আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বর্তমান রাজনীতির ভুল এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির কৌশল

মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।

আওয়ামী লীগের একসময়কার তুমুল আন্দোলনের ফসল- বহুল গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিকভাবে বাতিল করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সদ্য সমাপ্ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে বিদেশে শুধু ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্কই সৃষ্টি করেনি, বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসেও হয়তোবা সর্বনিম্ন সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একটি কথিত গণতান্ত্রিক, একপাক্ষিক ও ‘ফলাফল-পূর্বনির্ধারিত’ নির্বাচন হিসেবে এরই মধ্যে রেকর্ড স্থাপন করেছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে-পরে সরকারের বিভিন্ন আচরণ থেকে এও স্পষ্ট যে, যেকোনো মূল্যে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে একটি ‘একদলীয় নির্বাচন’ সম্পন্ন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।

কারণ আওয়ামী লীগ জানত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিরোধী দলের জয়ের সম্ভাবনাই ছিল শতভাগ। এর প্রমাণ বিগত পাঁচ সিটি নির্বাচন। সম্ভবত ওটা ছিল জাতীয় নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণে আওয়ামী লীগ কর্তৃক একটি পরীক্ষা, একই সঙ্গে বিরোধী দলের জন্য ফাঁদ। বিরোধী দল এটা বুঝতে পারেনি, তাই তারা সিটি নির্বাচনে অংশ নিলেও জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পথই বেছে নিয়েছিল। অবশ্য রাজনীতিবোদ্ধাদের মতে এছাড়া কোনো পথ ছিল না।



এদিকে বিরোধী জোটের এতসব বিরোধিতা, লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম, হুমকি-ধামকি, হরতাল-ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াওসহ অসংখ্য প্রকাশ্য জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও সরকার তাদের পরিকল্পনামাফিক নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, দ্রুত সরকার গঠন করেছে এবং শেখ হাসিনার ভাষায় ‘একটি নির্বাচিত সরকার আরেকটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর (শেখ হাসিনার কাছে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন) করেছে। ’ অর্থাৎ তিনি তার ডান হাত থেকে ক্ষমতা বাম হাতে বদল করেছেন। এখন পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করার প্রস্তুতি চলছে মহাসমারোহে। প্রথমদিকে কোনো দেশই স্বীকৃতি না দিলেও ইতোমধ্যেই কিছু দেশ একে একে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে অথবা স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতি তথা আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক কৌশলে স্বীকৃতি না দিয়ে অনেক দেশের উপায়ও নেই।

সেটা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যত অগ্রহণযোগ্যই হোক, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। সুতরাং হলফ করেই বলা যায়, অন্তত আগামী পাঁচ বছরের আগে সরকার গদি ছাড়ছে না। তবে মুশকিল হল, পাঁচ বছর পরও ছাড়ে কি না...!

নির্বাচনে না এসে বিএনপি ভুল করেছে- এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কেননা এর ফলাফল ছিল পূর্ব-নির্ধারিত। অংশ নিলে যা, না নিলেও তা।

তবে না নেয়ার দ্বারা একটা লাভ এই যে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ বৈধ হয়নি, তাই বিএনপির পক্ষে শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে এবং থাকবে। যদিও এ সুযোগ কাজে লাগানোর মতো মেধা ও যোগ্যতা এদের কারো মধ্যে দেখা যায় না। খালেদা জিয়া অযৌক্তিক জেদী, আত্মনিয়ন্ত্রণ কম, আর তারেক এখনো বাচ্ছা ছেলে। মির্জা আলমগীর এবং এমকে আনোয়ারকে ধারণা করা হয়েছিল ভদ্র ও কৌশলী রাজনীতিবিদ। কিন্তু কিসের কি? তারপর মওদুদের উপর নির্ভর করা যেত, যিনি খালেদা জিয়াকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শগুলো দিতে পারতেন, তা হয়নি।

ফলে শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হল। জাতির ঘারে সওয়ার হল একদলীয় সরকারের ভূত।

সংলাপ প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত আশরাফকে ফখরুলের চিঠি দেয়া, সংসদে গিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া, ডিএমপির অনুমতি না পাওয়ায় বিশেষ একটি সমাবেশ নয়া পল্টন থেকে সোহরাওয়ার্দীতে স্থানান্তর করা- প্রতিটি সিদ্ধান্তই ছিল দক্ষতায় পরিপূর্ণ। এর ফলে জনগণের মনে বিরোধী দল বিশাল একটা জায়গা করে নিয়েছিল, সংলাপ বা আলোচনায় আওয়ামী লীগকে বাধ্যও করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা কর্তৃক সরাসরি সংলাপের আহ্বান বা ‘দাওয়াত’ খালেদা জিয়া কড়া ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে এবং পরে নির্দিষ্ট দিনে না গিয়ে চরম ভুল করেছেন এটা আজ সবার কাছেই স্পষ্ট।

আমি তো মনে করি সংলাপ প্রশ্নে খালেদা জিয়ারই প্রথমে উদ্যোগ নেয়া ছিল অপরিহার্য। যেহেতু পরোক্ষভাবে বিরোধী দল সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না অথবা সরকারের কর্মকাণ্ড সমর্থন করছে না। একদিকে সরকারের প্রতি অনাস্থা, অন্যদিকে ‘সরকারেরই উচিত সংলাপের উদ্যোগ নেয়া’- এটা স্ববিরোধী। এ স্ববিরোধিতা এখনো বর্তমান। বিগত সরকারকে উদ্দেশ্য করে শেষ পর্যায়ে এসে খালেদা জিয়া যেমন বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “সে সরকার অবৈধ হলেও আমরা বৃহত্তর স্বার্থে তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছি”, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান সরকারকেও পাঁচ বছর পর একই কথা বলবেন না এর প্রমাণ কি? আসলে চূড়ান্ত আন্দোলনে সাফল্যের একটা পর্যায়ে এসে বিএনপি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।



মা যদি পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচতে নিজ সন্তানকে মাথার উপর থেকে নামিয়ে পায়ের নিচে ফেলে নিজের নাকটা সামান্য উচু করার চেষ্টা করতে পারেন, তাহলে আওয়ামী লীগ কেন জান বাঁচাতে জাতীয় স্বার্থ ভুলে যাবে না? রেল-পদ্ধাসেতু-হলমার্ক-সোনালী ব্যাংকসহ অসংখ্য কেলেঙ্কারী এবং ইলিয়াস আলী, হেফাজত-শাহবাগ-যুদ্ধাপরাধসহ অগণিত ইস্যুর কারণে আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতায় থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না, এখনো নেই। সুতরাং বিএনপি-জামায়াতেরই উচিত ছিল তাদের জন্য একটি বিকল্প রাস্তা তৈরি করে দেয়া, যা দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে শেখ হাসিনা সরকার পশ্চাৎগমন করতে পারে। তা না করে উল্টো যখন তাদের আরো ভয় পাইয়ে দেয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ ‘যা করেছে’ তা ছাড়া সে আর কী করতে পারত? এখনো বিএনপি সেই কাজটা করতে পারে। তা না হলে এই বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য সরকারও টিকে যাবে, এমনকি বিএনপি সমূলে ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে।

আওয়ামী লীগ শর্ত দিয়েছে বলে নয়, কৌশলগত ও আদর্শিক কারণেই বিএনপি-জামায়াত পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।

দু’দলের কেউই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছে না। অবাক লাগে, এত ধকলের পরও এরা রাজনীতিতে নিজেদের কৌশলগত সঠিক অবস্থানটি খুঁজে পেতে এবং দলীয় ও ব্যক্তিগত ইমেজ পরিশুদ্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখন অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে হার্ড লাইন থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে, অহঙ্কার-হুমকি-ধামকি ও জনস্বার্থবিরোধী সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করতে হবে, অতীত ভুলের মাশুল গুণতে হবে। নইলে আগামী পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

সুতরাং সত্তর বিএনপি-জামায়াত আলাদা হয়ে নিজ নিজ কৌশলগত অবস্থান খুঁজে নিক এবং দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন-সংগ্রামের ছক তৈরি করুক। এটা তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও আদর্শকে অত্যন্ত মজবুত করবে বলে আমার ধারণা। আজ হোক কাল হোক, ক্ষমতা থেকে একদিন নামতে হবেই, এমনকি আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করবে।

ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, ‘ব্যক্তিত্ব’ এবং ব্যক্তিত্বে লেগে যাওয়া দাগ দীর্ঘস্থায়ী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী। বর্তমান সরকার শুধু পাঁচ বছর নয়, আরও ২০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও একদিন তা শেষ হবে।

ইংরেজ অপশাসনের সেই দুইশত বছরও শেষ হয়েছিল। কিন্তু ইনু-মেননসহ আরও অনেকের ব্যক্তিত্বে যে কলঙ্ক লেগেছে তা সহজে মুছে যাবার নয়। মানুষ দেখে ফেলেছে ক্ষমতার জন্য কে কি করতে পারে, কার কি রূপ-কত রূপ, গণতন্ত্র ‘কাহাকে’ বলে।
মূর্খতার রাজত্ব যতদিন থাকবে, ছলে-বলে-কৌশলে সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট এক ধরনের সম্মান তারা ভোগ করবে। এতে আল্লাহ কৃপণতা করেন না।

কিন্তু জ্ঞানের রাজ্য কায়েম হলে, জ্ঞানগত বিপ্লব ঘটলে, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, চলতি সব রাজনৈতিক দলই ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। কোনো কৌশলই কাজে আসবে না। কেননা এ জাতীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল-সংগঠনে মৌলিক গলদ আছে, যা সাধারণ মানুষ জানে না। জানলেও বের হওয়ার শক্তি নেই।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট-সংঘর্ষ-সংঘাত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় এ মুহূর্তেই অপরিহার্য একটি নতুনধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চর্চার বিকল্প প্লাটফরম গড়ে ওঠার ভিত রচনা করা।

প্রয়োজন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন; মানসিক শক্তির উন্নয়ন, বিকাশ ও দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন। এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা, গবেষণা, পর্যালোচনা ও প্রশ্নোত্তর করতে একদল মানুষ নিজেদের আলাদা করা উচিত। খুব ক্ষুদ্র একটি দল- যারা দুর্বল কাজ, পেশা, অর্থ-সম্মান পেছনে ফেলে জ্ঞানের মশাল হাতে জাতিকে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রত্যয়ী।

সাপ্তাহিক লিখনী, ১২ ফেব্রোয়ারী, ২০১৪ (চলতি সংখ্যা)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.