আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

[ছোটদের গল্প] ...টিপলু

শিশুতোষ যে কোন রচনা।  

...টিপলু টিপলুদের ইস্কুলের শাহরিয়ার স্যার বড় মজার মানুষ। প্রাইমারি ক্লাশে তিনি ইংরেজি পড়ালেও আরো কতো কতো বিষয় নিয়ে যে মজা করেন ! একদিন ক্লাশে ঢুকেই ব্ল্যাকবোর্ডে কয়েক টানে দুটো মানচিত্র এঁকেই বললেন- বলো তো, এ দুটো কোন্ কোন্ দেশের মানচিত্র ? একযোগে সবাই হৈ হৈ করে ওঠলো- এইটা বাংলাদেশ ! আর ওইটা ? গোটা ক্লাশ নিশ্চুপ। কেউ বলতে পারছে না। স্যার নিজেই বলে দিলেন- এটা হচ্ছে ইটালী।

ইটালীর তৈরি জুতো পৃথিবী বিখ্যাত। দেখেছো, দেখতে অনেকটা জুতোর তলার মতো মনে হচ্ছে না ! সবাই যার যার পা ওল্টে জুতোর তলা পরীক্ষা করতে লেগে গেলো। সেদিন থেকে টিপলুরা ইটালীর মানচিত্র চিনতে আর ভুল করে না। আরেকদিন স্যার ক্লাশে ঢুকেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে খসখস করে অংকে লিখে ফেললেন- দুই যোগ দুই সমান পাঁচ। লেখা শেষ হতে না হতেই ক্লাশের সবাই হৈ হৈ করে ওঠলো, ভুল হয়েছে স্যার, ভুল হয়েছে, পাঁচের জায়গায় চার হবে ! স্যার মুচকি হেসে অংকটা শুদ্ধ না করেই একটা ধাঁ ধাঁ দিয়ে বসলেন- বলো তো, দুয়ে দুয়ে কখন পাঁচ হয় ? ঝপ করে ক্লাশে নীরবতা নেমে এলো।

কৌতুহলী চোখগুলো এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, সে তার দিকে তাকাচ্ছে। এমন অদ্ভুত ধাঁ ধাঁ’র উত্তর খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে শেষপর্যন্ত স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো সবাই। স্যারের মুচকি হাসি তখনো মুখে লেগে আছে। হাসিটা আরো প্রসারিত করে বললেন- কেউ পারছো না বুঝি ? শুরুতেই না সবাই একসাথে এর উত্তরটা দিয়েছো ! স্যারের কথা শুনে সবাই আবারো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো- কখন উত্তর দিলো সবাই ! হাসতে হাসতে স্যার বললেন- দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয় ভুল হলে ! খিলখিল করে হাসির সংক্রমন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু সবার দুঃখ, শাহরিয়ার স্যারের ক্লাশটা এলেই ইস্কুলের ঘণ্টাটা কেন যে এতো দ্রুত পড়ে যায় ! এই সেদিনও স্যার ক্লাশে ঢুকে আরেক কাণ্ড করে বসলেন।

বললেন- নিজে নিজে বলো তো দেখি, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কে ? স্যারের এমন প্রশ্নে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো গোটা ক্লাশে। সার্চ-লাইটের মতো চোখ দুটো তাক করে এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলো সবাই, সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটির খোঁজে। অরীদ নিজেকে সুন্দর হিসেবে জানলেও তার ধারণা দীপম তার চেয়ে সুন্দর। আবার দীপম ভাবছে- নাফিসের নাকটা কী সুন্দর চোখা ! কিন্তু নাফিস জানে যে কোকড়ানো চুলের অনিক কতো লম্বাচোরা, সুন্দর ! এদিকে অনিক লিমনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে- ওর গায়ের রঙ কতো ফর্সা ! কী সুন্দর করে হাঁটে ও ! এভাবে একে অন্যের তুলনা প্রতিতুলনা করতেই থাকলো সবাই। কিন্তু কেউ আর উত্তর দিতে দাঁড়ালো না।

কী ব্যাপার, তোমরা কেউ কিছু বলছো না যে ? স্যারের দ্বিতীয় প্রশ্নের আওয়াজে ক্লাশের গুঞ্জন থেমে গেলো। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে স্যারের দিকে চেয়ে রইলো। স্যারই হয়তো বলবেন, ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটি কে। হঠাৎ স্যারের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই ঘাড় ফেরালো। পেছনের দিকে বসা কালো রুগ্ন ছেলেটি দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

টিপলু। হাঁ হাঁ বলো..? স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই সে হালকা স্বরে ঘোষণা দিলো- স্যার, আমি সবচেয়ে সুন্দর। আরে বলে কী ! খিলখিল খিলখিল শব্দে গোটা ক্লাশটাই দুলতে লাগলো। এমন অদ্ভুত কথা শুনে সবাই খুব মজা পেয়েছে হয়তো। একে তো মুখচাপা স্বভাব, তার ওপর সহপাঠীদের এরকম পরিহাসসুলভ হাসিতে টিপলুর মলিন চেহারাটা লজ্জায় কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো।

শাহরিয়ার স্যার সবাইকে থামিয়ে দিয়ে টিপলুর দিকে মনোযোগ দিলেন। বললেন- গুড ! এবার বলো তো, কিভাবে বুঝলে তুমি সবচেয়ে সুন্দর ? আম্মু যে বলতো, আমার থেকে সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কেউ নাই ! টিপলুর উত্তর শুনে স্যার কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং বললেন- ভেরী গুড ! তোমার আম্মু ঠিকই বলেছেন ! স্যারের কথায় টিপলুর মুখ কিছুটা সতেজ হয়ে ওঠলো। এবং একইসাথে ক্লাশ জুড়ে ফের কলকল কলকল ঢেউয়ের পর ঢেউ ওঠতে লাগলো- স্যার..আমার আম্মিও আমাকে বলেছেন, স্যার.. মামণি আমাকেও বলেছেন আমি খুব সুন্দর, স্যার..মা আমাকে সবসময় একথা বলেন, স্যার.. আমার মাম আমাকে...... হাঁ হাঁ, ঠিক আছে ঠিক আছে, তোমরা থামো, আমি বলছি ! স্যারের আশ্বাসে সবাই শান্ত হয়ে এলে এবার তিনি বলতে লাগলেন- তোমাদের সবার কথা ঠিক আছে। তোমাদের আম্মু খুব সত্যি কথা বলেছেন । তোমরা সবাই খুব সুন্দর ! কিন্তু সবাই দেখতে একরকম নও, তাই না ? যদি সবাই দেখতে একরকম হতে তাহলে তোমাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে কিভাবে চিনতাম আমরা ? তোমাদের আম্মু কিভাবে চিনতেন তোমাদেরকে ! সত্যিই তো ! এটা যে খুবই সমস্যার ব্যাপার হতো এভাবে তো কেউ ভাবেনি আগে ! কিন্তু...! হঠাৎ করে শাহরিয়ার স্যার বলে ওঠলেন- সবাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাও এবং মনোযোগ দিয়ে দেখো তো কী কী সুন্দর জিনিস দেখা যায় ? সবাই দাঁড়িয়ে ছয়তলা ভবনের দোতলার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো।

ইস্কুলের বাউন্ডারি দেয়ালের উপর কালো কুচকুচে কাকটা এদিক ওদিক উঁকিঝুকি মারছে। এর পরই রাস্তাটা। নানান রকমের পথচারী হেঁটে যাচ্ছে। পাশেই সবুজ রেইনট্রি গাছটার তলায় বেলুনঅলা লোকটি লাল নীল হলুদ সবুজ বিভিন্ন রঙের বেলুনগুলো লাঠির আগায় বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ফেরিঅলা লোকটি বাদাম বাদাম বলে হাঁক দিচ্ছে।

গাছটার ডালে কতকগুলো পাখি কিচিরমিচির করছে। ওপাশে পুকুরটার পাড় ঘেষে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাখা গাভীটার আশেপাশে একটা বাছুর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আরো দূরে কিছু বাড়িঘর আর সবুজ গাছ-গাছালি একসাথে লেপ্টে আছে। উপরে আকাশটাতে একটুও মেঘ নেই, কেমন নীল বর্ণ ধরে আছে ! দূরে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। কারা যেন খেলছে ওখানে...।

এবার বসো সবাই- স্যারের নির্দেশে সবাই যার যার সিটে বসে পড়লো। যদিও আরো কিছুক্ষণ দেখার ইচ্ছে করছিলো সবারই। স্যার বলতে লাগলেন- এখন আমি যার নাম বলবো সে দাঁড়িয়ে সেই জিনিসটার নাম বলবে যেটা তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। ঠিক আছে ? জ্বী স্যার- একবাক্যে সবাই জবাব দিলো। বিষয়টা যে খুব মজার, সেটা ধরে ফেলেছে সবাই।

আলিফ দাঁড়াও। আলিফ খুব উৎসাহের সাথে দাঁড়িয়েই বলতে শুরু করলো- পুকুরের পাড়ে গরুটার পাশে বাছু... উঁহু, মাত্র একটা জিনিসের নাম বলবে ! তাকে বাধা দিয়ে বললেন স্যার। ক্ষাণিকটা চিন্তা করে উত্তর দিলো সে- গরুর বাছুর ! ঠিক আছে তুমি বসো। এবার রিয়াদ। বেলুন ! দাঁড়িয়েই ঝটপট উত্তর জানিয়ে দিলো সে।

নিলয় ? সে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে বললো- কাক। তূর্য ? গাছ ! সেজান ? পাখি ! ইতোমধ্যে উত্তর দিতে আগ্রহী প্রার্থীরা হাত তুলে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের একজনের নাম ধরে স্যার এবার বললেন- সজল বলো তো, একজন বললো গাছ সুন্দর, কিন্তু পরেরজন বললো পাখির কথা। তুমি কী বলো, গাছ কি সুন্দর নয় ? জ্বী স্যার, গাছও সুন্দর ! ঠিক আছে তুমি বসো। তোমরা সবাই কী বলো ? সবাই একসাথে উত্তর করলো- জ্বী স্যার, গাছ সুন্দর।

স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন- তাহলে পাখি ? পাখিও সুন্দর। সবাই একসাথে জবাব দিচ্ছে। পুকুর ? পুকুরও সুন্দর। কাক ? কাকও সুন্দর। বাছুর ? বাছুরও সুন্দর।

তাহলে সুন্দর নয় কোনটা ? থতমত খেয়ে গেলো সবাই। স্যার নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন- কোন কিছুই অসুন্দর নয়। সব কিছুই নিজের নিজের মতো সুন্দর। এই যেমন তোমরা সবাই নিজের নিজের মতো সুন্দর ! ক্লাশ জুড়ে একটা ফুরফুরে হাওয়া বইতে লাগলো। মজার বিষয় হচ্ছে, একই দিনে স্যার এতগুলো মজার বিষয় বলেন না কখনো।

অথচ স্যার আজ তাই করলেন ! হঠাৎ আরেকটা কাণ্ড করে বসলেন তিনি। বললেন- এবার বলো তো, তোমরা কে কে তোমাদের আম্মুর সাথে প্রায়ই রাগারাগি করো ? প্রশ্ন শুনে সবাই নড়েচড়ে বসলো। এ ওর দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগালো। কিন্তু কেউ উত্তর দিতে দাঁড়াচ্ছে না। হাসতে হাসতে স্যার বলছেন- আমি জানি, তোমরা সবাই তোমাদের আম্মুর সাথে প্রাযই রাগারাগি করো।

কেউ রাগ করো তোমার ইচ্ছার বাইরে পুরো এক গ্লাস দুধ আম্মু জোর করে খাইয়ে দেন বলে, কখনো রাগ করো পড়া বাদ দিয়ে প্রিয় কাটুন সিরিজটা দেখতে বসলে আম্মু এসে টিভিটা বন্ধ করে দিলে, কেউ বা রাগ করো খেলতে গিয়ে জামা-কাপড় নোংরা করে ফিরলে আম্মু বকা-ঝকা করেন বলে, আবার কখনো কেউ রাগ করো তোমাদের ভাই-বোনের ঝগড়ায় দুম করে পিঠে কিল খেয়ে তুমি চেচামেচি করলে আম্মু এসে উল্টো তোমাকেই বকে দেন বলে ! কী, ঠিক বলিনি ? এবার আর কেউ জবাব দিচ্ছে না। ইঁদুরের মতো চোখ পিটপিট করে সবাই স্যারকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। আশ্চর্য ! স্যার এসব জানলেন কী করে ! আমরা সবাই আমাদের আম্মুর সাথে এরকম রাগারাগি করি। আসলে এটা রাগারাগি নয়, এটাকে বলে অভিমান। কেন করি জানো ? এতে আমাদের আম্মু কিচ্ছু মনে করেন না।

আমাদের কোন ক্ষতি হোক আমাদের আম্মু তা কখনোই চান না। মায়েরা সবসময় সন্তানের ভালো চান। কিন্তু আমরা আম্মুর সাথে রাগারাগি না করলে আমাদের ভালোই লাগে না। তাই না ? ভেবে দেখো তো, আম্মু যদি কাছে না থাকেন আমরা কার সাথে এমন অভিমান করবো ? আমাদের কি ভালো লাগবে ? ক্লাশরুম কাঁপিয়ে একযোগে উত্তর এলো- ‘না...’ তোমাদের এরকম একজন বন্ধু আছে, যে আর কখনোই তার আম্মুর সাথে রাগারাগি করতে পারে না ! এমন কথা শুনে সবাই চোখ বড় বড় করে স্যারের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। স্যার বলে যাচ্ছেন- তোমরা সবাই তোমাদের সেই বন্ধুটিকে চেন।

তার নাম মাহমুদ জামান টিপলু ! ওর আম্মু নেই ! হঠাৎ কাশ জুড়ে কী যেন হয়ে গেলো। একটা ঝিম ধরা নীরবতা নেমে এসে এদিক ওদিক ঘুরপাক খেতে লাগলো। সবাই ফিরে পেছনে বসা টিপলু’র ফেলফেল করা মুখের দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। শাহরিয়ার স্যার টিপলুর কাছে এগিয়ে এলেন। তার মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে মুখটা নেড়েচেড়ে অনেক আদর মেখে দিলেন।

এবং সহপাঠি বন্ধুদের কাছে হঠাৎ করে মনে হলো টিপলুর মুখটা আসলে খুব সুন্দর ! ওর চেহারাটা এতো মায়াবী যে দেখলেই কেন যেন চোখ ফেটে জল এসে যেতে চায়...! (২৪/০৪/২০০৯) [মাসিক 'টইটম্বুর'/মা দিবস সংখ্যা: মে,২০০৯]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।