ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... কলকাতায় হোটেল অশোকায় ফিরে ১৭ জনকে দেখে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসে। আমরা আনন্দে আত্মহারা হই। ওরা হৈ হৈ করে আমাদের নামে অভিযোগ করতে থাকে। আমরা খুশীমনেই সেসব হজম করি। দিল্লী থেকে ফেরার পথে খড়গপুরে ট্রেন পরিবর্তনের সময় ভুলে আমরা ওদেরকে ফেলে আসি।
তবে, অন্য ট্রেন ধরে ওরা আমাদের আগেই পৌঁছেছে হোটেলে। যেভাবেই হোক, সবাইকে তো নিরাপদে ফিরে পেয়েছি! স্বস্তির হাওয়া ছুঁয়ে যায় আমাদের। এরই মাঝে দেখি এক কোণে শীলা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সামা তাকে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
মুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, হারিয়ে যাওয়ার ভয় বা ফিরে পাওয়ার আনন্দজাত নয় এ কান্না। কি ব্যাপার? ঐ ১৭ জনের অন্যরাও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না।
আরও কয়েকটি মেয়ে শীলাকে আলাদা করে নিয়ে যায় ঘটনা কি জানার জন্য। হোটেলের রিসেপশনের ঝামেলা সেরে রুমে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘটনা জানা হয়ে যায়। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে করে সবার আগে হোটেলে এসে পৌঁছায় শীলা, সামা আর রশিদ।
ব্যাগ নিয়ে শীলা আর সামা লবির এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। রশিদ গেটের বাইরে গিয়ে দেখছিল, অন্যরা এসেছে কিনা। এ সময় এক লোক ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শীলাকে ইঙ্গিত করে বাজে কথা বলে। এমনিতেই অপরিচিত জায়গা, বাকীদের খুঁজে না পাওয়ার টেনশন- এরপর এ ধরণের কথা শুনে ভয়ে জমে যায় শীলা। উত্তর দেয় না।
আরও কিছু আজেবাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় লোকটা। তবে রশিদ অন্যদের নিয়ে ওখানে আসার আগেই লোকটা চলে যায়। শীলাও আর ওদের কিছু জানায়নি।
এখন সব জেনে আমাদের তরুণ গরম রক্ত আরও ছলকে ছলকে ওঠে। এমনিতেই আমরা বাকীরা কিছুটা অপরাধবোধে ভুগছি ওদের ছেড়ে আসার জন্য।
এ ঘটনার দায়ভারও যেন আমাদের কাঁধেই এসে পড়ে কিছুটা। এক সাথে এলে নিশ্চয়ই এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারতো না। শীলার অপমান আমাদের সবার অপমান, ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এই ট্যুরে আসা ৭৪ জন ছাত্রছাত্রীর প্রত্যেকের অপমান। এর শোধ নিতেই হবে। ভিন দেশে এসেছি বলে কি যে কেউ যা ইচ্ছা তাই করে যাবে আর আমরা মুখ বুজে থাকব? ‘শোধ নিতে হবে’ - এই ভাবনাটা আমাদের মাথায় ঢোকায় ইকরাম।
শীলার প্রতি তার একটু আলাদা হৃদয়ঘটিত স্পর্শ-কাতরতা ছিল। যদিও শীলা এ সম্পর্কে ছিল পুরোপুরিই অজ্ঞ। শীলার অপমানের শোধ নিতে ইকরাম-ই আমাদের উসকায়। আমরাও ‘উসকিত’ হই। ইকরামের নেতৃত্বে ৩-৪ জন যথাযথ প্রস্তুতি নিতে চলে যায়।
আমরা রুমে অপো করি ওদের ‘ডাক’-এর।
ঐ লোকটি এক মহা ভুল করে গিয়েছিল। শীলাকে ‘ঐ রকম’ মেয়ে মনে করে তার ‘রেট কত’ ইত্যকার কথা জিজ্ঞাসার ফাঁকে তার রুম নম্বরও বলে এসেছিল। শীলাকে নিয়ে ইকরাম আড়ালে ঐ রুমের দিকে ল্য রাখে। খানিক পর লোকটি রুম থেকে বের হলে শীলা নিশ্চিত করে, এ-ই সে-ই লোক।
বাকী কাজ ইকরাম এন্ড গং-এর। কিছুণ অপো করা হয় রুমে আরও কেউ আছে কিনা বোঝার জন্য। কিন্তু ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না। কিন্তু ইকরামের আর অপো সয় না। সে আমাদেরকে রুম থেকে ডেকে নেয়।
আমরা প্রায় ১৪-১৫ জন। তিন-চারজনের বেশী তো আর ঐ রুমে থাকবে না। এর মোকাবেলায় ১৪-১৫ যথেষ্ট। সবাইকে জানাই না আমরা। গাইড ফাহিম ভাই আর আমাদের সঙ্গে আসা শিককেও না।
করিডোর নির্জন হতেই ইকরাম আর দুই জন ঐ দরজায় নক করে। দরজা খুলতেই তারা ভেতরে ঢোকে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমরাও ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ি। লোকটি এত মানুষ আশাই করেনি। সে বিস্ময়ে হতবাক।
ঐ অবস্থায়ই ইকরাম তাকে ভেতরে রুমের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, রুমে আর কেউ ছিল না। আমি অবশ্য ঘরের ভেতর যাই না। আমি এমনিতেও তেমন বীরপুঙ্গব নই। শারীরিক দিক দিয়ে এমন কোন সমৃদ্ধ গঠন নয় আমার।
আমি এসেছি ওদের ‘মোরাল সাপোর্ট’ দিতে। দরজা বন্ধ করে দরজার কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। ইকরামের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। লোকটি শুরুতে কিছুটা সাহস দেখানোর চেষ্টা করলেও পরে ভড়কে যায়। নরম সুরে সে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু আমরা কি আর ব্যাখ্যা শুনতে এসেছি নাকি? এসেছি ধোলাই দিতে। তা-ই কয়েক কথার পরই শুরু হয় ধোলাই পর্ব। ধোলাই মূলত তিন-চারজনই দেয়। আমরা বাকীরা তাদের মোরাল সাপোর্ট দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। ইকরামের হাতের আর আমাদের মনের সুখ মেটার পর আমরা বের হয়ে আসি।
আসার আগে অবশ্যই ধমকি দিয়ে আসি, এ নিয়ে হইচই করলে কপালে আরও খারাবি আছে।
কান্ড ঘটিয়ে বের হয়ে এসে আমরা জানাই ফাহিম ভাই আর স্যারকে। ফাহিম ভাই তো ঘটনা শুনে হতভম্ব। স্যার রেগে বোম। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে এ কোন অকান্ড ঘটালাম আমরা।
এখন যদি থানা-পুলিশের ঝামেলা হয়, তাহলে সামলাবে কে? লোকটি যদি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে উল্টো হামলা করে। সঙ্গে ৩৪ টা মেয়ে। সেদিকে কেন আমরা একটুও খেয়াল করলাম না? আমরাও এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। ইকরামই যেহেতু উদ্যোক্তা সে অভয় দেয়ার চেষ্টা করে- না স্যার অতো মারধর করিনি, ব্লিডিং হয় নাই। এত রাতে থানা-পুলিশ কেমনে করবে? আর আমরা তো সকালেই হাওয়া হয়ে যাব।
হামলা করতে আসলেও আমরা ৪০ টা ছেলে আছি, পারবে না। ইকরামের কথায় আমরা বেশীরভাগ-ই ভরসা পাই না। দুরু দুরু বুকে রুমে ফিরে আসি। ফাহিম ভাই বের হন খবর নিতে। রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি।
কিন্তু ঘুম কি আর আসে? মনে হয়, এই কেউ দরজায় টোকা দিল, এই বুঝি পুলিশ এলো, এই বুঝি হকিস্টিক-ছুরি নিয়ে কেউ হামলা করতে এলো। ইন্ডিয়া ট্যুরের একদম শেষভাগে এসে এ কোন ফ্যাসাদ ঘাড়ে টেনে আনলাম! এখন ভালোয় ভালোয় কি বাংলাদেশে ফিরতে পারবো? টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরের দিকে চোখ বুজে এলো।
পরদিন সকালে উঠে প্রথমেই যাই ফাহিম ভাইয়ের রুমে। তিনি আশ্বস্ত করেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন- লোকটি বাংলাদেশের, ঝিনাইদহ থেকে এসেছে ভারতে, কোন এক কাজে।
একাই। এ জন্যই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। স্থানীয় কেউ হলে এত সহজে পার পাওয়া যেত না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।