আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কক্সবাজারে প্রশ্নবিদ্ধ ‘আদিবাসী’ মেলা : উপজাতীয়দের আদিবাসী না বলতে সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা

my country creat me a ginipig

মাত্র এক মাস আগে সরকার বাংলাদেশে বসবাসকারী পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ সম্বোধন না করতে নির্দেশ দিলেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও বাংলা স্যাটেলাইট টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ আয়োজন করল ‘আদিবাসী মেলা ২০১০’। দিনব্যাপী এই মেলাকে অনেকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কর্মকাণ্ড বলেও মনে করছেন। শুক্রবার বেলা ১১টার পর সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে সরকারেরই শ্রমমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হেমায়েত উদ্দিন। সরকারের নীতিবিরোধী এই কর্মকাণ্ডে অর্থ সহায়তা দিয়েছে হোমস্টোন লিমিটেড, কিউট, আশিয়ান সিটি, জিএমজি এয়ারলাইন্স, বেস্টওয়ে গ্রুপ, চৌধুরী গ্রুপ, হামদর্দ, স্কি ক্লাউডি লেমন, তাজা, অল ক্লিয়ার, ক্লোজআপ, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, লাক্স, পেপসোডেন্ট, সার্ফ এক্সেল, সানসিল্ক শ্যাম্পো, ভিম বার, হুইল পাওয়ার হোয়াইট ও পন্ডস পণ্য উত্পাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতিকে ‘আদিবাসী’ সম্বোধন না করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেইসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল ও এনজিওর স্বতন্ত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে তাদের ওপর নজরদারি ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করার নির্দেশও দেয় মন্ত্রণালয়। সূত্রমতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সমন্বয়-২) মুজিবুর রহমানের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি ও পাহাড়িদের ‘আদিবাসী’ বলে আখ্যাদানকারী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমালোচনাও করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সরকারেরই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও ‘চ্যানেল আই’ পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনের নামে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গতকাল আয়োজন করে ‘আদিবাসী মেলা’। তাদের এই কর্মকাণ্ডকে উদ্দেশ্যমূলক ও রাষ্ট্রবিরোধী বলেও অভিহিত করেছেন অনেকে।

এই মেলায় দেশের তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী পাহাড়ি ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি তুলে ধরার নামে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আয়োজন করা হয় ‘আপত্তিকর’ নাচ-গানের। অনেকের প্রশ্ন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেখানে উপজাতি কিংবা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলতে নির্দেশ দিয়েছে সেখানে সরকারেরই প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ কার স্বার্থরক্ষা করতে ‘আদিবাসী মেলা’র আয়োজন করছে! প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকার এবং দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান কখনোই বাংলাদেশের উপজাতি বাসিন্দাদের ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকার করেনি। তা সত্ত্বেও সরকারি মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে উপজাতিদের আদিবাসী বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আসছেন। বর্তমান সরকারও পার্বত্য উপজাতিদের দাফতরিকভাবে ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকার করেনি। সে কারণেই ব্যাপক দাবি সত্ত্বেও মানবাধিকার কমিশনে ও প্রস্তাবিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে ‘উপজাতি’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

তবু সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিসহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন ব্যক্তি উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। নতুন সরকারি নির্দেশনা সত্ত্বেও তা বন্ধ হয়নি। একাধিক সূত্রমতে, ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অণুবিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে জানানো হয়, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলতে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীর কতিপয় নেতা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিয়ে আর্থিক সহায়তাসহ তাদের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে তত্পর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তত্সংলগ্ন ভারত ও মিয়ানমারের বিশাল এলাকার বাসিন্দাদের জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সহায়তায় ব্যাপক হারে খ্রিস্টানকরণ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ইসরাইল বা পূর্ব তিমুরের মতো স্বতন্ত্র খ্রিস্টান ‘বাফার স্টেট’ তৈরির পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশ সরকারের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট মহল সতর্ক হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ তার সদস্যভুক্ত কোনো দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে—এ মর্মে ক্লজ থাকায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেই চার্টারে স্বাক্ষর দিতে আপত্তি জানায়। এরই প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের permanent forum for indigenous people-এর সপ্তম অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিষ্কারভাবে জানায়, `The country has some tribal population and there are no indigenous people.’ এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৬৩তম অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে আদিবাসী প্রসঙ্গ থাকায় বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে জানতে চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি লেখে। এর উত্তরে ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একই কথা জানায়। মাত্র এক মাস আগে গত ২৮ জানুয়ারি ২০১০ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতত্পরতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের গোপনীয় প্রতিবেদনে (স্মারক : পাচবিম (সম-২)২৯/২০১০/২৫, তারিখ: ২৮/১/২০১০) বলা হয়েছে : ‘বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

তাদের কোথাও ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতা, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি, এমনকি কিছু সাংবাদিকও ইদানীং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ না বলে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। এতদবিষয়ে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সংবাদমাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো এসব ব্যক্তির সাহায্যে তাদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতীয় সম্প্রদায় এখন নিজ নিজ ধর্ম সংস্কৃতিতে অবস্থান না করে তাদের অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। বাংলাদেশীয় উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ উল্লেখ না করার বিষয়ে এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল।

তবে বর্তমানে সে নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে আদিবাসী মন্ত্রণালয় করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে অযৌক্তিক দাবি উত্থাপিত হচ্ছে বলে জানা যায়। ইউএনডিপি, ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এইকসঙ্গে উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সেমিনার, শিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে এবং সাংবাদিকেরা বিভিন্ন লেখায় উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

এরূপ কাজ অব্যাহত রাখলে উপজাতীয়দের ভবিষ্যতে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তক স্বরাষ্ট্র সচিব এবং পার্বত্য ৩ জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক বরাবরে এ প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আজকের আমার দেশ দেখুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।