আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটদের আওয়ামী লীগ বড়দের পাঠ্য

রফিকুল ইসলাম ঃঃঃ____ বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ছিল কবেÑ সে প্রশ্নের উত্তরে খুব একটা স্বস্তি মেলে না। গত প্রায় একহাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৪১৫ সাল থেকে ১৪৩৫ সাল পর্যন্ত রাজা গনেশ, তার পুত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ ও পৌত্র শামসুদ্দিন মোহাম্মদ শাহÑ এ তিন বাঙালি এই বাংলাকে শাসন করেন। বাকি শাসকরা ভিন্ন ধর্মের-গোত্রের অবাঙালি ছিলেন। দিল্লির মুসলমান সুলতান ও মুঘল বাদশার অধীনেও ছিলাম অনেককাল। মুঘল শাসনামলে তাদের পক্ষের সুবেদাররা বাংলা শাসন করতেন, শেষ সুবেদার ছিলেন আলীবর্দী খাঁ।

তিনি একপর্যায়ে দিল্লির শাসন অমান্য করে নিজেকে বাংলা, বিহার, ওড়িষ্যার স্বাধীন নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর মেয়ে আমেনা বেগমের ছেলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র তেইশ বছর বয়সে তার স্থলাভিষিক্ত হন। সিংহাসনে আরোহনের একবছরের মাথায় ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। এই ভূমি তারপর থেকে একটানা একশ নব্বই বছর শাসন করেছে ইংরেজ শোষকের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটো দেশের জš§ হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলাম। কিন্তু স্বাধীনতা আমাদের অধরাই ছিল। পরিবর্তে শুরু হল পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নজিরবিহীন অত্যাচার-শোষণ। পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে বারবার প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, যার শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি ভাষার অধিকার আদায় করেছিল।

কিন্তু বঞ্চনা তবু থামেনি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে পশ্চিমা শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে তৎকালীন মুসলিম লীগের তরুণ নেতারা ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে উঠছিলেন। তাদের উদ্যোগেই নানা বাধা-বিপত্তি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাশ লেনের বশীর মিয়ার দোতলা ভবনে প্রায় ৩৫০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হয়েছিলেন বলে এ দিনটিকেই নতুন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল। দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। তিনি হয়েছিলেন দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালের সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে হয় আওয়ামী লীগ। শুরু হয় অসা¤প্রদায়িকতার পথে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা।

সেই থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অবধি নিরন্তর সংগ্রাম করেছে এ রাজনৈতিক সংগঠনটি। ১৯৫৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিল। এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সফল। এ সময়ই বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসনকে আলাদা করার বিল পাস, যমুনা নদীতে গ্যাস-তেলসহ খনিজ পদার্থ আবিষ্কারের জন্য সিসমিক ডাটা সংগ্রহের কাজ শুরু, ওয়াপদা প্রতিষ্ঠা, গাজীপুরে উচ্চফলনশীল ধানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা, উন্নয়নের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সর্বপ্রথম পরিকল্পনা বোর্ড গঠন, এফডিসি প্রতিষ্ঠা, বন্যা প্রতিরোধ ও জলসেচের জন্য প্রথম বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা (ক্রুগ মিশন), সরকারি উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, প্রথম ২১ ফেব্র“য়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা, জুট মার্কেটিং করপোরেশন গঠন, কক্সবাজারে প্রথম পর্যটনকেন্দ্র গঠনসহ সাফল্যের তালিকা ছিল ঈর্ষণীয়ভাবে দীর্ঘ। আমাদের দুর্ভাগ্য হলÑ আওয়ামী লীগের এ অর্জন নিয়ে কখনোই খুব বেশি আলোচনা, গবেষণা বা লেখালেখি হয়নি।

ফলে আমাদের অনেকেই জানি না যে, আজ যে সার, উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ, তেল-গ্যাস ও খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জলসেচের মতো মৌলিক সমস্যাগুলোতে এ দলটিই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন, আর ২৭ অক্টোবর মির্জার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট হন তৎকালীন সেনা প্রধান আইয়ুব খান। শুরু হল আইয়ুবের স্বৈরশাসন, ক্রমশ দানা বাঁধতে লাগল বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক ঘরোয়া সভায় বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। তখন অনেকেই ৬ দফার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

বামপন্থীরা বলেছিলেন, ৬ দফা সিআইয়ের দলিল। কিন্তু অনঢ় ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি জানতেন আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তাকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। ৬ দফা দাবি আদায় ছাড়া বাঙালি জনসাধারণের মুক্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর এ আপসহীন সংগ্রামে নিরন্তর সমর্থন জুগিয়েছে তৎকালীন ছাত্রলীগ।

১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিব ৬ দফা প্রচার শুরু করেছিলেন ঢাকার পল্টনের জনসভা থেকে। তারপর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত একটানা পঞ্চাশ দিন ৬ দফার সমর্থনে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। ৬ দফার সমর্থনে তিনি যেখানেই গেছেন বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ সময় ইডেন কলেজে ছাত্রী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনটি হয়ে দাঁড়ায় ৬ দফার পক্ষে-বিপক্ষে ম্যান্ডেট অর্জনের নির্বাচন।

গভর্নর মোনায়েম খাঁর সমর্থনপুষ্ট এনএসএফ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেদিন ছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ সভানেত্রী, মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা, আজকের বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবের ৬ দফার প্রতি সেটি ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যান্ডেট। শেখ মুজিবকে প্রায়ই গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হত। কিন্তু ততদিনে তার সংগঠন ও সাধারণ মানুষ এতটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, আন্দোলন দিনদিন বেগবান হয়ে উঠছিল। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় দেশদ্রোহিতার মামলা, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামেই পরিচিত। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের মামলাটি ধোপে টেকেনি। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন, আর ২৩ ফেব্র“য়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি, আজকের জননেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধ’ু উপাধি প্রদান করেন। তারপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে নজীরবিহীন বিজয় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তরে চলে টালবাহানা। পরিণতিতে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়Ñ তিনি যেন জানতেন যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির অধিকার আদায়ের আর কোনো পথ খোলা নেই। আন্দোলনের প্রশ্নে অনেক সিনিয়র নেতার বিভ্রান্তি ও দ্বিধা থাকলেও বঙ্গবন্ধু সবসময়ই ছিলেন লক্ষ্য আদায়ে অবিচল। নির্যাতন, কারাগার, ভয়-ভীতিÑ কোনো কিছুই তাকে তার চলার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তার দৃঢ়তা ও অসীম সাহসী নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। আর এই দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামে যে রাজনৈতিক দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে সেটি হল আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। এ ইতিহাসকে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্বের স্বার্থেই সংরক্ষণ করা জরুরি, প্রজš§-প্রজš§ান্তরে ছড়িয়ে দেয়া আমাদের প্রতিটি স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষেরই কর্তব্য। এ মহান দায়িত্বটি পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু সৈনিক, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য-পরিবার কল্যাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তার সদ্য লেখা ‘ছোটদের আওয়ামী লীগ’ নামক গ্রন্থে। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার বইয়ে এত চমৎকারভাবে, প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলে তিনি একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও তিনি বইটি লিখেছেন ছোটদের জন্য।

কিন্তু পাঠ করে মনে হয়েছে কেবল ছোটদের জন্যই নয়, ইতিহাসের এ মহান সত্যটুকু জানার জন্য এ বইটি সব বয়সের মানুষের জন্যই একটি আবশ্যিক পাঠ্য। বইটি প্রকাশ করেছেন সমমাত্রা প্রকাশের পক্ষ থেকে আবু আল সাইদ। বইটি বঙ্গবন্ধু প্রেমিক , মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলের পড়া উচিত । আওয়ামী লীগের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগ বইটির বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।