দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা কত তা যেমন কেউ জানে না, তেমনি জানা নেই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘হিডেন হাঙ্গার’ কথাটি বেশ প্রচলিত হলেও সে সময় ক্ষুধার্ত মানুষ সনাক্ত বা তাদের কষ্ট লাঘবের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হলে দ্রব্যমূল্যের খড়গ, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান না করা ইত্যাদি কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করা হলেও জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে আড়াই থেকে তিন কোটি লোক প্রতিদিন পেট পুরে খেতে পায়না। বিপুল এ জনগোষ্ঠী ক্ষুধা নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটায়।
অথচ খোদ রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে, বাস টার্মিনালে, রেল স্টেশনে ও নৌটার্মিনালসহ জনসমাগমস্থলে ক্ষুধার্ত মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায়। ভিক্ষুক ও অন্যান্য সাহায্য প্রার্থী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সামর্থ্যবানরা ভিক্ষা কিংবা সাহায্য প্রদানে অনেকাংশে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদের অনেককেই তিন বেলার জায়গায় সর্বোচ্চ দুই বেলা খেয়ে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর কয়েকজন গবেষক বলেছে, তাদের একাধিক গবেষণায় কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ ও বিপন্ন দশায় পতিত হওয়ার বিষয়টি ওঠে এসেছে।
এদিকে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে আসছে সরকার পরিসংখ্যান দিয়েই এমন দাবি করছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও যারা প্রকৃতই ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠী তাদের কোনোই কাজে আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, চলমান বিপুলসংখ্যক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির সুবিধাভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে প্রকৃত অভাবী বা ক্ষুধার্ত মানুষগুলো বরাবরই এসব কর্মসূচির বাইরে থেকে যায়।
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু আছে এমন পরিবারগুলোর শতকরা ৭৫ ভাগের উপর খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। বেড়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দুই-ই।
দি ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স প্রজেক্টের (এফএসএনএসপি) আওতায় পরিচালিত এক জরিপের তথ্য এটি। জরিপটি পরিচালনা করেছে জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
জরিপে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪৫ শতাংশের কম। মাত্র এক বছর পর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যেসব পরিবারে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু আছে, তাদের ৭৫ শতাংশ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়ার হার ছিল ৬৯ শতাংশ।
২০১০ সালে ১৬ শতাংশ পরিবার ক্ষুধার্ত ছিল, ২০১১ সালে তা ওঠে ৩১ শতাংশে।
এই গবেষণায় ক্ষুধার্ত বলতে বোঝানো হয়েছে এমন একটি অবস্থাকে, যখন এক-দুই দিন থেকে শুরু করে ১০ দিন পর্যন্ত মানুষের কাছে খাবার ছিলনা বা খাবার কিনে খাওয়ার মতো টাকা-পয়সা ছিলনা। আর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন এক পরিস্থিতিকে, যখন মানুষ ৩-১০ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত খাবার পায়নি।
অপরদিকে বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যের সাথে চলতে গিয়ে রীতিমতো হাফিয়ে উঠেছে। তারা এর প্রতিকার চেয়ে বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আর্কষণের চেষ্টা করছে।
জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মিছিল-মিটিং করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার জনগণের দাবি পূরণে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সম্প্রতি সরকারের দুই দায়িত্বশীল মন্ত্রীর বালখিল্য বক্তব্য দেশবাসীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছে, একদিন বাজারে না গেলে কি হয়? বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছে, আপনারা কম খান। সে হয় তো ভুলে গিয়েছিল, তার বাসায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত রান্না হলেও, সে যে দেশের মন্ত্রী সেই দেশের খাদ্য গ্রহণ প্রসঙ্গে এক নির্মম সত্য বের হয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) গবেষণায়।
এ প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৫৪ জন অপুষ্টিতে মারা যায়। প্রয়োজনীয় খাদ্য না পাওয়ায় হাজারে ৪৩ জন শিশু বয়স অনুযায়ী বড় হয় না, যা বিশ্বের মোট বড় না হওয়া শিশুর ৪ শতাংশ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ২০০৯ সালে পরিচালিত বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা-পরিস্থিতি বিষয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে দুই হাজার ২২২ ক্যালোরি খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এর চেয়ে কম ক্যালোরি খাবার গ্রহণ করে, এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর উল্লিখিত গবেষণার ফলাফল দেখার পর নিশ্চয়ই মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে আর ঠাট্টা করবে না।
আমরাও আশা করি, মন্ত্রীগণ কথা নয় কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা দেখাবে। দ্রব্যমূল্যের নির্মম কষাঘাত থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এক্ষত্রে তারা ব্যর্থ হলে তাদের পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।