বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
বিশ শতকের চলচ্চিত্র জগৎকে যারা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছেন ইঙ্গমার বার্গম্যান তাদের অন্যতম। শুধু একটি দেশ বা একটি ভাষার নয়, নানা দেশ ও নানা ভাষায় প্রজন্মের পর প্রজন্মের ফিল্মমেকারদের তিনি প্রভাবিত করেছেন। আমেরিকার পরিচালক উডি অ্যালেন ও রবার্ট আল্টম্যান, রাশিয়ার আন্দ্রেই তারকোভস্কি, জাপানের আকিরা কুরোসাওয়া তাদের কাজে বার্গম্যানের প্রভাব সরাসরি স্বীকার করেছেন। উডি অ্যালেন তো বলেই দিয়েছেন চলচ্চিত্রে সংলাপের যুগ শুরু হওয়ার পর বার্গম্যানই সম্ভবত সেরা ফিল্মমেকার।
২০০৭ সালের ৩০ জুলাই বিশ্ব চলচ্চিত্রের এ কিংবদন্তি মৃত্যুবরণ করেন সুইডেনের বাল্টিক উপকূলের ছোট দ্বীপ ফারোতে।
আর জন্মেছিলেন ১৯১৮ সালের ১৪ জুলাই সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর নামে পরিচিত উপশালায়। বাবা সুইডেনের রাজার ধর্মযাজক হওয়ায় ছোটবেলা থেকে তিনি বেড়ে ওঠেন ধর্মীয় আবহে। তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাব তার চলচ্চিত্রগুলোতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বার্গম্যান তার কাজগুলোকে বহুলাংশে আত্মজৈবনিক বলেই উল্লেখ করেছেন। তার জীবন আবর্ত হয়েছিল ছেলেবেলায় প্রজেক্টর, তারুণ্যে মঞ্চ আর পরিপূর্ণ যৌবনে ক্যামেরা দিয়ে।
চলচ্চিত্রে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটা তাই অস্বাভাবিক ছিল না।
বার্গম্যানের কাজের বিস্তৃতি ছিল বহুমুখী। কোনো নির্দিষ্ট ধারার মধ্যে তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি একাধারে যেমন 'স্মাইলস অব এ সামার নাইটের' মতো কমিক বানিয়েছেন, তেমনি তার হাত দিয়ে এসেছে 'দি সেভেনথ সিল'-এর মতো ভয়ঙ্কর চলচ্চিত্র যেখানে তিনি দেখিয়েছেন মৃত্যুর সঙ্গে মানবের লড়াই । তিনি নির্মাণ করেছেন মারাত্মক রোগগ্রস্ততার ছবি 'ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারস' আর পারিবারিক আবহের অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ছবি 'ফানি অ্যান্ড আলেকজান্ডার'।
তবে চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালে 'ক্রাইসিস' চলচ্চিত্রটি দিয়ে। বার্গম্যান ৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে বেদনা ও নিদারুণ যন্ত্রণা, কামনা ও ধর্ম, শয়তান ও ঈশ্বর, নারী-পুরুষের প্রেমসহ ভাববাদ ও বস্তুবাদের নানা দিক। চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে, তিনি ১৯৫০-এর দশকে চলচ্চিত্র জগতে নতুন সচেতনতা এনেছিলেন। সত্তরের দশকে তার নির্মিত থ্রো এ গ্গ্নাস ডার্কলি, উইন্টার লাইট আর দি সাইলেন্স চলচ্চিত্র তিনটিতে সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা ও অনাস্থার ধূম্রজাল।
চলচ্চিত্রবোদ্ধারা ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে সর্বকালের সেরা ট্রিলজির স্থান দিয়েছেন এ তিনটি চলচ্চিত্রকে।
ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা টারভেরনিয়ারের মতে, 'বার্গম্যান প্রথম পরিচালক যিনি পর্দায় অধিবিদ্যা, ধর্ম, মৃত্যু ও অস্তিত্ববাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তবে বার্গম্যানের সবচেয়ে বড় অবদান হলো নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়ে তার অভিমত। তিনি হচ্ছেন বিশুদ্ধতা সন্ধানী একজন খননকারী। '
বার্গম্যান চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজের জন্য তিনটি অনুশাসন ঠিক করে রেখেছিলেন_ চলচ্চিত্র বানিয়ে সব সময় আনন্দ দাও, শৈল্পিক চেতনাকে সর্বদা ধারণ কর আর চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় মনে রেখ এটাই তোমার শেষ ছবি।
চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। অস্কারে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে তার নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে_ 'দ্য ভার্জিন স্প্রিং' [১৯৬০], থ্রো এ গ্গ্নাস ডার্কলি [১৯৬১], 'ফ্যানি অ্যান্ড আলেক্সান্ডার' [১৯৮৩]। তার নির্মিত 'ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ' চলচ্চিত্রটি ১৯৬০ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের গোল্ডেন গ্গ্নোব পুরস্কার জয় করে। ১৯৫৮ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'ব্রিংক অব লাইফ' চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান।
চলচ্চিত্র ইঙ্গমার বার্গম্যানের কাছে ছিল ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের মতোই একটি কাজ।
বার্গম্যান জানতেন কীভাবে চলচ্চিত্রকে কবিতায় রূপ দিতে হয়। তার জীবনদর্শন ছিল_ ভালোবাসার মাঝেই ঈশ্বরের বসবাস বা ঈশ্বরের মাঝেই ভালোবাসার বসবাস। ঠিক তেমনি বলা যায়, সিনেমার মাঝেই বার্গম্যানকে পাওয়া যায় আর বার্গম্যান মানেই সিনেমার কাব্যময় ভাষা।
(তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)
(১৪ জুলাই ২০১১ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)
চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।