“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” (১)
গতকাল রাত থেকেই মিলনের মন খুব ভালো। রাতে রিনার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। আজকে রিনা মিলনকে দুপুরের দিকে কলেজের সামনে দেখা করতে বলেছে। মিলনের অনেক দিনের স্বপ্ন পূরন হতে যাচ্ছে আজ। রিনার সাথে কথা হবার পর সে রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি, সারা রাত বিছানাতে ছটফট করেছে।
রিনার সাথে রাত জেগে কল্পনায় কথা বলেছে, ঝগড়া করেছে আবার ভাবও হয়েছে। ভোরের দিকে একটু দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছিলো। মনে হলো লাল টুকটুকে শাড়ী পরে রিনা মিলনের কাছে এসে মাথার পাশে বসে আলতো ভাবে কোমল রাঙ্গা হাত বুলিয়ে মৃদু মিষ্টি কন্ঠে বলছে, ‘সকাল হয়ে এলো। আসবে না আমার কাছে!’
রিনা মিলনের ফুফাতো বোন, সমবয়সী। মিলনেরা থাকে গ্রামে, রিনা সদরে।
দুই পরিবারের মধ্যে নিয়মিত আসা যাওয়া থাকায় ছোটবেলা থেকেই ওরা দুজন খেলার সাথী। একসাথে খেলতে খেলতে কখন যে সময় চলে গেছে! ছোট্ট রিনা হয়ে উঠেছে কিশোরী রিনা। গতবছর বাবা-মায়ের সাথে রিনা যখন গ্রামে এসেছিলো, রিনা ওর মায়ের লাল পাড়ের শাড়ীটা একদিন বিকেলে পরেছিলো। শাড়ীতে রিনাকে এক ঝলকে পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত করলো। মিলন দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি।
ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা বুকে ব্যথা অনুভব করলো। সেদিন থেকেই রিনাকে নিয়ে মিলনের নতুন জীবন।
প্রথম দিকে মিলনের এই নিখাঁদ ভালোবাসা একতরফাই ছিলো। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে, রিনার কলেজে যেতে চেয়েছে, কিন্তু পা দু’টো যেনো কেউ লোহার শিকল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিলো, মুখে যেনো কেউ পেরেক মেরে দিয়েছিলো। অব্যক্ত কথা মনের গহীনে সুপ্তই রয়ে গেলো।
কিছুদিন আগে যখন মিলন রিনাদের বাসায় গিয়েছিলো, আকারে আভাসে রিনার কেউ আছে কী না জানতে চেয়েছিলো। রিনা কথাচ্ছ্বলে জানালো রিপন নামের এলাকার এক ছেলে কিছুদিন যাবত ওকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। মিলনের ভিতরের মিলন জেগে উঠতে চাইলো। ওর চিৎকার করে রিনাকে বলতে ইচ্ছে করছিলো, ‘কোনো রিপন তোমার কিছু করতে পারবে না। আমি তোমাকে আগলে রাখবো।
’ বলা আর হয় না। রিনার দিকে তাকালেই ওর কী যেনো হয়ে যায়। কথা বলার শব্দ খুঁজে পায় না, একদৃষ্টিতে কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়েও থাকতে পারে না।
সেই রিনা গতকাল রাতে মিলনকে ফোন দিয়েছিলো। ওকে আজ রিনার কলেজে যেতে বলেছে, বলেছে আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কথা বলবে।
সেই কথা শুনলে না কি মিলনের হাজার বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে। মিলন হাজার বছর বেঁচে থাকতে চায় না, ও শুধু যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন রিনাকে কাছে পেতে চায়। আজ বোধহয় সেই দিন। মিলনের মনে হচ্ছে যে কথাটি মিলন এতদিন বলতে পারেনি, তা আজ রিনাই ওকে বলবে। তাই সারা রাত মিলন ঘুমাতে পারেনি, বিছানাতে শুধু এদিক ওদিক করেছে।
ভোরের দিকে দুই চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো।
‘কি রে মিলন! ঘুম থেকে উঠবি না?, মিলনের মায়ের ডাকে মিলন চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে, ‘তাড়াতাড়ি উঠ। কিছু একটা খেয়ে শহরে যা। তোর বাবা মেম্বরের বাড়িতে গেছে, কি একটা কাজে। তুই শহরে গিয়ে তোর ফুফুর কাছে এই টাকাটা দিবি’, বলে মিলনের মা মিলনের হাতে দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল দিলো।
মিলন কিছু মুখে না দিয়েই শহরের দিকে রওয়ানা দিলো।
(২)
কলেজ ছুটি হবার অনেক আগেই মিলন রিনার কলেজের সামনে চলে এসেছে। ভাবছে রিনার সাথেই একবারে ফুফুর বাড়িতে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসবে। কলেজের সামনে এসে একবার মোবাইলে রিনাকে ফোনও দিলো। রিনা রিনঝিনি লাজুক কন্ঠে বললো, ‘তুমি এসে গেছো? ক্লাস শেষ হতে আরো এক ঘন্টা লাগবে।
একটু এদিক সেদিক অপেক্ষা করো। ’ মিলন কিছুক্ষন কলেজের সামনের পুকুরের ঘাটে বসলো। চিন্তা করছে, রিনা ওকে ভালোবাসার কথা বললে কিভাবে ভড়কে দিবে। রিনাকে নিয়ে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে তার একটা লিস্টও করে ফেললো। এই ছোট্ট মফস্বল শহরে অবশ্য নিরিবিলিতে বসার কোনো জায়গা নেই।
অপেক্ষার সময় বড় দীর্ঘ। যতই সময় যাচ্ছে, ততই অস্থির হয়ে উঠছে। একবার পুকুর ঘাট থেকে উঠে সামনে কিছুদূর হাঁটলো, আবার পুকুর ঘাটে চলে আসলো। এভাবে কয়েকবার উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে আবার পুকুর ঘাটে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। পুকুরের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবতে লাগলো, ‘রিনা, তোমার জন্য এই শেষ অপেক্ষা।
এরপর থেকে তোমাকেই অপেক্ষায় রাখবো’।
‘এই তুই কেডা? কোন জায়গা থেকে আইছিস? এইহানে কি করিস?’, মিলন তাকিয়ে দেখে তিনজন লোক ওর পাশে এসে জিজ্ঞেস করছে, ‘তোরে তো আগে এইহানে দেহি নাই। বেয়ানে যে দুই ডাকাতরে মারি হালাইছি, তুই কি হেগো দলের?’ সচকিত হয়ে উঠে মিলন। এদের চোখে অশুভ ছায়া দেখতে পায়। মিলনের গলা শুকিয়ে যায়।
আমতা আমতা করে বলে, ‘ফুফাতো বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি। এই কলেজে পড়ে। একটু পরে ক্লাস শেষ হবে’। ‘কেডা তোর বোন? নাম কি?’, এক জোয়ান ছেলে এগিয়ে এসে জানতে চায়। ‘রিনা’ অস্ফুট স্বরে বলে মিলন।
দেখতে পায় জোয়ান ছেলেটা একটু চমকে উঠে, পরক্ষনেই ক্রুর হাসি হেসে বলে, ‘এই কলেজের সব মাইয়ারে আমি চিনি, রিনা ফিনা নামের কেডাও নাই। চাচা মিয়া, আমি এইডারে দারোগার কাছে দিয়া আই,’ বাকী দুইজন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, ‘হাক্কল কথা কইছস রিপন, এইডারে পুলিশে দিয়া আয়’। নাম শুনে মিলনের যেনো কী মনে পড়তে চায়, কিন্তু মনে পড়ে না।
রিপন নামের জোয়ান ছেলেটা মিলনের কোনো কথা না শুনে টানতে টানতে থানাতে নিয়ে যায়। পুলিশের হাতে তুলে দেবার সময় মিলন দেখে এসআই-এর সাথে আড়ালে গিয়ে রিপন কথা বলে চলে গেলো।
এসআই এসে মিলনকে বললো, ‘ তুই কি সকালের ডাকাত দলের কেউ? এই, ওরে সার্চ কর তো’। কন্সটেবল মিলনের পকেট সার্চ করে দশ হাজার টাকা আর একটা মোবাইল ফোন পায়।
একটু পরে এসআই মিলনকে পুলিশের ভ্যানে করে শহরের চৌরাস্তার মোড়ে নিয়ে যায়। সেখানে ওকে ভ্যান থেকে নামিয়ে দিয়ে জনতাকে বলে, ‘পোলাডা ডাকাত দলের সদস্য। এরি মারি হালা'।
কথা শেষ হতে পারেনি, চারদিক থেকে সভ্য জগতের সভ্য মানুষেরা হিংস্র হায়েনার রুপ নিয়ে মিলনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মিলনের আওয়াজ ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হতে থাকে। একসময় আবছা ভাবে দেখতে পায়, রিপন নামের ছেলেটা একটা ইট নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ করেই রিপনকে চিনতে পারে, মনে পড়ে রিনা বলেছিলো। রিপন ওর দিকে এগিয়ে আসে, ওর মাথার কাছে হাটু ভেঙ্গে বসে, ফিসফিস করে বলে, ‘রিনার কাছে আসার সাধ তোর সারাজীবনের জন্য মিটাইয়া দিলাম’, তারপর ইট দিয়ে মাথায় সর্বশক্তিতে আঘাত করে।
থানাতে এসআই-এর টেবিলে রাখা মিলনের ফোন বেজে উঠলো। এসআই দেখলো ফোনের স্ক্রীনে রিনা নাম ভেসে উঠেছে, কেউ ফোনটা ধরলো না। ফোনটা অনবরত বাজতেই থাকলো, বাজতেই থাকলো।
(আজ সকালে প্রথম আলোতে ‘এ কোন পুলিশ, এ কেমন পৈশাচিকতা!’ -এই খবরটা পড়ার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ। আমরা কোথায় চলে গিয়েছি চিন্তা করতেই যেনো কেমন লাগে।
খুব মন খারাপ অবস্থায় এই লেখাটা লেখা। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।