আমি একজন সুখী মানুষ
মানুষ সামাজিক জীব , সমাজে বাস করতে গেলে তাকে নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয় । মানুষের আচরন নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই আইন । তবে এই সাধারণ নিয়ম অবশ্যই সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত হতে হবে। সার্বভৌম রাষ্ট্রে আইন সভার সদস্যগণ আইন প্রণয়ন করে থাকেন , তা করতে গিয়ে তাদেরকে অবশ্যই জনগণের চিন্তা চেতনা ও ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয় । এছাড়াও ধর্ম গ্রন্থ , প্রথা , ন্যায় বিচার বা ন্যায়বোধ , আইনজ্ঞের বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা , বিচারকের রায় থেকেও আইনের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
যেভাবেই আইনের উৎপত্তি হোক না কেন তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অপরিহার্য । তা করতে গিয়ে সবার প্রতি সমানভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী উড্রো উইলসনের মতে ‘ সমাজের সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণা ও অভ্যাসের যে অংশ সার্বজনীন নিয়মের আকারে সুস্পষ্টরূপে ও সরকারীভাবে স্বীকৃত হয়েছে এবং যা সরকারের অধিকার ও ক্ষমতার দ্বারা বলবৎ করা হয় , সেটাই আইন ’।
রাষ্ট্রের শাসন প্রণালীর সমষ্টিই হচ্ছে সংবিধান বা শাসনতন্ত্র। শাসন বিভাগ , আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন , এই বিভাগগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় পূর্বক সীমারেখা চিহ্নিতকরণ এবং সরকারের ক্ষমতা ও জনগণের অধিকারের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয় শাসনতন্ত্র।
শাসনতন্ত্রকে অবশ্যই জাতির অগ্রগতির সাথে সংগতি রক্ষা করে চলতে হয়। বরেণ্য প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে শাসনতন্ত্র জন কল্যানমুখী ও গতিশীল না হলে জনমনে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের সঞ্চার হয় , রাজনৈতিক অরাজকতা , অস্থিতিশীলতা ও বিপ্লবের সূচনা করে। সে কারণেই শাসনতন্ত্র হতে হবে সুপরিবর্তনীয় । রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিজ উইকের মতে শাসনতন্ত্র যদি দুষ্পরিবর্তনীয় হয় তাহলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ নিজেদের খেয়াল পূর্ণ করার জন্য বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচারের আশ্রয় নিতে পারে।
ইবনে খালদুন বলেন রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও নাগরিকদের চরিত্র গঠনে জলবায়ু ও ভৌগলিক পরিবেশের প্রভাব যথেষ্ট ।
জলবায়ুর তারতম্য ও বিভিন্নতার কারণে কেবল মানব প্রকৃতিই ভিন্নতর হয় না ; বরং এর ফলে সভ্যতা সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে । একই কারণে মানুষের জীবন পদ্ধতিরও বিভিন্নতা সূচিত হয় । তিনি আরো বলেন রাষ্ট্র ও সমাজের উৎপত্তির মূলে রয়েছে মানুষের ঐক্যবোধ । ধর্মীয় ঐক্য এই ঐক্যবোধকে দৃঢ়তর করতে সাহায্য করে মাত্র । রাষ্ট্রের উৎপত্তির সাথে সাথে একজন শাসকের প্রয়োজন হয় ।
শাসক কেমন হবেন এ বিষয়ে ইমাম গাজ্জালী বলেন রাষ্ট্রীয় সত্ত্বাকে একটি সম্পূর্ণ জীবদেহের সাথে এবং জনসমাজকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানব দেহের মধ্যে হৃদয়ের স্থান যেরূপ সর্বোচ্চ , তেমনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে শাসক হচ্ছেন সর্বোচ্চ মানের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। শাসককেও পক্ষপাতহীনভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতে হবে। ন্যায়বান শাসক আল্লাহর প্রতিনিধি , তবে অন্যায়কারী হলে ঐ শাসক শয়তানের প্রতিনিধি বলে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন শাসক হবেন রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠনেতা ।
যোগ্য শাসক না থাকলে রাষ্ট্রে নিরবিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলা , দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী দেখা দেবে । বিরামহীন অস্ত্রের ঝনঝনানী ও যুদ্ধ প্রস্তুতি রাষ্ট্রকে ক্ষত বিক্ষত করবে। আল্লাহর বিধান , শরিয়তের আইন ও সমাজ জীবনের মৌলিক নীতি দ্বারা শাসকের ক্ষমতা সীমিত হতে হবে। আদর্শবান শাসককে অবশ্যই ধর্মপরায়ণ , জ্ঞানী ও সাহসী এবং সেই সাথে দূরদৃষ্টি , কূটনীতি ও বিচার শক্তি সম্পন্ন এবং প্রজাদের প্রতি সদয় হতে হবে। শাসন কার্য পরিচালনায় তিনি জ্ঞানী জনের পরামর্শ গ্রহণ করবেন ।
তাকে এটাও মনে রাখতে হবে পার্থিব জগতের সুখ ক্ষণস্থায়ী , মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই, ইসলামে অসাম্যের স্থান নাই। তিনি কখনোই স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরাচারিতার পথ বেছে নেবেন না ।
বাংলাদেশে আমরা বার বার শাসনতন্ত্র নিয়ে সংঘাতময় বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। অদূরদর্শীতা ও অপরিণামদর্শীতা আমাদের মারাত্মকভাবে পেয়ে বসেছে। এই কারণেই জীবন ও সম্পদহানি ঘটছে।
অহেতুক ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ছে নাগরিকেরা । মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে শত্র“মুক্ত করার পর জনপ্রতিনিধিগণ সংবিধান প্রণয়ন করে। কালের বিবর্তনে এর বিধানাবলী সংযোজন , পরিবর্তন , প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ দ্বারা সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে এটা মুক্তিযোদ্ধা জনপ্রতিনিধিগণ সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৪২ অনুচ্ছেদে শর্ত সাপেক্ষে এই দায়িত্ব পালনের এখতিয়ার দেওয়া হয় জাতীয় সংসদকে।
সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয় ঃ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয় , তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ , ততখানি বাতিল হইবে।
এরপর তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত হয়েছে । তার শুরুতেই সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয় ঃ (১) এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে ।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ , ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
একই অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রনীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না ।
আবার সংবিধানের ১৪২ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রনীত সংশোধনের ক্ষেত্রে ২৬ অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না ।
প্রচলিত আইনের হেফাজত সম্পর্কে সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ঃ এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরতা অব্যাহত থাকিবে , তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।
এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয় যে দেশে প্রচলিত ও ভবিষ্যতে প্রণীতব্য সকল আইনের ক্ষেত্রে সংবিধান ও মৌলিক অধিকারের প্রাধান্য রয়েছে । এই প্রাধান্য সীমাহীন নয়। জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে বিবেচিত ও গৃহীত হয়েছে সংবিধান । অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির উপরই এর স্থায়ীত্ব ও অস্থিত্ব নির্ভরশীল ।
যুগের সাথে সাথে জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি সতত পরিবর্তনশীল। তাই সংবিধানও পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন করার এখতিয়ার একমাত্র জনগণেরই আছে। জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির উপরে অভিভাবকত্ব করার এখতিয়ার অন্য কাউকেই দেওয়া হয় নাই। জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির প্রাধান্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সংবিধানে ঘোষিত হয়েছে।
এখানে সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ার উপদেষ্টামূলক। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা তা হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে মর্মে যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন এবং সেই সাথে তিনি এ বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন আছে মর্মে মনে করেন তাহলে তিনি উক্ত বিষয়ে আপীল বিভাগের কাছে প্রশ্নটি বিবেচনার জন্য প্রেরণ করতে পারবেন। তখন উপযুক্ত শুনানী অন্তে উক্ত বিভাগ রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ অথবা এইরূপ কোন মতামত প্রদানের বিধান সংবিধানে নাই।
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ মামলায় প্রদত্ত রায়ে বিচারপতি এ টি এম আফজাল বলেন সংবিধানের সংশোধনের মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধানের সাথে এর প্রচলিত বিধানের মধ্যে স্পষ্টত কোন বৈসাদৃশ্য দেখা দিলে আদালত সংঘাত সৃষ্টি না করে সম্ভব হলে এর মাঝে সমন্বয় সাধন করবেন এবং উভয় বিধানকেই বহাল রাখবেন।
যদি তা সম্ভব না হয় তা হলে প্রচলিত সাধারণ বিধানের উপরে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নবপ্রবর্তিত বিশেষ বিধানটিই প্রধান্য পাবে। { দ্রষ্টব্য ঃ ৪১, ঢাকা ল রিপোর্টস (আপীল বিভাগ) (১৯৮৯), পৃষ্ঠা নং ঃ ৩০০ }। জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির উপরই পরম শ্রদ্ধা পোষণ করেই এই মতামত দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়।
ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় পন্ডিত নেহেরু গণপরিষদে ১১ই নভেম্বর ১৯৪৮ খ্রিঃ তারিখে বলেছিলেন , মনে রাখবেন আমরা শাসনতন্ত্রকে সুদৃঢ় ও স্থায়ী কাঠামো দিয়ে প্রণয়ন করতে পারি , তা সত্ত্বেও শাসনতন্ত্রে স্থায়ীত্ব বলে কিছু নাই । তাতে নিশ্চিত পরিবর্তনশীলতা থাকতেই হবে।
আপনারা যদি এর কোন কিছু স্থায়ী ও সুদৃঢ় করেন তাহলে যে জীবন্ত মানবকূল নিয়ে এ জাতি গঠিত তার বিকাশের রুদ্ধ হয়ে যাবে , তাই শাসনতন্ত্র অবশ্যই হবে সুপরিবর্তনশীল। (দ্রষ্টব্য ঃ ঐ , পৃষ্ঠা নং ঃ ২৯৪ )।
পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় গণপরিষদে গণতন্ত্রের মানস সন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন , গণতন্ত্রই আমার জীবনের মূলমন্ত্র ,শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে জনগণের রায়ই শেষ কথা । উল্লেখ্য ঐ সময় বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আজকে দেশে সংবিধান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ।
সংঘাতের পথ পরিহার করে জনগণের রায় গ্রহণ করার মাধ্যমেই আমাদেরকে এর সমাধান খুঁজতে হবে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন । জনগণের অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার একমাত্র অধিকার রয়েছে এতদুদ্দেশ্যে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের , অন্য কারো নয় । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।