড়ে তোলা বসতভিটা-আবাদযোগ্য জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে!!!!!!! এভাবে বলতে বা ভাবতেও তো অদ্ভুত শোনায়, বাঙ্গালিরা তো আর আদিবাসীদেরও আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জমিজমা নিয়ে থাকতো না – যেখানে কিনা আদিবাসীদের রাজা ছিল, রাজত্ব ছিল [এখন চাইলে জাতিসংঘে বর্ণিত ‘আদিবাসী’ ব্যাপারটা আবার দেখুন – “Strong link to territories”]। পুরো বাংলাদেশের কথা তো আর বলা হচ্ছে না, শুধু একটা নির্দিষ্ট territory তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর আদিবাসীদের অপেক্ষাকৃত অধিক দাবিটুকুর কথা বলা হচ্ছে। এতে যে আরেকটা আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যায় না, সেটা আমেরিকা/অস্ট্রেলিয়ার নিজ নিজ territory-গুলোতে বসবাসকারী Red Indian/Aboriginals-দের দিকে তাকালে বুঝা যায়। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক নীতিমালার বাস্তবায়নের শাস্তিতে কি সেগুলোতে পৃথক বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে??!!! আদিবাসী বিষয়ক নীতিমালার বাস্তবায়নেই যে পৃথক রাষ্ট্র হয় না – তা কি এখান থেকেই বুঝা যায় না। আমরা তো উদাহরণ দিতে গেলে এদের কথাই বলব – যারা কিনা এখনি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত এবং সেরকম একটি System এখনি যেখানে গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হওয়ার বাইরেও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় বাঙ্গালি হিসেবে দেশে-প্রবাসে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে, এটা একটা অধিকার।
এই অধিকার যেমন কেড়ে নেয়া যায় না, তেমনি এদেশে বাংলাদেশী পরিচিতির পাশাপাশি যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে - তাদের আত্মপরিচয়ের ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেই অধিকারও কেড়ে নেয়া যায় না। তারা কী পরিচয়ে দেশে-প্রবাসে পরিচিত হতে চায়, সেটাও তাদেরই অধিকার।
রাজনীতিবিদরা যদি ক্ষমতায় যাওয়ার আগে দেশের ভেতর তাদের আদিবাসী স্বীকৃতির জন্য তাদের সাথে নিয়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে পাশাপাশি হেঁটে রেলী-সমাবেশ করে [সন্দেহ থাকলে উপরের সেই *স্প্যাশাল* ছবিটি একবার দেখুন], তারপর ক্ষমতায় গিয়ে বেমালুম সব অস্বীকার করে বসে, তাতে তো সেই অধিকার এসব ভুলোমনা রাজনীতিবিদদের বুলি বা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মতো ঠুনকো হয়ে যায় না।
অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হলে কী হয় - তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামান্য কয়েক বছরের নিজ অভিজ্ঞতাতেই আমরা তা দেখেছি, আর পার্বত্য চট্টগ্রামে তো সেই প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামল থেকে শুরু করে এই এখনও সেনাবাহিনীই একপ্রকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আছে।
সেখানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার দাপট এর মধ্যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বুঝতে এই সামান্য কিছু তথ্যই যথেষ্ট।
এখন এমনটা বলছি না যে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পুরোটাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ছিল, এবং এও বলছি না যে এই দীর্ঘ সংকট চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীতে কোন ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটে নি। কিন্তু শুধু এতেই বিনা অপরাধে যেসব আদিবাসীর উপর নির্যাতন, কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছিল ও ঘটছে - সেগুলো জায়েজ হয়ে যায় না।
আমাদের ভুলোমনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও তার সরকার কেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ভুলে গেলেন – ব্লগে দেয়া তার সেই *স্প্যাশাল ছবিটিসহ* দেখলেই বুঝা যায় – প্রত্যেক দল সরকার গঠনের পর কেন, কেমনে ও কীভাবে দেশের সেনাবাহিনীকে অপব্যবহার করেন; ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রত্যেক ক্ষমতাসীন দলের অতিরিক্ত সেনাবাহিনীপ্রীতি। আশা করি সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথাটা একটু মনে করলেই এর কারণগুলো বুঝা যায়।
এ পর্যন্ত লেখায় আশা করছি যে ‘আদি হতে বসবাসকারী’ না হয়েও ‘আদিবাসী’ হওয়ার ব্যাপারটি এখন খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায়। আর দেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা বলতে গেলে তো দেখা যাচ্ছে যে “আদি হতে বসবাসকারীরাই কেবল আদিবাসী” – ‘আদিবাসী’ শব্দটির এমন সরলীকরণেও যারা আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় বসবাস করে আসছে সেই পাহাড়ি অধিবাসীরাই ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে; যেখানে কিনা তাদের একসময় রাজা ছিল, রাজত্ব ছিল।
এখন প্রশ্ন হল আদিবাসী স্বীকৃতির জন্য বর্তমানে কেন এত দাবি উঠছে, আগে তো এমন ছিল না - এই ব্যাপারটায় লেখকের মতোই অনেকের মধ্যেও একটা সন্দেহ কাজ করে, যদিও ব্যাপারটা খুবই সাধারণ, সেটা হল শিক্ষার সাথে আত্মসচেতনতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নৃতত্ত্বের চর্চা বৃদ্ধি এবং শিক্ষায় তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় পিছিয়ে থাকা পাহাড়িরা – যাদের অধিকাংশই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রথমদিকে নিজেদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কেই ঠিকমত সচেতন ছিল না - সেই আদিবাসীদের মধ্যে উত্তরোত্তর শিক্ষার হার বৃদ্ধি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাজের দুর্বল জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের অধিকারের বিষয়গুলো সামনে আসায় এগুলোর সাথে অনেক আধুনিক ধারণা ও ব্যাখ্যাও বিবেচনায় এসেছে ও গৃহীত হয়েছে।
এভাবেই আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যেই তাদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে আত্মসচেতনতা তৈরি হয়েছে।
আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া হলেই দেশভাগ হবে - এখনও এতটা ভয় অমূলক। বরং আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে তারা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় থাকার ব্যাপারে পূর্বের তুলনায় মানসিকভাবে অনেকখানি আশ্বস্ত বোধ করবে, মূলত যে স্বকীয়তা হারানোর মানসিক ভয়েই তাদের একটা অংশ একসময় বাইরের উস্কানিতে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।
এবং এখন তারা নিজেরাও আর কোন আন্দোলনে ইচ্ছুক না বলেই এ দেশেরই সরকারের কাছে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাচ্ছে, যাতে বিচ্ছিন্ন কোন নিজ স্বাধীন রাজ্য ছাড়াই পৃথিবীর অন্যান্য স্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোর মতোই এ দেশেও আদিবাসী হিসেবে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে তারা যেন পাশাপাশি অন্য সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।
সন্দেহ করা ভাল – সতর্ক থাকা যায়, কিন্তু সবকিছুতে মনে সন্দেহ কাজ করলে তো কাউকেই আর বিশ্বাস করা যাবে না, এইভাবে একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে পারস্পরির অবিশ্বাসের চর্চা করে তো দেশের মানুষ জনমভর চলতে পারে না, পারছেও না।
লেখক এবং অন্য অনেককেই দেখা যায় - মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায়ের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেই সাথে তার পুত্র ও বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীস রায়ের উপর রাজাকার টাইপের ট্যাগ লাগাতে। অথচ এ ব্যাপারে যতদূর জানি, দুই পিতা-পুত্রের মধ্যেই আদর্শিক সংঘাত আছে – এ ক্ষেত্রে তারা পরস্পর বিপরীত। ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানে থাকার, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারগুলো আগেই জানা ছিল। কিন্তু ত্রিদিব শুধুই একজন নিরেট সামন্ত প্রভু। অত্যাচারি জমিদারদের মতো তারও চরিত্র ছিল কি না জানি না, তবে রাজপরিবার বরাবরই ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশের প্রতীক ছিল।
দরিদ্র জুম চাষীর করের টাকায় রাজপরিবারের শান-শওকত, বিদেশী প্রভুদের আশীর্বাদেই যত সহায়-সম্পত্তি; তাদের আপ্যায়ন বা উপঢৌকনের যে অর্থ রাজকোষ থেকে আসতো, তারও যোগান দিয়েছে হতদরিদ্র পাহাড়িরাই। শ্রেণীর চরিত্রের বিশ্লেষণেই শোষকের এমন রূপ পরিস্কার। এখানে বদনাম বা প্রশংসার কিছু নেই।
তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনামলেও ভৌগলিক দুর্গমতা-আর্থসামাজিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় পুরো পার্বত্য এলাকাকে একপ্রকার শাসনবহির্ভূত এলাকাই রাখতে হয়েছিল। অর্থাৎ সেখানে রাজনৈতিক ডামাডোলের হাওয়া লাগেনি শত শত বছর ধরে।
রাজাকার গো.আযমদের মতো ত্রিদিব রায় কোন বাঙালিকে হত্যা বা হত্যার নির্দেশ বা সেরকম কিছু করেছেন বলে জানা নেই। আর ত্রিদিব তো রাজাকার গো.আযমদের মতো এ দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বাড়তি কোন সুবিধাও নেন না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) জন্ম হলেও ত্রিদিব রায় কিন্তু কখনোই বাংলাদেশের নাগরিক না - পাকিস্তানের নাগরিক। কাজেই অন্য কোন দেশের নাগরিককে টেনে এখানে আনার কারণ নেই। এমন কারোর ছেলে (সেই সময়ের ১০/১১ বছরের বালক) বলে, শুধু এজন্যই কেবল সন্দেহ করে গো.আযমদের মতো এইভাবে কারোর গায়ে ওরকম রাজাকারদের ট্যাগও লাগানো যায় না।
অমূলক সন্দেহের এরকম আরো উদাহরণ আছে, একসময় বলা হতো যে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক দিলে কত কিছু হয়ে যাবে – দেশবিভক্তি, দেশ দখল, আরো কত কিছু, বরাবরের মতো সেনাবাহিনী তাতেও প্রবল আপত্তি তুলেছিল! কিছুই হয় নি, হওয়ার কথাও না। শুধু শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমতল থেকে উন্নত সেবা লাভের ক্ষেত্রে সবসময় পিছিয়ে রাখা, সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ আর ভয় - হায় হায়, এই বুঝি গেল গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন ব্যাপারে সেনাবাহিনীর বড় বড় কর্তাদের অতিরিক্ত সন্দেহের কথা তো এ পর্যন্ত বাদই দিলাম, সেই যে এক সেনাশাসক দ্বারা তথ্য নিরাপত্তার ভয়ে ‘অপটিক্যাল ফাইবার’-এ যুক্ত হবার একপ্রকার সেঁধে পাওয়া প্রস্তাব প্রত্যাখান, পরবর্তীতে জনগণের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে সংযোগ গ্রহণ, অতিরিক্ত চালাক যেন, যেন বা এইসব করে সেই চিরন্তন প্রবাদের সার্থকতা পূরণ করিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখাতে হবে – বাঙালি হুজুগে জাতি, শান্তিবাহিনী থাকতেই যখন আর হল না - এখনো এত অহেতুক ভয়, এমন অবিশ্বাসের শেষ কোথায়।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন অধিবাসীরা, যারা অনেকেই নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মূল স্রোতে মিশে যাচ্ছেন, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বহির্দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রভাবে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন – তাদেরই কেউ কেউ আজ সংখ্যালঘু হিসেবে নিজ সংস্কৃতি-মাতৃভাষা-ধর্ম, সর্বোপরি নিজেদের অস্তিত্বের সংকটের মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে আত্মসচেতন আদিবাসী হিসেবে নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। রাষ্ট্রশক্তির মারমুখী রক্ষণশীলতা বা দেশবিভক্তির এমন আরো নানা অমূলক সন্দেহ-ভয়ের কারণে তাদেরকে আদিবাসী হওয়া সত্ত্বেও এভাবে সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার তো মানে হয় না।
দেশের স্বার্থেই তাদের এভাবে হারিয়ে যাওয়া থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষা করতে হবে, তাদের উপর বহির্দেশগুলোর প্রভাব প্রতিরোধ করতে হবে। আদিবাসী স্বীকৃতি চেয়ে এরা কি আর দেশভাগ চাচ্ছে, নাকি বিশ্বের যেসব দেশে আদিবাসীরা ইতোমধ্যেই তাদের স্বীকৃতি পেয়েছে সেসব দেশ আজ আদিবাসী স্বীকৃতি দানের শাস্তিতে বিভক্ত। এরা তো আলাদা কোন রাষ্ট্র চাচ্ছে না, শুধু আদিবাসী স্বীকৃতি চাচ্ছে, যাতে রাষ্ট্রীয়ভাবেই তাদের সকল অধিকার নিশ্চিৎ হয়, বহির্দেশগুলো যেন তাদের ধর্মান্তর বা এরকম কোন কিছুতে যেন আর বাধ্য করতে না পারে।
আর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের আর্মির ভূমিকার ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই, নিঃসন্দেহে বিদেশে তাদের পারফরম্যান্স অনেক ভালো। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ বড় কঠিন মোহ তৈরি করে।
আমাদের ভুলোমনা রাজনীতিবিদরা তাই ক্ষমতায় গেলে অনেক কিছু প্রয়োজনমত ভুলে যান, দীপু মনি ও তার সরকারের স্মৃতিবিভ্রান্তির কারণটাও তাই বুঝা খুব কঠিন কিছু না। তারা এখন সেনাবাহিনীর মন জয় করতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতা সমুন্নত রাখতে গিয়ে সেইসব অভিযুক্ত সেনাসদস্য-সেনানায়কদেরকেও রক্ষা করতে চাচ্ছেন, যাদের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমনের জন্যে অর্পিত অতিরিক্ত ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এখন লেখকের একটি কথার সূত্র ধরেই বলি - এরকম আসকারা দিলে সেনাবাহিনী কীভাবে পাকিস্তানি “ব্লাডী সিভিলিয়ান” মানসিকতা থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এসে প্রমাণ করতে পারবে যে তারা আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ - এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।