নীরব বয়ান
৫ এপ্রিল দৈনিক ‘প্রথম আলো’ ছোট একটি খবর ছাপিয়েছে “জাতিসংঘ আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হলেন দেবাশীষ রায়” শীর্ষক শিরোনামে। তবে এ সংবাদ প্রচারিত হওয়ার আগেই জেনেছিলাম রাজা দেবাশীষ রায় আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে গত ২৮ এপ্রিল ২০১০ তারিখে আগামী ২০১১ - ২০১৩ মেয়াদের জন্যে জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে (United Nations Permanent Forum on Indigenous Issues)একজন আদিবাসী বিশেষজ্ঞ সদস্য (Indigenous Expert Member) হিসেবে ঘোষণা করেছে। এরকম একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ায় আমরা তাকে উঞ্চ অভিনন্দন জানাই। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি কেবল বাংলাদেশের আদিবাসী নয়, গোটা এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে কাজ করবেন এবং জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদকে আদিবাসী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করবেন।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের কাজ কী কী এবং বিশেষজ্ঞ সদস্যদের কিভাবে নিয়োগ করা হয় সে ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন। আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মধ্যে একটি স্থায়ী সংস্থা। এই স্থায়ী ফোরামের কাজ পরামর্শমূলক। এর বিশেষজ্ঞ সদস্যরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কার্যক্ষমতার সাথে সংগতি রেখে আদিবাসী অধিকার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি বিষয় যেমন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘকে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। প্রতিবছর এপ্রিল মাসে স্থায়ী ফোরামের বার্ষিক অধিবেশন নিউইউয়র্কে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
বার্ষিক অধিবেশনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তাবলী গ্রহণ করা হয়। ঐ অধিবেশনে সরকারী প্রতিনিধি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসী প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। সবার অংশগ্রহণে স্থায়ী ফোরামের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে জাতিসংঘসহ সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলোকে আহবান জানানো হয়।
জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম ১৬ সদস্য নিয়ে গঠিত। তার মধ্যে ৮ জন রাষ্ট্র প্রতিনিধি ও ৮ জন আদিবাসী প্রতিনিধি রয়েছেন।
তাদেরকে বিশেষজ্ঞ সদস্য (Expert Members) হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁরা ২ বছরের জন্যে মনোনীত হন, তবে কোন সদস্য দুই মেয়াদের অধিক স্থায়ী ফোরামের সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রপ্রতিনিধিদেরকে জাতিসংঘভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নির্বাচিত করে থাকেন। অন্যদিকে আদিবাসী প্রতিনিধিদেরকে আদিবাসীরা নির্বাচিত করে থাকেন। আদিবাসীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্যে সারা পৃথিবীকে ৭টি আদিবাসী অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন।
যেমন, আফ্রিকা; এশিয়া; মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল; উত্তর আমেরিকা অঞ্চল; মেরু অঞ্চল; মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া ফেডারেশন ও মধ্য এশিয়া; এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এ ৭টি অঞ্চল থেকে আদিবাসীরা ৮জন আদিবাসী প্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকেন। প্রতি অঞ্চল থেকে ১ জন করে হলে নির্বাচিত হন। তবে অতিরিক্ত ১টি আসনে প্রথমোক্ত তিন অঞ্চল থেকে পালাক্রমে নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। এবার এশিয়া থেকে ১ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনি হলেন বাংলাদেশের আদিবাসী নেতা রাজা দেবাশীষ রায়।
আদিবাসী প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়া জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের দায়িত্ব হলেও প্রথাগতভাবে আদিবাসী সংগঠনসমূহ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে আসছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদও সেটা মেনে নিয়েছে। এশিয়া দেশগুলো যেমন নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ, জাপান, থাইল্যান্ড, বার্মা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও কম্বোডিয়ার আদিবাসী সংগঠনসমূহ ভোটের মাধ্যমে গত ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ রাজা দেবাশীষ রায়কে এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। আদিবাসী সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কাছে রাজা দেবাশীষ রায়ের নাম পাঠানো হয়েছিল। আর জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ ২৮ এপ্রিল আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের বার্ষিক অধিবেশনে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশ থেকে রাজা দেবাশীষ রায়ের এ মনোনয়ন বাংলাদেশের জন্যেও গৌরবের বিষয়, যদিও সরকারের তরফ থেকে তাকে এখনো অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা বার্তা কোন কিছুই পাঠানো হয়নি। রাজা দেবাশীষ রায় কেবল আদিবাসী নেতা নন, তিনি সবার উপরে বাংলাদেশের নাগরিক। শিক্ষায় একজন দক্ষ ব্যরিষ্টার। লেখক ও গবেষক হিসেবেও সুখ্যাতি লাভ করেছেন। চাকমা সার্কেলের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি পার্বত্য মন্ত্রণালয় ও তিন পার্বত্যজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে পার্বত্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত কৌশলপত্র প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর নিয়োগ তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি। তিনি কেবল আদিবাসী প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের জন্যে অনেক অবদান রাখার যোগ্যতা রাখেন।
তার অভিজ্ঞতা দেশের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্যে সরকারকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজা দেবাশীষ রায়ের জাতিসংঘের আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে আদিবাসী বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সম্পর্কেও কিছু বলা প্রয়োজন বোধ করছি। আওয়ামীলীগ নেত্রী হোক আর বিএনপি নেত্রী হোক, বিরোধী দলে থাকলে ‘আদিবাসী’ সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বিবৃতি দেন এবং আদিবাসীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। আর সরকারের গেলে বাংলাদেশ কোন ‘আদিবাসী’ নেই বলে বিদেশীদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন। এ দ্বিমুখী নীতির কারণে তারা ক্ষমতায় গেলে আদিবাসীদের কথা বেমালুম ভুলে যান।
ঠিক বিএনপি সরকারের মত বর্তমান আওয়ামী জোট সরকারও আদিবাসী বিষয়ে একই বুলি আওড়াচ্ছে। যেমন, গত ১১ এপ্রিল জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর আবাসিক প্রতিনিধি ও সমন্বয়কারী মিজ রেনাটা লক ডেসালিয়েন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপুমণি’র সাথে বিদায়ী সাক্ষাত করতে গেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। যারা আছে তারা হলো জাতিগত সংখ্যালঘু ও উপজাতি।
ভাবতে অবাক লাগে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষায়-দীক্ষায় চরম উৎকর্ষের যুগ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদী চেতনাপ্রসুত ‘উপজাতি’ শব্দটি বিশ্বকে গিলাতে চাচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদিবাসীদের অস্বীকার করলে কী হবে, দেশীয় বিভিন্ন আইনে ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি আছে।
দেশের কথা না হয় বাদ দিলাম, আন্তর্জাতিক আইনেও যেমন জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ‘৯২, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৬৯ নং চুক্তি, আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার কনভেনশন ইত্যাদিতে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। জাতিসংঘ সনদের আওতায় প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কাঠামোর মধ্যে আদিবাসীদের জন্যে স্থায়ী ফোরাম গঠিত হয়েছে। সেখানে আদিবাসী প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র প্রতিনিধিদের সাথে পাশাপাশি বসে বিশ্ব আদিবাসীদের কথা তুলে ধরছেন। এসব আন্তর্জাতিক সনদ বাংলাদেশও অনুমোদন দিয়েছে। সরকার এসব আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কনভেনশন কিভাবে অস্বীকার করবে? নিজের দ্বিমুখী নীতির জন্যে সরকার নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেদিন আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন, তার ঠিক তিন সপ্তাহের মাথায় সেই বাংলাদেশের আদিবাসী নেতা রাজা দেবাশীষ রায় জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ীফোরামে আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেলেন। বাংলাদেশে যদি আদিবাসী না-ই থাকে, সেই বাংলাদেশের আদিবাসী কিভাবে জাতিসংঘের আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হন?
শুধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, আরো অনেক বাঙালি ভাই-বোন আছেন যারা আদিবাসী শব্দ শুনলেই মুর্ছা যান। আদিবাসীর সংজ্ঞা খুঁজেন, এ বাংলায় কার আগমন প্রথম ঘটেছিল সেসব নিয়ে (কুট)তর্কে নামেন। তখন তারা বাঙালি থাকতে চান না, আদিবাসী পরিচয়টা ‘উপজাতি’দের থেকে হাইজ্যাক করে নিতে চান। আদিবাসী পরিচিতি হাইজ্যাক করার অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চিৎকার মারেন, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই।
তাঁর এই চিৎকারের জবাবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কর্তৃক রাজা দেবাশীষ রায়কে জাতিসংঘের আদিবাসী বিশেষজ্ঞ নিয়োগদান বাংলাদেশ সরকারের মুখে বড় চপেটাঘাত - এ কথা জোর দিয়ে বললে অযৌক্তিক হবে না ।
দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। উপনিবেশবাদী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কোন রাষ্ট্র চলতে পারবে না, এগিয়ে যেতে পারবে না। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও পরমতসহনশীলতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী আন্দোলন জোরালো হয়েছে।
জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছে; স্থায়ী ফোরাম গঠন করেছে। এখন আন্তর্জাতিক আদিবাসী আন্দোলনকে বলা হয় ‘চতুর্থ বিশ্ব’। চতুর্থ বিশ্বের আন্তর্জাতিক বাস্তবতা বাংলাদেশ সরকারের অস্বীকার করার জো নেই। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে দেশীয়ভাবে আদিবাসীদের যথাযথভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া। পশ্চাদপদ চিন্তা পরিহার করে এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও বহুসংস্কৃতির পরমতসহনশীল দেশ।
রাজা দেবাশীষ রায়ের প্রতি শুভ কামনা রইল। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তার কীর্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।