আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতির বিবেক , রাষ্ট্রশক্তির পরাধীনতা

রাজনীতির বিবেক, রাষ্ট্রশক্তির পরাধীনতা ফকির ইলিয়াস ====================================== বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হবে। তারা জানিয়েছেন, কোন দল মানুক আর না মানুক ইসি এর তোয়াক্কা করবে না। নির্বাচন কমিশনের এই বক্তব্য বিএনপির চলমান কর্মসূচিতে পেট্রল ঢালবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে বিএনপির এই সময়ের কাজ হচ্ছে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করা। তারা মুখে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের পক্ষের বক্তব্য দিলেও তাদের প্রতিকূলে যেতে পারে এমন কোন সম্ভাবনাকেই মেনে নিতে পারছে না।

বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের শুরু হয় পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পর। একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশে চরম ডানপন্থি শক্তির জাগরণকে পুনরায় সংগঠিত করে এবং তা হয় সামরিক ছত্রছায়ায়। এর পরে সামরিক লেবাসে তথাকথিত 'বহুদলীয় গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার নামে দেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই পুনর্বাসিত করা হয়েছে। বর্তমান বিএনপি সেই ধারাবাহিকতারই উত্তরসূরি। মুখে যাই বলা হোক না কেন, বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা কোন পরিবর্তনকেই মানেননি অতীতে।

তথাকথিত 'আপসহীন'তার নামে মৌলবাদী রাজনীতিকেই তারা জিইয়ে রেখেছেন। যখন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করা হয় তখন বেগম জিয়া বলেছিলেন, 'পাগল' ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। বাংলাদেশে এই তত্ত্বাবধায়ক প্রথারই নগ্ন রূপ দেখিয়েছে বিএনপি। তারা তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতিকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়েছে। এর পরবর্তী ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা সবার জানা।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই পদ্ধতি বহাল রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কতদিন থাকবে, কতজন উপদেষ্টা থাকবে, কীভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন হতে পারে, কীভাবে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ জন্য তার দল প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন বেগম জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আদালত যে রায় দিয়েছে, তাতে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা অন্য বিচারপতিদেরকে না রাখারই সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে বিএনপিও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মানছে না, মানবে না বলে জানিয়েছে। তাহলে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট যে জাতীয় প্রয়োজনে যদি দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় তবে এতে সাবেক বিচারপতি কিংবা বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত না করাই সমীচীন এবং তা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হতেই পারে।

অন্তত এসব আলোচনার জন্য বিএনপির জাতীয় সংসদে যাওয়াটাই একান্তই জরুরি। আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি, সংবিধান সংশোধনী বিষয়ক বিশেষ কমিটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তাদের সুপারিশ মানার ৫১টি প্রস্তাব পেশ করেছে। জাতীয় সংসদ এ বিষয়ে আলোচনার জন্যও প্রস্তুত হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় এটাও দেখছি। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনমুখী না হলে জাতীয় পার্টিই প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

আমি খুব স্পষ্ট করেই বলতে পারি, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোন নির্বাচনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং দেশও চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হবে। হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, এই দেশটির অবকাঠামোকে আরও বিনষ্ট করে তুলতে পারে। বিষয়গুলো বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিবেচনায় রাখা উচিত। যে কথাটি না বললেই নয়, বিশ্বের কোন দেশেই পতিত কোন স্বৈরশাসক রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন না।

সেটা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব হয়েছে। আর সম্ভব হয়েছে এ জন্য, সামরিক বাহিনীর একজন প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ব্যারাকে জন্ম নেয়া আরেকটি দলের কাছ থেকেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরশাদ সায় দিলে তিনিই হতে পারতেন পরবর্তী সময়ে বিএনপির অন্যতম দোসর। জোটের বিপরীতে মহাজোট গঠনের দৌড়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে গেছে বলেই এরশাদ মহাজোটে ভিড়েছেন। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত এবং দারিদ্র্য কবলিত দেশে এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি একটি ফ্যাক্টর তো বটেই।

আওয়ামী লীগকে এ কথা কোনমতেই ভুলে গেলে চলবে না, দেশের মানুষ একটি জাতীয় প্রয়োজনেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী করেছে, এ জাতীয় প্রয়োজনগুলোর অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তার অর্থ এই নয় কোন সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া কাউকে অযথা 'যুদ্ধাপরাধী' আখ্যায়িত করে হয়রানি করা হোক। অন্যদিকে এর অর্থ এই নয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে অযথা কালক্ষেপণ করা হোক। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী মাসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। কিন্তু যেসব রাঘব বোয়াল রাজাকার আলবদর এখনো মুক্ত হাওয়ায় থেকে গেল-তাদের বেলায় কী হচ্ছে? নাকি বিশেষ কোন মহলকে খুশি করার জন্য এদেরকে স্পর্শ করা হচ্ছে না? গণমুখী রাজনীতি সবসময় বিবেকের অর্চনা করে।

আর পরাধীন রাষ্ট্রশক্তি অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতির কাছে বারবার নত হয়। একটি উদাহরণ দিতে পারি অতিসাম্প্রতিক কালের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরকে তার স্বামী নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করে। পুলিশ ওই পাষ-কে গ্রেফতারে গড়িমসি করে। কারণ সে নাকি সরকারি দলের এক শক্তিশালী প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

ওই পাষন্ড এখন কারাগারে আটক আছে। তাকে আটকের জন্য দেশের সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, ছাত্র-শিক্ষক ছিলেন সোচ্চার। এখন শোনা যাচ্ছে এই পাষন্ড স্বামী নাকি নানা ছল ছুঁতোয় পার পেয়ে যেতে পারে। অথচ ভারতে অবস্থানরত, চিকিৎসায় রুমানা মঞ্জুর দুচোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। এটাই হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির পরাজয়।

পাষ-তার কাছে এভাবে হেরে যাবে রাষ্ট্রশক্তির? এভাবে হেরে যাওয়া কি উচিত। আজকের মহাজোট সরকার রাজনীতির বিবেককে জাগ্রত না করে, কালো শক্তিগুলোর কাছে দাসখত দিচ্ছে। এই কালো শক্তিগুলো হচ্ছে, শেয়ারবাজার, লুটপাটকারী, মজুদদার, রাজনৈতিক লুটেরা শ্রেণী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর আমলা এবং স্বার্থবাদী চামচা শ্রেণী। শুধু ভূখন্ড স্বাধীন হলেই যেমন স্বাধীনতা আসে না, তেমনি রাষ্ট্রপক্ষের সব কাঠামোতে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রকৃত শান্তিত্ম আসে না। ধরা যাক তেল গ্যাস উত্তোলন বিষয়গুলোর কথাই।

দেশের খনিজ সম্পদ আহরণ নিয়ে দেশের একটি সচেতন মানবগোষ্ঠী যে সভা সমাবেশ করছেন, তাতে দোষের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। সরকার কোথায় কী চুক্তি করছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানার অধিকার রাষ্ট্রের সব মানুষের রয়েছে। সরকারের উচিত তার ডিটেলস্ জানানো। অন্যদিকে এই ইস্যু নিয়ে সরকার বিরোধীরা যাতে অযথাই আন্দোলনের সুতো টানার সুযোগ না পায় তাও মনে রাখতে হবে এই 'স্বার্থরক্ষা কমিটি'কে। তা নিয়েও যদি হরতাল হয়, তবে ক্ষতিটি কার হচ্ছে? বিএনপিপন্থি পেশাজীবীদের একটি সমাবেশের সংবাদ দেখলাম।

ওই সভায় বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে ঘোষণাবলি পাঠ করেছেন ডানপন্থি একটি পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই সাবেক উপদেষ্টা এমন আদর্শ ধারণ করেন, যা বাঙালিত্বকেই অস্বীকার করে। তার উপদেষ্টা ক্ষমতাকালে কেমন ছিল দেশের জ্বালানি খাত? হ্যাঁ বিবেকের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে, লুটেরা রাজনীতিকরা এমনটি করবেন না। নিউইয়র্ক ২২ জুন ২০১১ -------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২৪ জুন ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- পেট্রিক জলার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.