আমি মানুষ
নামাজ শব্দটি মূলত: ফার্সি। আরবীতে বলা হয় সালাত। তত্কালীন ভারতবর্ষে মোঘল সম্রাটদের প্রভাবে ফার্সি প্রশাসনিক ভাষা হিসাবে ব্যবহারিত হয়। সঙ্গত কারণে এদেশের অধিবাসীরা ফার্সি শব্দকে নিজ নিজ মাতৃভাষায় গ্রহণ করে নেয়। সেরূপ নামাজ শব্দটিকেও বাংলার মানুষ বাংলা শব্দ হিসাবে গ্রহণ করে নেয়।
নামাজ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে এদেশের মুসলমানগণ এর স্বরূপ নিজেদের মাঝে আত্মস্থ করে নেয়। শুধু আনুষ্ঠানিকতাই নয় এর ব্যবহারিক ও আত্মিক বিষয়াদি নিয়াও সবিশেষ আলোচনা হতে থাকে। দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একাগ্রচিত্তে স্রস্টার সমীপে আত্মসমর্পণই এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য।
মানব শরীর বস্তুভিত্তিক। প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অঙ্গাংশ সমন্বয়ের মাধ্যমে যাতে করে এক কেন্দ্রিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারে বস্তুভিত্তিক বিশ্লেষণে তাই প্রতিফলিত হয়।
সার্বিক বিচারে সমাজের বাহ্যিক, আত্মিক ও তাত্ত্বিক স্বরূপ রয়েছে। সাধারণ জ্ঞানে প্রতীয়মান হয় যে, শরীর সুস্থ থাকলে মন সুস্থ থাকে সাথে সাথে আত্মিক উপলব্ধিও সজিব হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের বিচার বিশ্লেষণে একটি প্রশ্ন উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, নামাজ যদি শুধু স্রষ্টাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে তাহলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নিয়মতান্ত্রিক সঞ্চালনের প্রয়োজন কোথায়? এ প্রশ্নটির বিশ্লেষণ এভাবে করা চলে। মুসলমানদের হাদিস শাস্ত্রের বিধি মোতাবেক সাত বছর বয়সে নামাজকে অবশ্য করণীয় হিসাবে গণ্য করা হয়। শরীরতত্ত্ববিদ্যায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, মানব শিশুর মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে তার শারীরিক অবকাঠামোতে ২১১টি পৃথক পৃথক হাড় খন্ডের অবস্থান থাকে।
ক্রমে ক্রমে ৫টি হাড় অন্য ৫টি হাড়ের সঙ্গে মিশে যেয়ে যে ৩-৬ বছর বয়সের মধ্যে মোট ২০৬টি হাড়ে অবস্থান নেয়। এক খন্ডের সঙ্গে অন্য খন্ডের সুবিন্যাশের ব্যবস্থা রয়েছে। সে এক অদ্ভুত রহস্য। এতে করে মূলত বেশির ভাগ হাড়ই মানব দেহে কব্জার মত কাজ করে। তা সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হয়ে থাকে না।
সে জন্য আমরা যেমনি খুশি হাত দিয়ে ধরা ছোঁয়ার কাজ করতে পারি। হাতের কব্জি নাড়াতে পারি। ঘুরাতে পারি। বাঁকা করতে পারি সোজা করতে পারি। প্রয়োজনে সবদিকে ঘুরাতেও পারি।
ঠিক একই অবস্থায় পায়ের আঙ্গুল, পায়ের পাতা, হাঁটু পায়ের গীট এবং কোমরের সঙ্গে তার যে সংযোগ সবগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করার ব্যবহারিক সুবিধার জন্য অত্যন্ত সুন্দর সাবলীলভাবে কাজ করে। এছাড়াও মেরুদন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত মাথা সামনে পিছনে উভয় পার্শ্বে নড়াচড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মাথা থেকে মূল স্পাইনাল কর্ড মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। স্নায়ুর মাধ্যমে আমরা স্পর্শানুভূতি প্রাপ্ত হই। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কার্যকর রাখতে রক্ত সঞ্চালনের জন্য পাম্প মেশিন হিসাবে কাজ করে।
দূষিত রক্ত সমস্ত শরীর থেকে মূল শিরা-উপশিরার মাধ্যমে হূিপন্ডে আসে এবং হূিপন্ড সেই দূষিত রক্তকে বিশুদ্ধ করতে ফুসফুসে পাঠায় এবং পরে রক্ত বিশুদ্ধ হয়ে ফুসফুস থেকে হূিপন্ডে আসে। হূিপন্ড পাম্প করে ধমনী উপধমনীর মাধ্যমে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে ছড়িয়ে দেয়। শ্বাসনালীর বাতাস থেকে অম্লজান (অক্সিজেন) ফুসফুসে যেয়ে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তকে বিশুদ্ধ করে। বিশুদ্ধ রক্তের বর্ণ টগবগে লাল। তেমনিভাবে অশুদ্ধ রক্তের বর্ণ খানিকটা কালছে।
হাতের উল্টা পিঠে লক্ষ্য করলে যে কালো বর্ণের শিরা দেখা যায় তার মাধ্যমে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয়। ধমনী বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে বলেই লাল দেখায়। যদিও উভয়েই রক্ত পরিবহন ব্যবস্থায় জড়িত। সারা অঙ্গ জুড়ে একই অবস্থান। এ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় সুপরিকল্পিত নির্দেশনা মাফিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করে চলে এবং বস্তুভিত্তিক মানব দেহের সমস্ত কর্মকাণ্ড অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোল তথা মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
শরীর সুস্থ রাখতে মন এবং দেহের সুসমন্বিত কার্যক্রম চলতে থাকে। এটাই সৃষ্টির রহস্য। এই ব্যাপক বিষয়টি নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত জটিল তবে মনের অবস্থান কারো পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভবপর নয় এবং আরেকজনকে মন দেখানোও সম্ভব নয়। মন ও দেহের এক অন্তর্নিহিত ভাষা রয়েছে। দেহের সঞ্চালনের মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়।
বাকযন্ত্র থেকে যেভাবে শব্দ বেরিয়ে এসে কথা সৃষ্টি করে। সেই কথায় পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদান হয়। তেমনিভাবে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নির্বাক ভাষাও রয়েছে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় body language। মন চাইলেই দেহের ঐ নির্বাক ভাষাও প্রকাশ পায় আবার সবাক ভাষার জন্যও মনের করণীয় অনেক।
জীবন দর্শনে দেহ-মনকে সুস্থ রাখার জন্যে আত্মার প্রয়োজন। অনেকভাবে বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এই আত্মাকে বুঝানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। মুসলমান দার্শনিকরা এই আত্মাকে রুহ হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেন। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা বিজ্ঞানময় আল কুরআনের ১৭নং সুরা আল ইসরার ৮৫নং আয়াতে নবী (স.)কে উল্লেখ করে বলেন- যখন তোমাকে কেউ রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে তখন বলে দাও এটা তোমার স্রষ্টার তরফ থেকে একটি আদেশমাত্র। এ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান তোমাদের দেয়া হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা কুরআনে নামাজ কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন। কায়েম বলতে নামাজকে বিশেষ প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে নিজের দেহ, মন ও আত্মার মাধ্যমে স্রষ্টার সমীপে আত্মসমর্পণ করা। এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ শরীর সজিব রাখা। অমুসলিম দার্শনিকেরা বিভিন্ন যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় ঘটানোর বিশ্লেষণ করে থাকে। ব্যাপারটি অবৈজ্ঞানিক নয়।
বর্ণিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে এটা বলা মোটেও অমূলক নয় যে, নামাজের বিভিন্ন ধাপে শরীরকে সুস্থ রাখার এক অন্তর্নিহিত ব্যবস্থা রয়েছে। কাজেই শুধু বসে,দাঁড়িয়ে ও শুয়ে যপ তপ করা বা স্রষ্টাকে স্মরণ করা বা মন হূদয় দিয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার এটা লক্ষ্য নয়। নবী করিম (স কে আল্লাহতায়ালা জিব্রাইলের মাধ্যমে নামাজের ধাপগুলো শিখিয়েছেন। এগুলো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, নামাজে দাঁড়ানোর সময় রুক,ু সেজদা এবং বসার যে ইঙ্গিত রয়েছে সেটা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হলে শরীরের প্রতিটি হাড় খন্ডের সংযোগগুলো নড়াচড়ার মাধ্যমে শরীর উজ্জীবিত হয়। সংক্ষেপে বলা চলে যে, নামাজের ধাপগুলোর মাধ্যমে একটি ভালো ব্যায়াম প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।