অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা স্বাধীনতার ৪০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ডেইলি স্টার বিশেষ আয়োজন করেছিলো, বিভিন্ন খাতওয়ারী অগ্রগতি এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, আমাদের সার্বিক সামাজিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন বিষয়ে দেশের জ্ঞানীগুনীজনেরা লিখেছিলেন সেখানে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে সেখানে দেখা গেলো বাংলাদেশের আশানুরুপ অগ্রগতি হয় নি কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা পাকিস্তানের তুলনায় সামান্য এগিয়ে, আমাদের অগ্রগতির মাণাঙ্ক পাকিস্তান, আমরা তাদের তুলনায় এগিয়ে আছি সে কারণেই আমাদের আনন্দিত হতে হবে ভাবনাটা আমাকে বিব্রত করেছিলো তখন। এখনও একইরকম বিব্রত করছে ভাবনাটা।
ভারত, চীনের জিডিপি প্রতিবছর প্রায় ১০ শতাংশ করে বাড়ছে, আমাদের জিডিপি বাড়ছে প্রায় ৬ শতাংশ হারে, গৃহযুদ্ধে বিক্ষত শ্রীলঙ্কাও কোনো কোনো বিচারে আমাদের তুলনায় এগিয়ে। প্রায় ১৬ বছর গৃহযুদ্ধ সামলেও তারা নিজেদের কোমর সোজা করে সটান দাঁড়িয়ে আইএমএফের নীতির বিরোধিতা করতে পেরেছে, আমাদের ৪০ বছরের স্বাধীনতার কোনো সময়েই আমরা তেমন আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে কিছু বলতে পারি নি, আমাদের বাজেটের বহর বেড়েছে, লক্ষকোটি টাকার বাজেটেও মাত্র ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া আইএমএফ আর এডিবির সামনে আমরা নতজানু হয়ে তাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে মাথা বেচে দিয়ে আমাদের উন্নয়নকর্মসূচি সাজিয়েছি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আর্থিক অনিময়ের কারণে এবং স্বজনপ্রীতি ও টেন্ডার প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতার অভিযোগে আমাদের প্রতিশ্রুত অর্থসহায়তা প্রদান করে নি, বিষয়টা আমাদের জন্য লজ্জাজনক হলেও আমরা সে লজ্জা মেনে নিয়েই তাদের নীতিনির্ধারকদের কিংবা পরামর্শকদের পরামর্শ নিয়েই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করতে চাইছি।
আমাদের বয়স্ক শিক্ষার হার ৪০ শতাংশ কিন্তু মানসম্মত শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা শতকরা ৩০ শতাংশের বেশী হবে না। সরকার থেকে দাবী করা হয়েছিলো আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শত শতাংশে পৌঁছেছে , তবে খনা হিসেব করে দেখা গেলো সে দাবী মিথ্যা, জাতিসংঘ বলেছিলো আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশী, সদ্যসমাপ্ত আদমশুমারী অনুসারে আমাদের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৫ লক্ষ, তবে চুড়ান্ত হিসাব পাওয়া যাবে সেপ্টেম্বরের শেষে, সরকার জাতিসংঘের বিরোধিতা করতে চেয়েছিলো, পরে জাতিসংঘ নিজ উদ্যোগেই নিজেদের অনুমাণকে ভ্রান্ত স্বীকার করে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের ফলাফল মেনে নিয়েছে, পরবর্তীতে দেখা গেলো সরকারী আদমশুমারীর হিসাব প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বয়ং সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য-সদস্যাগণ। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ ফলাফল গ্রহনযোগ্য মনে করছেন না, গ্রহনযোগ্য ভাবছেন না অর্থমন্ত্রী, এমন কি তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন কোনো কোনো মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন তাদের বাসায় আদমশুমারীর স্বেচ্ছাসেবকেরা আসেন নি। তিনি বিভিন্ন রকম অনুমাণ করে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সর্বমোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশী হতে পারে। মতিয়া চৌধুরী অবশ্য বলেছেন যদি জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৫ লক্ষ হয় তবে দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই, অথচ তিনি নিশ্চিত করেছেন দেশের খাদ্যসঞ্চয়ের পরিমাণ আশানূরুপ নয়।
আমাদের ভাবমুর্তি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন মিথ্যা প্রবঞ্চনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের উদোম হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণমুক্তির সংগ্রাম করে স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের বিভিন্ন অগ্রগতি পরিমাপের একক এখনও পাকিস্তান, ঔপনিবেশিকতাকে আমরা এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারি নি। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের ঐতিহ্য মেনে নিয়ে আমরা প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতে পেরে আহ্লদে আটখানা হই, আমাদের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছুঁয়েছে কিংবা ছুঁয়ে ফেলতে পারে এই সম্ভবনা দেখে আমরা আহ্লাদিত, আমাদের স্বাধীনতার সুফল আমরা পাচ্ছি।
পাকিস্তানের মতো সামন্তবাদী রক্ষণশীল নির্বোধ দেশের সাথে বাংলাদেশের অগ্রগতির তুলনা করে আনন্দিত হওয়া নিছকই মুর্খতা। একদা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিলো পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ সম্পদ আত্মস্যাৎ করে, সেঈ আভ্যন্তরীন বাজার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আশানুরুপ হয় নি। ভারতের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক বৈরিতা, ভারতিবিরোধিতার রাজনীতি ও সামরিক নীতি, সামরিক ব্যয় এবং অন্যান্য ফাঁপা আস্ফালনের ধকল সামলাতে গিয়ে তারা দেশের দরিদ্র জনগণের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে, এমন কি তাদের জিডিপি গ্রোথও স্থবির হয়ে গিয়েছে, একই সাথে সে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান ও পৃষ্টপোষকতা, আন্তঃগোত্রীয় কোন্দল, মোহাজের এবং স্থানীয় অধিবাসীদের পারস্পরিক বৈরিতা, আন্তঃধর্মীয় সংঘাত, সব মিলিয়ে দেশটির পরিস্থিতি মোটেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির কোনো সংবেদ প্রদান করে না, পাকিস্তানে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, অতিরিক্ত বিদেশমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প স্থানীয় জনগণের কল্যান বয়ে আনতে পারে নি, এমন একটা দেশের সাথে নিজের দেশের তুলনা করা দেশের অপমান এ সত্যটা উপলব্ধি করতে চান নি আমাদের জ্ঞানীগুনী মানুষেরা।
স্বাধীনতার আগে আগে যেমন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলো মানুষ সে স্বপ্নের রঙ ফিকে হয়ে এসছে সময়ের সাথে, আমরা পাকিস্তানকে অনুকরণ করেছি, তাদের ব্যর্থ সকল পরিকল্পনা আমরা নিজেদের দেশে বাস্তবায়ন করে দেখেছি ফলাফল একই, আমাদের দেশেও সেসব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে।
স্বাধীনতার আগে আমাদের পশ্চাতপদতার একটা অজুহাত ছিলো, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পদের উপরে আমাদের অধিকার ছিলো না, আমরা আমাদের সম্পদ স্থানীয় অধিবাসীদের কল্যানে ব্যয় করতে পারছি না, আমাদের কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, আমরা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলেই দেশটা সোনার বাংলা হয়ে যাবে, আমাদের আয়বৈষম্য হ্রাস পাবে, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে,
আমরা অসংখ্য প্রাণবিসর্জন দিয়ে স্বাধীন হয়েছি, পাকিস্তান হারিয়েছে তার কামধেনু, তারা গত ৪০ বছর ধরেই অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে পিছিয়েছে, পেছাতে পেছাতে তারা এখন আমাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে, এটা একটা মাত্র বিষয়ই নিশ্চিত করে আমাদের সামাজিক অগ্রগতি আশানূরুপ হয় নি, আমাদের অগ্রগতি হয় নি এবং তারা ক্রমশ পিছিয়েছে বলে ৪০ বছর পরে হিসেব কষে আমাদের জ্ঞানীবিজ্ঞজনেরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারছেন পাকিস্তানকে অবশেষে আমরা পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। কিন্তু তারা আমাদের বলছেন না আমারা এগুতে পারি নি, তারা পিছিয়ে আমাদের সাথে এসেছিলো, এখন আরও পিছিয়েছে, এটা আমাদের স্থবিরতার নিদর্শন, আমাদের অগ্রগতির নিদর্শন নয়।
ক্রমশঃ পিছিয়ে পরা একটি দেশের সাথে নিজেদের তুলনা করে নিজেদের অপমান করে যারা যারা আনন্দিত তাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমার লজ্জা একটাই আমরা এ সত্য স্বীকার করতে চাইছি না যে আমরা স্বাধীন হয়েও নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পদের ঊপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন পেয়েও আমাদের জনগণকে স্বাধীনতার সুফল দিতে ব্যর্থ।
আমাদের সামাজিক অস্থিরতা, আমাদের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, আমাদের অন্যান্য ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘায়িত করা যায়, সেটা আমাদের ব্যর্থতা, আমরা নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি, আমাদের সাথে থাকা অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশগুলোও এগিয়ে গিয়েছে, আমরা তাদের সাথে নিজেদের অগ্রগতির তুলনা করে লজ্জিত না হয়ে পাকিস্তানকে সবদিক দিয়ে হারিয়ে আনদে নৃত্য করছি বিষয়টা নেহায়েত পাগলামি, কিন্তু পাকিস্তানকে হারানোর কঠিন সংকল্পে আমরা আমাদের ঐতিহ্য হারিয়েছি, এই ক্ষতিটুকু কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। আমরা এভাবে এগুতে থাকলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বর্বরতার দিক দিয়েও পাকিস্তানকে হারিয়ে দিতে পারি, আমাদের এখনকার সংকল্প বোধ হয় তেমনই, সে কারণেই আমাদের সার্বিক আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও আমরা উদাসীন। আমি আশাবাদী অচিরেই আমাদের এখানে গ্রামের সম্মান রক্ষায় গ্রামের কোনো নারীকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করা হবে, সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় ধর্ষিতার বিচার চায় না অনেক পরিবার, আমরা সেই ট্রেন লাইন ধরে এগুনো শুরু করেছি, আশা করছি ব্যর্থতার সবকটা স্টেশন অতিক্রম করে আমরা নিজেরাও পিছিয়ে পড়ার দিক দিয়ে পাকিস্তানের সাথে পাল্লা দিবো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।