http://rmpalash.blogspot.com/ আগের পর্বঃরিমিরা কোনদিনই আমাদের হয়না।
রিমিরা কখনোই আমাদের হয়না -রিমিরা আমাদের জন্যে না। (দ্বিতীয় ভাগ)
যেকোন বুয়েট ছাত্রের ফাইনাল ইয়ারের প্রেসার বিখ্যাত। সে জিনিস ভুক্তভোগী ছাড়া কারো বোঝা দুষ্কর। আর কারো যদি বাইরে যাবার ইচ্ছা থাকে তাহলে তো ব্যাপারটা আরো কষ্টকর হয়ে যায়।
ভাল থিসিসের জন্যে খাটতে হয় গাধার মত। এবং সেটা পুরোপুরি অনিশ্চিত। ভাল কিছু যে আসলেই আসবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনা। তারপরে আছে জি,আর,ই প্রস্তুতি। বাইরে একটা ভাল ভার্সিটিতে এডমিশনের জন্যে রক্তপানি করে খাটতে হয়
মোটামুটি ভাবে যাদের রেজাল্ট ভাল তারাই এগুলি নিয়ে মাথা ঘামায়।
তারা ভাল থিসিস করে,ভাল স্যারের সুপারভাইজে। তারা রুমে বসে বসে জি আর ই,টোফেল পড়ে,খোজ খবর রাখে। আর আরেকদল থাকে টেনশন মুক্ত। তাদের রেজাল্ট খারাপ,বাইরে যাবার ইচ্ছাও নাই। কোনরকমে পাস করতে পারলেই ভাল একটা চাকরি।
একটি মেধাবী জীবনের সেখানেই সমাপ্তি। আমার রেজাল্ট অনুসারে আমার দ্বিতীয় ভাগেই যাবার কথা। হয়তো যেতাম ও।
থার্ড ইয়ারের শেষ টার্মে আমার মা হঠাৎ করে মারা গেলেন। বাবা মরেছেন ফার্ষ্ট-ইয়ারে।
কথায় আছে জীবিত মানুষ মরা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। আমার আম্মা মরে গিয়ে দ্বিগুন ক্ষমতা নিয়ে হাজির হলেন। আম্মার স্বপ্ন ছিল আমি ভাল রেজাল্ট করব। দেশের বাইরে ভাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে নামের আগে ডক্টরেট লাগাবো। বেচে থাকতে মায়ের কথার গুরুত্ব দেবার দরকার অনুভব করিনি।
রেজাল্ট নিয়ে টেনশন ছিলোনা। কোন রকমে পাস করে গিয়েছি। আম্মার মৃত্যুর পরে নিজেকে অপরাধী মনে হল। দিন দিন সেটা বেড়েই চললো। শেষমেষ সিদ্বান্ত নিলাম।
জীবনে আর যা কিছু করিনা কেন আমার মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পুরন করেই ছাড়বো।
**********************************
একবছরের নিরলস পরিশ্রমের ফসল একসময় পেলাম। পাস করার সময় আমার চারটা জার্নাল ইন্টারনেশনাল ট্রাঞ্জেকশনগুলোতে পাবলিশড। দুইটা কনফারেন্সে এটেন্ড করেছি। সিঙ্গাপুর আর ইন্ডিয়ায়।
সিংগাপুরে পরিচয় হল তহুকু ইউনিভার্সিটি জাপানের প্রফেসর কইচি তানায়া এর সাথে। সদাহাস্যোজ্জল নোবেলজয়ী এই লোকটার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছিল। তাকে আমি বলেছিলাম আমার জীবনের নানান কথা। আমার দুঃখগুলো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কনফারেন্সের বিদায়ের দিনে তিনি আমাকে বলেছিলেন”রাসেল আমরা যে বেচে আছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?সুতরাং বাচাটাকে অর্থবহ করে নাও।
“দেশে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই তার মেইল পেলাম। তিনি আমাকে তার ভার্সিটি রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে মাষ্টার্সে এডমিশন দিতে আগ্রহী। আমার মতামত জানাতে বলেছেন। ছয়মাস পরে আমি আমাকে আবিষ্কার করলাম জাপানের সেন্দাই শহরের চেরীফুল ঘেরা সুন্দর ক্যাম্পাসের তহুকু ভার্সিটিতে। সাগরের কাছাকাছি এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্যে যে কেউ বিমোহিত হবে।
আমিও হয়েছি।
স্কলারশীপ পাওয়া স্বত্বেও নানা আনুসাংগিক খরচ মিলিয়ে আমার লাখ-দুয়েক টাকা দরকার ছিল। সেই টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আজাদ আংকেল। ওনার মেয়েকে আমি দুই বছর পড়িয়েছিলাম ইন্টারে। সে বুয়েটে চান্স পেয়েছিল।
হয়ত এটাই ছিল সেই দেনা শোধের উপলক্ষ্য। কিংবা আরো বড় কিছু। কে জানে?
আমি যেদিন বাংলাদেশ ত্যাগ করেছি কাকতালীয় ভাবে সেদিনই তানজীবের সাথে রিমির বিয়ে হয়। এটা প্রত্যাশিত ছিল। যতটা কষ্ট পাব ভেবেছিলাম ততটা পাইনি।
রিমি আমার জীবনে হারিয়ে গিয়েছে তার চেয়ে বড় কথা হল আমার জীবনের এক স্বপ্ন পুরনের দিকে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। এই স্বপ্নের গুরুত্ব কিন্তু রিমির চেয়ে কম নয়।
আমার জীবনে রিমি অবস্থান ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মত ফিল করিনা। রুমির কথা ভেবে ভেবে নির্ঘুম রাত ভোরের দেখা পায় না।
আকাশের দিকে তাকালে এখন আর রিমির মুখ দেখা যায় না। সেখানে দেখি রিসার্চ,আন্ডার গ্রাউন্ড সেন্সর নেটওয়ার্ক,কনফারেন্স,জার্নাল,পিএইচডি,নোবেল। এতসব গুরুত্বপুর্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত জীবনে রিমির স্থান কোথায়?
সফলতা আসতে শুরু করলে আসতেই থাকে। মাষ্টার শেষ করার সময় আমার জার্নালের সংখ্যা দাড়ালো পনেরোতে। এগুলো সবই ছিল শীর্ষস্থানীয় পাবলিকেশন।
নিচুধরনের পাবলিকেশন দিয়ে সংখ্যা বাড়ানোতে আমার বা আমার প্রফেসরের সায় ছিলোনা। আমার জার্নাল ছিল কম,মান ছিল ভাল। আমার কয়েকটা জার্নাল পাবলিকেশন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা নির্বাচিত হল।
মাষ্টার্স শেষ করার পরে ডাক পেলাম বিশ্বের সেরা সেরা সব ভার্সিটি থেকে। এর ভেতরে এম,আই,টি ক্যালটেকও ছিল।
কিন্তু আমি বেছে নিলাম আটলান্টিকের তীরবর্তী প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিকে। আগে থেকেই এই ভার্সিটির প্রতি আমার প্যাশন ছিল। বিশাল আটলান্টিকের পাশে নিউজার্সির এই ভার্সিটি হল আমার নতুন ঠিকানা।
********************************
বাংলাদেশ ছাড়ার ৩ বছর পরে ২০০৫ সালের অক্টোবরে আমি নিউজার্সিতে পদার্পন করি। প্রিন্সটন ভার্সিটি।
যে ভার্সিটি ধন্য হয়েছে বত্রিশ জন নোবেল লরিয়েটের পদার্পনে। এই সেই প্রিন্সটন ভার্সিটি। গেমথিউরির জনক জন ন্যাশ এই ভার্সিটির ছাত্র। এ বিউটিফুল মাইন্ড মুভিটি যাকে নিয়ে তৈরি।
নতুন জীবন ভাল কাটছিল।
সারাউইক ব্যস্ততা আর উইকএন্ডে ঘুরতে যাওয়া। নতুন ধরনের জীবন। নতুন সকাল নতুন প্রত্যাশা।
মাঝে মাঝে তানিশার সাথে ফোনে কথা হত। দেশের সাথে আমার একমাত্র যোগাযোগ এই মেয়েটা।
ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেছে। আর কিছুদিন পরে পাশ করে বের হবে। বুয়েটে তাকে অনেক কষ্ট করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। বাইরে আনতে আবার আমাকেই খাটুনি করতে হবে। কিছু কিছু খাটনিতে ক্লান্তি হয় না।
বেশি বেশি করতে ইচ্ছা করে। এও হয়তো সেরকম কিছু। তাছাড়া আজাদ আংকেলের কাছে আমার অনেক লোন। সেগুলোর শোধ করতে হবেনা।
বন্ধুবান্ধবদের সাথে ভাল যোগাযোগ ছিলোনা।
কে কোথায় আছে জানতামও না। একদিন ইউনিভার্সিটি অফ কানেক্টিকাটে ঘুরতে গেলাম। সেখানে দেখা হল আমার এক ফ্রেন্ড নিজামের সাথে। আমার হলে থাকত। রিমির কাহিনী সে জানতো।
সেই জানালো যে রিমি আর তামজীদ দুজনেই কানেক্টিকাট ইউনিভার্সিটিতেই আছে। হায় নিয়তি!সারা দুনিয়া ঘুরিয়ে কেন আবার আমাদের একই স্থানে জড়ো করলে?
*****************************
এপ্রিলের এক সুন্দর সকাল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক কাপ কফি নিয়ে বেলকনিতে দাডিয়ে দেখলাম আমেরিকান বসন্তের রুপ। রেড আর হোয়াই এজালিয়ার ছড়াছড়ি চারদিকে।
মাঝে মাঝে দুএকটা পাখি ডাকছে। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। আহ! মোবাইলটা যদি না বাজতো!এমন হতে পারতোনা যে আমার মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেল কিংবা নিজাম আমার নাম্বার ভুলে গেল!কেন হলোনা?
হাসপাতালে রিমির লাশ দেখতে যেতে চাইনি। কিন্তু যেতে হল। বাস্তবে যে সুন্দরের প্রতিমা তৈরি করে আমার মনে সে অবস্থান করছিল সেই অবস্থান তার লাশের সৌন্দর্য্যহীনতা দিয়ে ঢাকতে চাইনি।
কিন্তু যখন লাশের মুখে দিকে তাকালাম আমার একটুও অসুন্দর মনে হলনা। রিমিকে একা ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিলনা। ইচ্ছে করছিল ওর হাত ধরে বসে থাকি আরো কিছুক্ষন। একা একা অজানার পথে নয়তো মেয়েটা ভয় পাবে।
তানজীবকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।
আমেরিকার আইন অনুসারে তার ডেথ সেন্টেন্স হয়ে যাবে। পুলিশ স্টেশন থেকে পেলাম রিমির সেই ডাইরিটা। এত দূরে আসার সময়ও সে যেটা হাতছাড়া করেনি। আর যে ডাইরি আজ তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই সেই ডাইরি।
ডাইরিটার একটা মাত্র পাতাই আমি পড়তে পেরেছিলাম। আর পারিনি। সেই একটা পাতাই আমার জীবনকে আরেকবার এলোমেলো করে দিল। আমার লাইফ,ক্যারিয়ার,রিসার্চ সব নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। রিমি বেচে থাকতে তার কারনে আমার লাইফ একবার ধ্বংসের দিকে গিয়েছিল মৃত্যুর পরে তার ডাইরির কারনে সেই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
রাজীব আমার বন্ধু ছিল। অনেক ভাল বন্ধু। আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। সেই বিশ্বাসের উপযুক্ত মুল্য সে দিয়েছে। রিমির লাজুকতা আর আমার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির সুযোগ সে নিয়েছে চরম ভাবে।
রিমির ডাইরি আমি পড়িনি। কি থাকবে সেখানে?পাতায় পাতায় আমাকে না পাওয়ার বেদনা। যে কষ্ট আমি তাকে দেইনি রাজুর কারনে পাওয়া সে কষ্টের আলেখ্য। একটা নিষ্পাপ মেয়ের পবিত্র ভালবাসা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই সেই ডাইরি আমি পড়িনি।
শুধু একটা কথাই ভেবেছি। আমি রিমিকে তো কত আগেই প্রায় ভুলে গেছি মেয়েটা কেন ভুললোনা। রিমির ভালবাসার গভীরতার কাছে আমার ভালবাসার জেগে যাওয়া চরের মত এবড়ো-থেবড়ো মনে হতে লাগল।
রিমির এই মৃত্যুর জন্যে আসলে কে দায়ী?
তানজীব?স্ত্রীর গোপন ভালবাসা সহ্য করতে না পেরে তাকে মেরে ফেলল এই জন্যে?
নাকি রাজু?যে নিজের গোপন লালসা বাস্তবায়নে আমাকে পথের কাটা মনে করে সরিয়ে দিতে চেয়েছে।
আসলে আমি নিজেই রিমির মৃত্যুত জন্যে দায়ী।
আমার কারনেই একটা ফুলের মত মেয়ে এইভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। আমি যদি সেই সময় আরো সাহসের পরিচয় দিতাম,রাজুকে যেতে না দিতাম তাহলে আজ ঘটনা এইরকম হতোনা।
বাটারফ্লাই ইফেক্টকে স্টিমুলেট করে দিয়েছি আমি। আমিই আসল কালপ্রিট।
*************************
শেষকথাঃ
রাসেল নামের এই ছেলেটা ১৯ এপ্রিল এক মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছাদ থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহত্যা করে।
আজাদ সাহেব তার লাশ বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করেন।
সবাই যখন তার লাশ দাফনে ব্যস্ত তখন একমুঠো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তানিশা নামের একটা ফুটফুটে উচ্ছল তরুনী। আর একমাস পরে যার ইউ এস এ তে যাবার কথা। ভার্জিনিয়া টেকে যার এডমিশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল রাসেল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।