বউটুবান এক কুকুর ঝোপের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে হাসিমুখে বলে, বাহ্, বাহ্ চমৎকার নাচ তো! হ্যা, নাচো বিড়াল ভাই, নাচো। তোমার নাচটা বেশ ভালো লাগছিল আমার, ফাঁকে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ নাচই দেখছিলাম তোমার। কী সুন্দর নাচ! নাচের তারিফ না করে পারলাম না।
বিড়ালছানা নাচ থামিয়ে ডান-বাও তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে বলে, তোমাকে দেখে তো আর নাচানাচি হবে না, হবে কাঁপাকাঁপি। এই দেখো না কেমন কাঁপছি আমি, থত্থর! আরেকদিন এসে তোমাকে নাচ দেখাবো নে।
আজকে আমার প্রস্তুতি ছিল না এতেই তুমি এত্ত খুশি, যখন প্রস্তুতি নিয়ে নাচবো, তখন!
কুকুর কপালে চোখ তুলে বলে, কি আশ্চর্য! এরচেয়েও সুন্দর নাচতে পারো তুমি! যদি সত্যি বলে থাকো তবে মনে রেখো, তোমার ওই নাচ না দেখা পর্যন্ত আমি মুখে খাবার তুলছি না, হু।
কুকুরের প্রশংসায় বিড়াল আনন্দে নেচে-গেয়ে চলে গেল।
কুকুর আজ সুবিধা করতে পারলো না। মনে মনে বলে, আজও উপুস করতে হবে আমার। ইচেছ করলেও ওৎ পেতে আর শিকার ধরে খেতে পারি না।
বয়সের ভারে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছি আমি! নইলে বিড়ালটা বুঝি এভাবে নেচে-গেয়ে সামনে থেকে চলে যেতে পারে! বুঝেছি, আমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। শিকারের সাথে রীতিমত খায়-খাতির ও চালাকি করতে হবে। কুকুর মনে মনে বলে, ধুর, আমি যাই না কেনো বিড়ালের বাড়ি?
কুকুর অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে বিড়ালের বাড়ির সন্ধান পেল। সে বিড়ালের বাড়ির কাছে গিয়ে লেই মেরে শুয়ে গড়াগড়ি খাচেছ। শুকনোপাতার খচখচানিতে বিড়ালের কান খাড়া হয়ে গেল এবং তারা উঁকি মেরে চারদিক দেখে নিল।
হঠাৎ একটা বিড়াল চিৎকার করে বলে, ওই যে দেখো একটা কুকুর কেমন গড়াগড়ি করছে। আমাদের ধরার জন্য ও ফাঁদ পেতেছে। সাবধান হয়ে যাও সবাই!
নাচের বিড়ালটি বলে, আরে না, আমি ওকে চিনি। ও অতোটা ভয়ংকর নয় যতোটা তোমরা মনে করছ। ও আমার নাচের ভক্ত, ও অনেক প্রশংসা করেছে আমার।
ও কুকুর ভাই, ব্যাপার কি? নাচ দেখতে চলে এসেছ বুঝি? নাচের বিড়ালছানাটি বলল।
কুকুর গদগদ করে বলে, কী করে বুঝলে বিড়াল ভাই, আমি যে সত্যিই তোমার নাচ দেখতে চলে এসেছি। কুকুর চোখ-মুখ মোলায়েম করে, নানা কথার ছলে আরো কাছে চলে এলো। বিড়ালেরা সতর্ক হয়ে বলে, দেখো, দেখো কুকুরটা একেবারে কাছে চলে এসেছে! কুকুর আমাদের বড় শক্রু, ওর সাথে আবার কথা কিসের? চলো পালাই।
চোখের পলকে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল বিড়ালেরা।
শুধু ওই বিড়ালটাই রয়ে গেল যার নাচ দেখে কুকুর অনেক প্রশংসা করেছিল।
বিড়াল হাসি মুখে রহস্য করে বলে, তো আমার বাড়িটা চিনলে কেমন করে, কুকুর ভাই?
কুকুর বলে, আমি নিজেকে বোকা মনে করেছিলাম এই ভেবে যে, একটা বিড়ালের নাচে এমন কি যাদু থাকতে পারে যে আমি এর জন্য রীতিমত পাগল হয়ে গেছি! কিন্তু এখানে আসার পথে দেখলাম, সবাই তোমাকে চেনে, সবাই তোমার নাচের প্রশংসা করে, তোমাকে নিয়ে বনের সবাই গর্ব করে। তোমার এতই সুনাম-সুখ্যাতি যে তোমার বাড়ি চিনতে আমার মোটেও অসুবিধা হয়নি। জানো, আমি নিজেকে বড় বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান মনে করছি। জীবনে এমন গুণী বন্ধু পাওয়া মানেই তো অনেক কিছু পাওয়া।
কুকুরের কাছে নাচের প্রশংসা এতদূর চলে গেছে শুনে তো বিড়াল আনন্দে আত্নহারা। সে কুকুরকে আদর-আপ্যায়নে খুশি করার জন্য মহাব্যস্ত হয়ে উঠল।
দূরে থেকে একটা বিড়াল ছুটে এসে নাচের বিড়ালকে বলে, একি করছো তুমি? আগুন নিয়ে খেলা করছো যে! কুকুর তো আমাদের জাতশক্রু! তার সাথে এত খাতির কিসের? চলো পালাই, এখানে তুমি মোটেও নিরাপদ নও।
নাচের বিড়ালটি বলে, আমি ওকে বিশ্বাস করি। সে আমার বন্ধুর মতো।
যে প্রশংসা করতে পারে সে কখনও ক্ষতি করতে পারে না। যদি বিশ্বাস না করো তবে চলে যেতে পারো তোমরা; আমি পালাবো না, যাও।
বিড়ালটা মন খারাপ করে চলে গেল।
কুকুরের প্রশংসার তোড়ে বিড়াল নাচ শুরু করে দিল ডিরিং-ডিরিং ঢুস-ঢাস। বিড়ালের নাচের সাথে তাল মিলিয়ে কুকুর হাততালি দিয়ে, গুণগুণিয়ে গান গেয়ে, মাথা ঝাকিয়ে, শীষ মেরে বিড়ালকে উৎসাহ দিচেছ।
বিড়াল নাচতে নাচতে কাহিল হয়ে গেল। কিন্তু কুকুর তাকে থামতে দিচেছ না। বলে, থেমো না বন্ধু, এত সুন্দর নাচ আগে কখনও দেখিনি আমি, আমাকে উপভোগ করতে দাও। কী চমৎকার নাচ, উফ্!
এক সময় নাচতে নাচতে ক্লান্ত বিড়াল পাক খেয়ে পড়ে গেল কুকুরের সামনে। কুকুর বিড়ালের হাত, পা ও লেজ হাতিয়ে প্রশংসা করতে লাগল।
কত সুন্দর হাত-পা আর লেজের ছন্দ-তাল! বিড়াল হাসিমুখে তার আদর নিচেছ। কুকুর তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে, ইশ্ তোমার ঘাড়ে তো দেখছি এক রত্তি হাড় নেই, কী তুলতুলে নরম! এ জন্যেইতো নাচের সময় দ্রুত মাথাটা চারদিকে বেমালুম ঘোরাতে পারো তুমি।
কুকুর এসব বলে বলে হঠাৎ ঠেসে ধরল বিড়ালের ঘাড়। আর যায় কই। বিড়াল বলে, কী করছো, কী করছো, কুকুর ভাই? মিনমিনে বুড়ো কুকুর লোম-লেজ ফুলিয়ে দেখতে দেখতে অসম্ভব হিংস্র হয়ে উঠল! বিড়াল নড়তে পারছে না।
কুকুর ঘোঁ-ঘ্যা-গড়গড় করে একটা কামড়ে বিড়ালের ঘাড়টা ভেঙ্গে দু‘হাতের মাঝখানে ফেলে রাখল। বিড়াল কাৎরাতে কাৎরাতে বলে, আমি তোমাকে বিশ্বাস করে নেচে নেচে আনন্দ দিলাম। আর তুমি...!
কুকুর বলে, ক্ষুধার পেটে নাচ আর ভালো লাগে কতক্ষণ? নাচের মতো তোমাকেও তো পছন্দ করি আমি। তবে আফছুছ এ জন্য যে, আমি এখন একটা বিড়ালের সাথে তার নাচটাও গিলে ফেলবো। পারলে আমি নাচটা আলাদা করে রাখতাম পরে উপভোগ করার জন্য।
বিড়াল প্রাণপণ চিৎকার করে জীবন ভিক্ষা চেয়ে বলে, আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি তবে আমাকে কেন খাবে ভাই? কুকুর বলে, যে শক্রুর কথা বিশ্বাস করে এবং শক্রুকে বন্ধু মানে সে তো নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনে। আর যে নিজের প্রশংসার কথা শুনে খেই হারিয়ে ফেলে সে তো মস্ত বড় বোকা। বোকারা চালাকদের মত বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। কুকুর এ কথা বলেই জিহ্বা চাটিয়ে বলে, তুমি যে শুধু নাচেই ভালো তা নয়, মনে হচেছ, তোমার মাংস হবে তুলতুলে নরম ও সুস্বাদু।
কুকুর গপাস গপ করে বিড়ালছানাকে আস্ত গিলে ফেলল।
বিড়ালছানা পেটে যাওয়ার আগে কুকুরকে বলে গেল, আমি তোমার পেটে গিয়েও নাচব, মনে রেখো।
কুকুর মনের আনন্দে বিড়ালটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল।
কুকুর বসে আরাম করছে। কিন্তু বিড়ালের শেষ কথাটা তার মনে হতেই চোখ গোল করে সে লাফিয়ে উঠল। সে পেটের ডানে-বামে হাত দিয়ে দেখে নিল।
তার ভয়, না জানি বোকা বিড়ালছানাটি পেটের ভেতরে শুরু করে তিড়িং বিড়িং নাচ!
কুকুরের ভয় সত্যি হলো। সে পরিস্কার শুনতে পাচেছ তার পেটের ভেতরে ডিরিং ডাস-ডিডিং-ডিরিং, ঢুস-ঢাস শব্দে বিড়ালছানাটি নাচানাচি করছে এবং পেটটা একেক সময় একেক দিকে ফুলে উঠছে। বুড়ো কুকুর ‘ওরে বাপরে‘ বলে উল্টা-পাল্টা দৌড়াতে লাগল এবং একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে গোত্তামেরে পড়ে রইল।
যতই দিন যাচেছ ততই বাড়ছে কুকুরের কষ্ট। কোথাও তার আরাম নেই, শরীর ফুলে গেছে, মুখ বেয়ে লোল পড়ে আর পেটটা ঝুলে মাটির সাথে প্রায় লেগে গেছে।
কুকুর এ কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যার কাছে যায় সেই বলে, তোমার পেট থেকে বিড়ালটা বের করতে হলে যেতে হবে বিড়ালেরই কাছে, আমরা তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না ভাই।
অবশেষে উপায়হীন কুকুর বিড়ালের বাড়ি এসে সবাইকে ডেকে একত্র করে বলে, বিড়াল ভাইয়েরা, মন দিয়ে শোনো, নাচের বিড়ালের মতো তোমরাও আমার মহান বন্ধু। আমার এ বন্ধুকে বড়ো ভালোবেসে আমার পেটে তুলে নিয়ে রেখেছিলাম। তার নাকি এখন আর পেটে থাকতে ভালো লাগছে না। কুকুর চোখের জলে বলে, তাকে এ মুহূর্তে পেট থেকে বের করে আনো বন্ধুরা আমার!
বিড়ালেরা কিছুই বলল না, পিটপিট করে তাকিয়ে রইল।
কুকুরের ঝুলে যাওয়া পেট, মুখের লোল আর চোখের পানি দেখে একটা বিড়াল পাশের বিড়ালকে ঠেস মেরে বলে, ‘দেখ্ দেখ্ আমাদের মহান বন্ধুর কি অবস্থা! মনে হয় তার পিশাব-পায়খানা সব আটকে গেছে!‘ তার কথা শুনে একটা বিড়াল ফিক করে হাসি দিতেই সবার মুখে খলখলিয়ে হাসির খই ফুটে উঠল। হাসি আর থামে না। হাসির সাথে যোগ হয়েছে কাশি। কয়েকটা বিড়াল হাসি আর কাশিতে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেল।
বিড়ালের এমন রসিকতা দেখে কুকুর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে- নাচের বিড়ালকে পেট থেকে বের করে তাকে বাঁচানোর পরিবর্তে তোমরা আমার সামনে হাসি-তামাশা করার সাহস পেলে কোথায়?
একটা বিড়াল তেড়েমেড়ে কুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, এটা সাহসের কথা নয় দোস্ত, তোমার মহান বন্ধু তোমার পেটেই নিরাপদ।
আমরা এত বোকা নই যে তোমাকে বিশ্বাস করে বিপদ ডেকে আনি! তুমি যা করেছো এতেই তুমি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তুমি একটা বজ্জাত-মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। এখান থেকে ভালোয় ভালোয় চলে যাও।
কুকুর মন খারাপ করে চলে গেল।
কুকুরের পেটে নাচের বিড়াল! যখন-তখন নেচে উঠে ডিরিং ডিরিং-ঢুশ-ঢাশ।
এখন কুকুর আছে দৌড়ের ওপর। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।