২.
আনিস কে ফোন দিয়ে বললাম, কিছু মনে করনা শরীরটা বড় বেশি ক্লান্ত লাগছে। আমি বাসায় ফিরছি।
বাসায় ফিরে খুব নিঃসঙ্গ লাগলো। ঘরের বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে করলো না। বারান্দার চেয়ারে বসে রইলাম।
রাস্তায় গাড়ি চলছে দ্রুত। হর্নের শব্দ। রিকসার টুংটাং শব্দ। কিছুই ভাল লাগছে না আজ। পাশের তিনতলা ভবনের এর ছাদে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে।
উচ্চশব্দে গান বাজিয়ে নেচে চলছে উচ্ছল তরুণ তরুণীরা। যৌবনের উচ্ছাস দেখেও ভাল লাগছে না। এত কোলাহলের ভেতরও নির্জীব পড়ে রইলাম চেয়ারে। কোন কিছুই আজ স্পর্শ করছেনা আমাকে।
সোফিয়া কি এখনও আমায় ভালবাসে? সে কি সত্যি আমাকে কোন দিন ভালবেসে ছিল, নাকি সবি ছিল তার খেলা! নারী হৃদয় বড় বেশি বৈচিত্রময়।
নারীদের মুখের কথার সাথে তাদের মনের কথার কোন মিল নেই।
হটাৎ করেই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো। তির্ব বাতাসের শো-শো শব্দে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ছাদের উপরের গান বাজনা বন্ধ হয়ে গেল। বাতাসে প্যান্ডেলের কাপড় গুলি উড়ছে।
বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করলো। সব শব্দ পেড়িয়ে এখন শুধু রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ।
সোফিয়া অংক খুব ভাল বুঝতো। আমাদের ক্লাসে ও ছিল ফাষ্ট র্গাল। আমি তেমন ভাল ছাত্র ছিলাম না।
তাই ওর সাহায্য সহযোগীতার প্রয়োজন হত। ও আমার প্রতিবেশি হবার সুবাদে ওদের বাড়িতে আমার অবাধ বিচরন ছিল। ওরা অনেক ধনী পরিবার ছিল কিন্তু আমাদের দু’পরিবারের মধ্যেই ভাল সর্ম্পক ছিল। ওর মা আমাকে খুব ভাল জানতো। সন্ধার পর মাঝে-মধ্যে ওদের বাড়িতে চলে যেতাম।
পড়তাম গল্প করতাম। রাতে একসাথে খেয়ে রাত ১০টার দিকে বাড়িতে ফিরতাম। গ্রামে রাত দশটা অনেক রাত মনে হত। ঝিঝি পোকার ঝিঝি শব্দের ডাক। কখনো বা বাদুরের পাখা ঝাপটিয়ে হুট-হাট উড়ে যাওয়া।
ডাহুকের ডাকে চমকে উঠা! একপাল শেয়ালের একসাথে কেঁদে উঠা। সব কিছু যেন স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে আজ। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম দু’জন। খেয়াল করলাম ওর হাত ধরে থাকতে ভাল লাগে। ওর মুখের দিক তাকালে বুকের ভেতর কেমন যেন করে।
সারাক্ষণ ওরে ভাবতে ভাল লাগে। তখনও বুঝতে পারিনি যে আমি ওর প্রেমে পড়েছি।
তারপর স্কুল জীবন শেষ করে কলেজে উঠলাম।
সেদিনটা আমি কখনই ভুলতে পারবো না। ১১টার মত বাজে।
আমাদের বরহামগঞ্জ কলেজের সামনে যে সারি-সারি দেবদারু গাছ ছিল, সেখান থেকে ও আমাকে ধরে নিয়ে গেল মাঠের শেষ কোণায়। ওর হাত পা কাপঁতে ছিল। কথা বলছিল হাপিয়ে হাপিয়ে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? ও বললো, আচ্ছা ফয়সাল তুই কি কখনো রাতে আমাকে স্বপ্ন দেখিস? আমি মাথা দুলিয়ে বললাম হ্যা দেখি, তো?
- তোর কি সব সময় আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে?
হ্যা। তুই এবার যখন তোর মামা বাড়ি গিয়ে পঁনেরো দিন থাকলি তখন আমি শুধু রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
ও তখন স্বস্তির হাসি হাসলো। আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও আমার হাত ধরে বললো, বোকা আমরা দু’জন প্রেমে পড়েছি!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম সর্বনাশ! মা জানলে খবর আছে।
ড্যামকেয়ার ভাবে ও বললো, বাচ্চাদের মত কথা বলবি না। আমি তোর প্রেমিকা।
মনে থাকে যেন।
তারপর নিলর্জ্জের মত বললো, আই লাভ ইউ মাই ডিয়ার ফয়সাল!
জীবনের সেই দুরন্ত প্রথম প্রেম আজ বাদল দিনে রঙ্গিন পর্দার মত চাখের সামনে ভেসে উঠলো।
হটাৎ করে মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠায় এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরে এলাম। বৃষ্টি এখনও নামছে অঝর ধারায়। ডিসপ্লেতে অচেনা নাম্বার।
ধরতে ইচ্ছে হলনা। রুমে এসে বাতি অন করলাম। ফ্যান অফ করলাম শীত শীত লাগছে। টিভি চালিয়ে দেখি ডিস সংযোগ নেই। ঝড়ে ক্যাবল কানেকশন ছিড়ে গিয়েছে হয়ত।
কি করবো? ভাল লাগছে না। আবার একই নাম্বার থেকে কল এল। রিসিভ করতেই সোফিয়ার কন্ঠ। কি করছো?
- কিছুনা। বসে আছি।
- তাহলে ফোন ধরলেনা কেন?
- খেয়াল করিনি।
- তোমাদের ওখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে না?
- হুম, মুষলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
- কি ভাবছো?
সোফিয়া নিরর্থক হেসে উঠে। দুরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হয়। আজ সারা রাত ধরে হয়ত এই বর্ষণ চলতে থাকবে।
নামুক বৃষ্টি, ভাসিয়ে দিক শুকনো বুকের শহরটাকে। পবিত্র পানির র্স্পশে পবিত্র হোক সব। ও প্রান্ত থেকে সোফিয়া অধের্য্য হয়ে বলে, কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন?
এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে পরে আমি ফোন দিচ্ছি।
ও দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়ে।
তারপর হতাশা ভরা কন্ঠে বলে, তুমি কিন্তু একবারও জানতে চাইলে না কেন সেদিন তোমাকে আমি আমার জীবন থেকে সরে যেতে বলে ছিলাম। আসলে সব কিছু জানলে তুমি.....
আমি ওরে থামিয়ে বলি, বাদ দাও বিশ্বাস কর আমার তাতে কোন কৌতুহল নেই। ওসব শুনে আর কি হবে বলো?
ঃ তা ঠিক এখন আর আমার কিছুই যে অবশিষ্ট নেই। ও ভারী কন্ঠে নিজের বিসন্নতা আড়াল করে।
আমার কানে বাজে ওর কথা সত্যিই তো আজ আর কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই।
বুকের ভেতরে জমে থাকা ভালবাসা গুলি কাঁন্না হয়ে বালিশে শুকিয়ে গিয়েছে যেন। আমি ভুলে গিয়াছি আমার প্রথম ও একমাত্র ভালবাসা কে। এ হৃদয় যেন সাহারা মরুভুমি!
দরজায় ক্রমাগত কড়া নড়ার শব্দে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলতেই কাক ভেজা হয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে আনিস। আমি মুচকি হেসে বলি, কি বৃষ্টি বিলাসে মেতে ছিলে বুঝি? আনিস কপট রাগের ভাব নিয়ে বলে ভাইরে এই দু:সময়ে সাহিত্য করোনা! শীতে কাঁপছি। জ্বর না এলেই হয়।
কিছুক্ষণ পর ও দুই মগ চা নিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করে। চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ফয়সাল তুমি কি জানো মেয়েরা আসলে কি চায়?
কেন?
আমার বউয়ের কথা ধর, তারে আমি কত ভালোবেসে ছিলাম। কত কিছু দিয়ে ছিলাম। চলে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে হাসি খুশি ছিল। সে যে আমাকে নিয়ে অসুখি একবারও তা বুঝতে দেয় নি।
প্রতারক!
- বৃষ্টির রাতে এসব দু:খের কথা মনে করে বিষন্ন হবার কি দরকার? ডিভিডি তে কালকের আনা ছবিটা চালাও। ভাল সিনেমা মন ভাল করে দেয়।
সিনেমা চলছে র্ফম প্যারিস উইথ লাভ। গল্পে দেখা যায় নায়ক পুলিশ অফিসার আর তার নিজের স্ত্রীই তার চরম শত্রুর এজেন্ট। ছবি থেকে মন সরে যায়, আসলে চোখ ঘোরানো সহজ মনকে ঘোরানো সহজ নয়।
আমি ভাবতে থাকি সোফিয়ার কথা। আনিসও হয়ত ভাবছে ওর চলে যাওয়া অবিশ্বস্থ বউয়ের কথা। আনিসের বউ বিয়ের ছয় মাসের মাথায় তার পুরনো প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। ও প্রতিজ্ঞা করেছে বাকি জীবন আর বিয়ে করবেনা। আর আমি কী করবো তা আমার জানা নেই।
সোফিয়া কি বলবে? ওকি ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার জীবনের যন্ত্রণাময় দশটা বছর? রাতের পর রাত ওর জন্য নির্ঘুম কাটানো আর বুকের পাজরে লুকানো নীল যন্ত্রণার সমুদ্র!
মোবাইলের ডিসপ্লেতে ওর এসএমএস ভেসে উঠে। ও লিখেছে, চলতি পথে আবার দু’জনার দেখা হল, এ নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। বাকিটা পথ চল এক সাথে পাড়ি দেই।
উত্তরে আমি লিখি, শুকিয়ে যাওয়া নদীতে নৌকা চলে না। মরুভুমি হয়ে গেছে আমার হৃদয় নহর।
সেখানে আর তোমার জন্য কোন ভালবাসা নেই। তোমাকে ভুলে গিয়েছি আমি। তোমার সাথে কথা বলারও ইচ্ছে নেই আমার। ভুলে গিয়েছিলে ভুলেই থাক বাকিটা জীবন...।
বারান্দায় কান্নার শব্দ।
হাউমাউ করে বাচ্চাদের মত করে কাঁদছে আনিস। ও এমন করে প্রায় কাঁদে। হায় ভালবাসা তুমি কত নিষ্ঠুর!
সোফিয়াকে কঠিন কথা গুলো শুনাতে পেরে মনটা হালকা লাগছে। আমি অন্ধকারে তাকিয়ে ভাবছি কে বেশি কালো অন্ধকার নাকি সোফিয়াদের হৃদয়?
প্রথম অংশ পড়তে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।