জোট সরকারের সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করায় নাইকোকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা করেছেন কানাডার একটি আদালত। শুক্রবার কানাডার ক্যালগারির আদালতে এ অর্থ জরিমানা করা হয়। সে সঙ্গে নাইকোর আগামী তিন বছরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ জরিমানার ঘটনায় টরন্টো স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য পড়ে যায়। কানাডার আদালতের এ আদেশ বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
কানাডার জনপ্রিয় বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস এ এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়-
সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডের ক্ষতিপূরণ এড়াতে ঘুষ হিসেবে বিএনপির সাবেক ওই প্রতিমন্ত্রীকে একটি দামি গাড়ি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য নগদ অর্থ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে নাইকোর গাড়ি কেলেঙ্কারির ঘটনা এদেশের পত্রিকার মাধ্যমে ফাঁস হলেও সে সময় নাইকো অভিযোগটি স্বীকার করেনি। তৎকালীন জোট সরকার এ অভিযোগের কারণে প্রতিমন্ত্রী মোশাররফকে অব্যাহতি দেয়। অবশেষে ৬ বছরের পুরনো ওই অভিযোগ নাইকো কানাডার আদালতে স্বীকার করে নিল।
গত শুক্রবার কানাডার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হয়। নাইকো কানাডার একটি তেল-গ্যাস কোম্পানি।
পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র দেখিয়ে ফেনী ও টেংরাটিলায় নাইকোকে অপারেটর নিয়োগ করার ঘটনা নিয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এদেশের আদালতে দুটি মামলা করে দুদক। এর একটিতে বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ কয়েকজন এবং অন্যদিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। উভয় মামলায় আসামি হন নাইকোর তখনকার বাংলাদেশ প্রধান এবং বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর ভাগ্নে কাশেম শরীফ।
ড. তৌফিক ও ব্যারিস্টার মওদুদ আপন ভায়রা। মামলা দুটির মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গত বছর ১১ মার্চ হাইকোর্টে বাতিল হয়। খালেদা জিয়াসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি এখনও চলছে।
রায়ে যা বলা হয়েছে : ঘুষ দেওয়ার জন্য শুক্রবার কানাডার ক্যালগারির আদালত নাইকোকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা করেন। জরিমানার এ অর্থ ৩০ দিনের মধ্যে দিতে হবে।
রায় অনুযায়ী, জরিমানার ১৫ শতাংশ অর্থ পাবে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। শুধু জরিমানাই নয়, আদালত নাইকোর কর্মকান্ড আগামী তিন বছর পর্যবেক্ষণে রাখবে। যা প্রতিষ্ঠানটি মেনেও নিয়েছে।
রায়ে বিচারক স্কট ব্রুকার বলেছেন, বিদেশি সরকারকে ঘুষ দেওয়ার এ ঘটনা কানাডার জ্বালানি রাজধানী বলে খ্যাত ক্যালগারির জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ঘুষের এ বিষয়টি কোম্পানির অংশীদারদের জন্য যেমন অবমাননাকর, তেমনি কানাডাবাসীর জন্য বিব্রতকর।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এ জরিমানা বেশি নয় বলে মন্তব্য করেছেন মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি স্টিভেন জনস্টোন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারে যেখানে নাইকোর ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে, সেখানে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা বেশি কিছু নয়। তবে এর মধ্য দিয়ে আইন যে কাউকে ছাড় দেয় না সে বিষয়ে ব্যবসায়ী মহল একটা বার্তা পাবে।
রায়ের পর কানাডাভিত্তিক কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যাড স্যাম্পসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, তখন যা হয়েছিল (ঘুষ দেওয়া), তা ভুল হয়েছিল। আমরা তা স্বীকার করছি।
আদালতেও বিষয়টি স্বীকার করে নাইকো বলেছে, ২০০৫ সালের মে মাসে একেএম মোশাররফকে প্রায় ২ লাখ ডলার দামের একটি টয়োটা ল্যান্ড ত্রুক্রজার উপঢৌকন দেয় তারা। এরপর তাকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ বাবদ ৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়। ওই সময় ক্যালগারিতে এক জ্বালানি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন। সে সময়ই এ অর্থ লেনদেন হয়।
কানাডার একটি পত্রিকা জানায়, অবৈধ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নাইকোর পক্ষ থেকে একেএম মোশাররফ হোসেন একটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং নাইকোর খরচায় কানাডার ক্যালগারি ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রমোদ ভ্রমণের সুবিধা নেন।
গত প্রায় ৪ বছর ধরে রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের একটি বিশেষ দল বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে তদন্ত করে একেএম মোশাররফকে নাইকোর ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। আর তাকে ঘুষ দেওয়ার কাজটি সম্পাদনে জড়িত থাকার কারণে ফেঁসে গেছেন কানাডিয়ান সিনেটর ম্যাক হার্ব। তিনি তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে একাধিকবার সফর করেন। যা কানাডা সরকারের বিশ্বাস ভঙ্গ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত। সিনেটর হার্ব আইন পরিষদের সদস্য পরিচয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নাইকোর পক্ষে কাজ করেছেন যা ওই সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন কানাডিয়ান হাইকমিশনারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
হাইকমিশনার ওই সময়ে হার্বের হোটেল কামরায় গিয়ে তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তদন্ত সংস্থাকে তিনি জানান, 'হার্ব আমাকে না জানিয়ে রাতের আঁধারে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় মিটিং করেন। তিনি আমাকে মিটিং সম্পর্কেও কিছু জানাননি। ' কানাডা পুলিশ সিনেটর হার্বের ওই সময়ে বাংলাদেশ সফরকে 'জনস্বার্থের বাইরে অন্য উদ্দেশ্যে' বলে উল্লেখ করেন।
আদালতে দেওয়া এক বিবৃতিতে নাইকো জানিয়েছে, ২০০৫-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে মোশাররফকে ঘুষ দেওয়া বাবদ তাদের কাজ হাসিল করাতে সিনেটর হার্বকে ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছিল।
নাইকোর আইনজীবী ক্রিস্টিন রবিডুয়াক্স রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, এ সাজা প্রতিষ্ঠানটির ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত। আদালতের এ রায়কে স্বাগত জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কানাডার প্রেসিডেন্ট জেমস কটজ সাংবাদিকদের বলেন, অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে, এমন ধারণা এখন আর কোম্পানিগুলো করতে পারবে না।
মোশাররফ যা বললেন : কানাডার আদালতে নাইকোর স্বীকারোক্তি এবং জরিমানার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বর্তমানে ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) বিএনপির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন দ্য বেঙ্গলি টাইমস ডটকমের কাছে নাইকোর কাছ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গেই তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। জেভিএ অনুযায়ী গাড়িটি বাপেক্সকে কিনে দেওয়া হয়েছিল।
তাকে শুধু সরকারিভাবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। এ সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে ব্যবহারের জন্য একটি পুরনো গাড়ি দেওয়া হয়। এজন্য তিনি বাপেক্সের কাছে ব্যবহারের জন্য একটি নতুন গাড়ি চান। গ্যাসক্ষেত্র দুটিতে বাপেক্স নাইকোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করে।
এজন্য বাপেক্স নাইকোর কাছ থেকে নতুন গাড়িটি নিয়ে দিলেও আমি তা ফিরিয়ে দিই। একইভাবে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি কানাডার আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ওই আদালতই দুর্নীতিগ্রস্ত। এজন্য তাদের দেশের কোম্পানির কাছ থেকে জরিমানা নিয়ে তাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে। আইন অনুযায়ী নাইকো যদি ঘুষই দিয়ে থাকবে তাহলে তো তাদের জেল দেওয়ার কথা।
তাছাড়া কানাডা থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি বলেও তিনি জানান। কানাডার আদালতের রায়ে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আইনগতভাবে কিছু করা যায় কি-না তা জানতে আইনজীবীর সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন।
মামলা করতে পারে দুদক : এর আগে একেএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেটি ফেনী ও টেংরাটিলাকে পরিত্যক্ত (প্রান্তিক) গ্যাসক্ষেত্র দেখিয়ে নাইকোকে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার ঘটনায় দায়ের হয়। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দায়ের করা ওই মামলায় দেশের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানি নাইকোকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রের ১০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করার অভিযোগে ওই মামলাটি করে দুদক। তবে কানাডার আদালতে নাইকোর স্বীকারোক্তির পর একেএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে আরও মামলা করতে পারে দুদুক।
কানাডার আদালতের রায়ের সূত্র ধরে এ মামলা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল সমকালকে বলেন, নাইকো নিয়ে তার (একেএম মোশাররফ হোসেন) বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলা রয়েছে। কানাডার আদালতে নাইকো যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এজন্য নতুন করে আইনগতভাবে কী করা যায় তা দেখে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পেছন ফিরে দেখা : ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাপেক্সের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্টের (জেভিএ) মাধ্যমে নাইকো রিসোর্সেস ফেনী ও ছাতক (টেংরাটিলা) গ্যাসক্ষেত্র দুটিতে অপারেটরের দায়িত্ব পায়।
এদিকে গ্যাসের দাম ঠিক না হলেও ২০০৪ সালের শেষ দিকে ফেনী ক্ষেত্র থেকে সরকার গ্যাস কেনা শুরু করে। পেট্রোবাংলা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ২ দশমিক ১০ ডলার দিতে চাইলেও নাইকো ২ দশমিক ৩৫ ডলার দাবি করে। এ অবস্থার মধ্যে ২০০৫ সালের প্রথম দিকে টেংরাটিলায় কূপ খননের সময় অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের দাবি করা ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার কৌশল হিসেবে সে সময় তখনকার জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দেয় নাইকো। এ খবর তখন সমকালসহ অন্য পত্রিকায় ছাপা হয়।
তখন তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। এর আগে কানাডাও সফর করেন তিনি। ২০০৫ সালের ১৭ জুন একেএম মোশাররফকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে নাইকো : এদেশ থেকে এখনও কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়নি নাইকো। ঢাকায় তাদের অফিসও রয়েছে।
গ্যাসের মূল্য প্রদান বন্ধ থাকায় ফেনী ক্ষেত্রে তারা নিজে থেকেই উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। শেষ দিকে ওই ক্ষেত্র থেকে দৈনিক চার-পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। আর ক্ষতিপূরণ মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ইকসিডে মামলা হওয়ায় টেংরাটিলায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ওই ক্ষেত্রে কূপ খনন করতে গিয়ে নাইকো দুই দফা অগ্নিকাণ্ড ঘটায়।
নাইকো কানাডার এক কর্মকর্তা জানান, ইকসিডের মামলার রায়ের দিকে তারা তাকিয়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশে আপাতত তাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আলাদা কান্ট্রি ম্যানেজার নেই। কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ম্যানেজার ল্যারি ফিশার ভারতের গুজরাট থেকে এদেশের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একাধারে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের দায়িত্বে রয়েছেন বলে তিনি জানান।
তথ্যসূত্র-
http://www.thebengalitimes.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।