উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে রয়েছে অভি। নীল আকাশে ভেসে থাকা কালো মেঘেদের সাথে যেন ওর ভীষন বন্ধুত্ত্ব। এ এমনই গভীর বন্ধুত্ত্ব সব কালো মেঘ যেন ওর মলিন বদনে এসে জমা হয়েছে। তার দুচোখের কোণ জলে ভিজে উঠে, ইচ্ছে হয় হাউমাউ করে কাঁদে। তার কাছে মনে হয় বাবাটা খুব স্বার্থপর, তাঁকে মোটেও ভালোবাসেনা।
আজ কতদিন থেকে সে বাবাকে বলছে একটা বাইসাইকেল কিনে দেয়ার জন্য। কিন্তু বাবা আজ-কাল করতে করতে আর কিনে দিচ্ছেন না। পাশের বাড়ির হিমেল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জোরে জোরে বেল বাজিয়ে তাঁকে শুনিয়ে যায়। বাইসাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ শুনলে ওর মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়।
বেশ কয়েকদিন আগে সে হিমেলের সাইকেলে চড়তে চেয়েছিলো, কিন্তু হিমেল অভিকে সাইকেল চড়তে দেয়নি।
বাইসাইকেল থেকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলো তোর বাবাকে বলনা একটা কিনে দেয়ার জন্য, শুধু শুধু আমারটা নিয়ে টানাটানি করছিস কেনো! সে কেঁদে কেঁদে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় এসে বাবার কাছে আবদার ধরে ওকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিতেই হবে।
অভির বাবা রিফাত সাহেব সদা হাসোজ্জ্বল একজন মানুষ। এমন প্রাণোচ্ছ্বল হাসি সচরাচর কারো মুখে দেখা যায়না। শত সংকটেও তাঁর মুখ কালো দেখা যায়না।
তাঁর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি কোন কিছুতেই না করেন না। তাকে যদি কেউ বলে আকাশের চাঁদ এনে দেয়ার জন্য তাহলে তিনি এমনভাবে কথা বলবেন যেন একটু পরেই তিনি ওটা এনে দিচ্ছেন। অভিকেও তিনি কথা দিয়েছেন একটা বাইসাইকেল কিনে দিবেন কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনা টাকার অভাবে। দ্রব্যেমূল্যের আগুনে পুড়ে সংসারের অবশ্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আর অন্য কিছুর কথা চিন্তাই করা যায়না। মাসের ১০দিন বাকি থাকতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়।
মাসের শেষের দিকে তাঁর হাসোজ্জ্বল মুখও যেন কিছুটা আধারে ঢেকে যায়। সংসারের কেউ হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো টাকাও তখন থাকেনা।
কয়েকদিন থেকে রিফাত সাহেব অভির থেকে দূরে দূরে থাকেন। সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান আর ফিরেন বেশ রাত করে। তিনি ফিরে আসার আগেই অভি ঘুমিয়ে যায়।
ঘরে ঢুকে ছেলেটার মায়াবী মুখের দিকে তাঁকিয়ে মনটা কেমন করে উঠে। তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন অভি খেয়ে ঘুমিয়েছে কি না। জুলিয়া জানান, অভি না খেয়ে, কাদঁতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার রিফাত সাহেবের মন বেশ খারাপ হয়ে যায়। নিজের ওপর ভীষন রাগ হয়।
তিনি নিজেকে ধিক্কার জানান, তুমি কেমন বাবা! ছেলেতো খুব বড় কিছু আবদার করেনি কিন্তু তুমি তা দিতে পারছোনা। তোমার তো বাবা হওয়ার কোন অধিকার নেই।
জুলিয়া স্বামীর পাশের চেয়ারে বসে বলেন, আজ কি হয়েছে জানো? রিফাত জুলিয়ার দিকে তাঁকান। জুলিয়া বলতে শুরু করেন, আজ দুপুরে এক আইস্ক্রীমওয়ালা এসেছিলো। অভি আমার কাছে এসে বললো, মা আমাকে পাঁচটা টাকা দাও না, আইসক্রীম খাবো।
মাস শেষ হতে দু দিন বাকি,ঘরে একটি টাকাও নেই, আমি বললাম বাবা ঘরে তো টাকা নেই। সে কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে বাইরে চলে গেলো। আমি ওর পিছন পিছন গেলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম অভি আইসক্রীমওয়ালাকে বলছে, এই যে আইসক্রীম মামা, তুমি এখানে থাকো না, আমার বাবা আসলেই তোমাকে টাকা দিয়ে দেবো। আইসক্রীমওয়ালার কি হলো জানিনা সে অভির দিকে একটা আইসক্রীম বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এই নাও টাকা লাগবেনা।
কিন্তু অভি টাকা না দিয়ে আইসক্রীম নিতে রাজী হয়না। সে বারবার বলে তুমি আরেকটু থাকোনা, আমার বাবা এখনই চলে আসবে। আইসক্রীমওয়ালা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো আর অভি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এটা দেখে আমার বুক ফেটে যেন কান্না আসতে চায়।
অনেকদিন পর রিফাত সাহেবের চোখে পানিতে ভরে উঠে।
ছেলে তার বাবার ওপর কতো বিশ্বাস করে, কতো নির্ভর করে, কিন্তু তিনি ছেলের জন্য কিছুই করতে পারেন না। তিনি ঘুমন্ত অভির মাথায় হাত রেখে বলেন, বাবারে, দরকার হলে আসছে মাসে না খেয়ে হলেও তোকে আমি সাইকেল কিনে দেবো। তিনি অভিকে টেনে তুলেন খাওয়ানোর জন্য। রিফাত সাহেব ঘুমন্ত অভিকে মুখে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছেন। অভি ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারছেনা, সে খাচ্ছে।
অভির মুখের দিকে তাঁকিয়ে তার মনটা ভালো হয়ে যায়।
আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো অভি। একটু একটু করে পুবাকাশে প্রভাতের লাল সূর্য্য উদিত হচ্ছে। অভির কাছে ব্যাপারটা খুব আশ্চর্য্য লাগে! সারাদিন সূর্য্যটা হলুদ-সোনালী থাকলেও সকালে সূর্য্যের রঙ কেন লাল হয়! বারান্দার পাশের একটি গাছে কি একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে। ভীষন ভালো লাগছিলো অভির কাছে।
তার মাঝে মাঝে মনে হয়, সে যদি পাখি হতে পারতো তবে উড়ে দূরে কোথাও চলে যেতো। হঠাৎ পিছন থাকে রিফাত সাহেব ডেকে বলেন, কিরে অভি এতো সকাল এখানে কি করছিস? অভি একটু অভিমানী ভাব করে কোন কথা বলেনা। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। রিফাত সাহেব কাছে এসে তার গালে আলতো করে টিপে বলেন, বাবার ওপর রাগ করেছিস? আর রাগ করতে হবেনা,আজকেই তোকে বাইসাইকেল কিনে দেবো। অভির কাছে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না।
বাবা তো আর কোন কিছুতেই না করে না, আজকেও হয়তো আশা দিচ্ছে।
তিনি অভিকে কাঁধে তুলে বলেন, আজ আর মিস হবেনা। আজকে রাতেই তোর সাইকেল পেয়ে যাবি। অভি বুঝতে পারেনা বাবা কতটুকু সত্য বলছেন। তবে বাবা এমন সুন্দর করে কথা বলে, বিশ্বাস না করে থাকা যায় না।
অভির মুখে সামান্য হাসি ঝিলিক দিয়ে যায়।
রিফাত সাহেব অফিসে প্রথমেই বসের রুমে গিয়ে ঢুকেন। কাজের আলাপ শেষে আমতা আমতা করে আসছে মাসের বেতনটা চান। তখন বস বলেন, কি বলেন এইটা! মাস শেষ হতে এখনো বাকি, আর আপনি বেতন খুঁজছেন! আপনার কি কোন আক্কেল জ্ঞান নেই? মাস শেষ হোক, বেতন পাবেন।
বিমর্ষ মুখে বসের রুম থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন।
নিজের টেবিলে বসতে গিয়েও পারেন না। পাশের রুমের গিয়াস সাহেবের কাছে সব বলে কিছু টাকা ধার চান। কিন্তু মাসের শেষ দেখে উনিও দিতে পারলেন না। এবার তাকে সত্যিই বিপর্যস্ত দেখায়। অভির মুখ চোখে ভাসতেই তিনি আরো চিন্তিত হয়ে পড়েন।
ছেলেটাকে কতো আশা দিয়ে এসেছেন। না আর কিছু তিনি ভাবতে পারছেন না।
অফিস ছুটি হওয়ার অনেক আগে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এখন একমাত্র আশা হচ্ছেন কাজেম ভাই। তিনি সুদে টাকা ধার দিয়ে থাকেন।
তিনি কাজেম ভাইয়ের বাসার দিকে হাটা ধরলেন। কাজেম ভাইয়ের কাছ থেকে হাজারে দুইশত টাকা সুদে চার হাজার টাকা আনলেন। সুদের পরিমাণটা হয়তো বেশী, কিন্ত এই সময়ে এছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না।
বাইসাইকেলের দোকান থেকে একটি সুন্দর ছোট্ট বাই সাইকেল নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলেন। অভির হাসিমাখা মুখ ভাবতেই তার মনটা ভরে গেলো।
রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বাসার দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দিলো অভি। সে যেন বিশ্বাস করতেই পারছেনা বাবা তার জন্য সাইকেল নিয়ে এসেছেন। রিফাত সাহেব মিটিমিটি হাসছেন। অভি লাফ মেরে লাল রঙের সাইকেলটায় চড়ে বসলো। অভির আনন্দ আর খুশিতে পুরো ঘর যেন ১০০০ ওয়াটের বাতির উজ্জ্বল আলোতে ভরে উঠেছে।
অভির আনন্দে রিফাত সাহেব আর জুলিয়াকে ভীষন তৃপ্ত দেখায়। এখন যদি একমাস খেতে না ও পারেন তাহলেও কষ্ট হবেনা। দুজনের চোখে আনন্দঅশ্রু খেলা করতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।