অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!
লাতিন আমেরিকার বিপ্লবের অগ্রনায়ক সাইমন বলিভারের স্মৃতিধন্য কলাম্বিয়ার সান্টা মার্তা শহরে এসেছি আজ নিয়ে তিনদিন। রোববার সকালে বাংলাদেশ গনিত দলের চার সদস্য সৌরভ দাশ, জাহিদুল হাসান, নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ আর আদিব হাসানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৫০ ঘন্টা পর আমরা সান্টা মার্তাতে পৌছেছি। ব্রাজিলের শাও পাওলো থেতে বগোটা অভিমুখী ফ্লাইট প্রায় ঘন্টা দেড়েক বিলম্ব করে্। আমি ভেবেছিলাম কানেকটিংটা আর ধরা যাবে না।
কিন্তু দেখা গেল কলম্বিয়ানরা বেজায় সহায়তাকারী। একজন আমাদের লাইন এগিয়ে দিল আর বুকিং এসিসট্যান্ট সিট নং-দাড়াইয়া লিখে আমাদের বোর্ডিং কার্ড ধরাই দিয়া বললো দৌড়ে গেটে যাও, একটা কোন ব্যবস্থা হবে। আসলেই হল। ইংরেজি জানে না এমন একজন আমাদের জন্য আরো দুইটা সিটের ব্যবস্থা করে প্লেনে তুলে দিল। মাহি অবশ্য বললো – স্যার, আমরা না হয় এতো হুরমার করে প্লেনে উঠলাম, আমাদের লাগেজগুলা কি পারবে?
না, পারে নাই।
কাজে আমরা পৌছালেও লাগেজের কোন পাত্তা পাওয়া গের না। আমি প্রায় সবাইকে এমন আশংকার কথা বলেছিলাম কিন্তু দেখা গেল জাদিদ আর আদিব বাড়তি কোন প্যান্ট নিজেদের সঙ্গে রাখে নাই!
সান্টা মার্তার এক অসম্ভব সুন্দর রিসোর্টে আমাদের রেখেছে। সেখানকার বর্ণনা আস্তে ধীরে দেবো।
আপাতত আমার খেরোখাতার উদ্বোধনী পর্ব!
২২ জুলাই, সন্ধ্যা : কালরাতে অনেকক্ষন পর্যন্ত রিসেপশনে বসে ছিলাম। কিন্তু মালামালের খবর নাই।
তাই আমরা ঠিক করেছি আইএমও থেকে দেওয়া টি-শার্ট পরেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবো। সেই হিসাবে আমি সকালে উঠছি। যদিও সরারাত আধোঘুমে কেটেছে। শেভ করে গোছল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেসময় দেখি দরজায় টোকা। দরজা খুলে দেখলাম সৌরভরা।
সঙ্গে আমার স্যুটকেস!!!
বললো রাত ১১টার দিকে এসেছে। মনে হয় আমি ঘুমিয়ে থাকায় ফোনের আওয়াজ পাই নাই। পরে অবশ্য শ্রীলংকার ডেপুটি জানালো তাকে নাকি ফোনে জানানো হয়েছে। যাকগে, ব্যাগ পাওয়াতে আমরা আমাদের অরিজিন্যাল প্ল্যানে ফিরে গেলাম। আমি পড়লাম লাল সবুজ ফতুয়া আর ওরা পড়লো লাল-সবুজ টিশার্ট।
সবগুলোর পেছনে ইংরেজিতে বাংলাদেশ লেখা।
আমার ভিলার ঠিক সামনেই একটি রেস্টোরেন্ট টিপিকা লরেটো। সেখানেও দেখলাম নাস্তার ব্যবস্থা। সব স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া দাওয়া। কোন ভাজি-পোড়া নাই।
পাউরুটি মাখন, জেলী, খুবই কম তেলে ডিম ভাজি, আলু ভর্তা। সব মিলিয়ে ভাল।
আলাপ হল বসনিয়া হারজেগোভিনার ডেপুটি বরিসের সঙ্গে। হাসিখুশী বরিসের থেকে জানলাম মজার কথা। ওদের দেশে তিন জাতি- সার্ব, ক্রোয়াট আর বসনিয়ান।
কাজে ওদের কোন প্রেসিডেন্ট নাই, আছে প্রেসিডেন্সি। তিন গোত্রের তিন জন। চারমাস করে একজন ফর্মাল প্রেসিডেন্ট। সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় তিনজনকে মিলে। কাজে মোটামুটি খবর হয় একমত হতে।
আর আমাদের দেশের মত ওখানেও কেও আর গণিত পড়তে চায় না। ফলে তাদেরকেও নানান কিছু করতে হয় শিক্ষার্থীদের গণিতে আগ্রহী করার জন্য।
ইংরেজি আদ্যাক্ষরে সামনের দিকে থাকায় আমাদের বাস নম্বর হল দুই। আমরা রওনা দিলাম বারেনকুইলার পথে। আমি ভেবেছিলাম এটি মনে হয় ঘন্টাখানেকের জার্নি।
কিন্তু দেখা গেল পথ আর ফুরায় না। আমার পাশে আমাদের গাইড দাভিদ অনেক ঘুমালো। আমি কিছুক্ষণ রাস্তার দুই পাশে দেখি। অনেকক্ষন সমুদ্র পাশে থাকে। পড়ে দেখা গেল পাশে পাহাড়।
দাবিদ জানালো ওদের দেশে তিনটি পর্বত সিস্টেম আছে। এর মধ্যে সান্টা মার্তারটা সবচেয়ে আকর্ষনীয়। এটির নাম সিয়েরা নেভাডা ডি সান্টা মার্টা। মজার ব্যাপার হল এই পর্যতের মাত্র১০০ মিটার করে ওপরে উঠলে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী করে কমে!!!প্রায় আড়াইঘন্টা পর একটা নদী পার হলাম এবং বুজলাম যে ব্যারেনকুইলাতে এসে পড়েছি। এতদূরে কেন যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতে হল সেটা অবশ্য বুঝলাম আরো পরে।
আমাদের অনুষ্ঠান হবে ইউনিভার্সিটি আরডেস নর্থে বা নর্থ বিম্ববিদ্যালয়ে। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য শ’খানেক শিল্পী নানান রঙ্গের পোষাক আর সাজ সজ্জা নিয়ে অপেক্ষা করছে। কারো পোষাক বিচিত্র। আবার কারো গায়ে খুবই কম পোষাক। সারা গায়ে কালি মেখেছে।
একজন এমনভাবে সেজেছে মনে হচ্ছে তার কোন কল্লা নাই। তার কল্লা তার এক হাতে, আর এক হাতে একটা তলোয়ার! এবার অবশ্য ডেপুটিরা মঞ্চে যাবে না। কাজে আমরা গিয়ে এক কোনায় বসলাম। বিশাল বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের একদিকে সব ছাত্র আর আমরা। আর অন্যদিকে লিডারদের জায়গা।
কিছুক্ষনের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হল।
অনুষ্ঠানে শহরের মেয়র এলসা নগুয়েরা জানালেন, বরানকিউলাসের নানান সাফল্য-ব্যর্থতার কথা। ২০০৬ সালে শহরটি দেউলিয়া হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০০৮ সালে নতুন উদ্যমে শহরকে গড়ে তোলা হয়। এখন সেখানে সাক্ষরতার হার শতভাগ, যা দেশের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রধান শহরের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন কলম্বিয়ার শিক্ষামন্ত্রী মারিয়া ফার্নান্ডো, আইএমও উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান নজর আগাখানভ।
স্প্যানিশ গানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে ৭ থেকে ১৯ বছরের একদল শিক্ষার্থী। সবচেয়ে জমজমাট অংশটি ছিল প্রায় ১০০ জন শিল্পীর কারুকার্যখচিত জামা পরে নৃত্য পরিবেশনা। এতে উঠে আসে দক্ষিণ আমেরিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।
সাংস্কৃতিক দলের সদস্যরা প্রতিটি দেশের গণিত দলকে নেচেগেয়ে মঞ্চে নিয়ে আসেন।
প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা। ইংরেজি বর্ণমালা অনুসারে প্রায় প্রথম দিকেই মঞ্চে ডাক পায় বাংলাদেশের সৌরভ, সফিউল্লাহ, জাহিদুল ও আদীব।
উপস্থাপকের জানানো তথ্য থেকে বুঝলাম এই আয়োজনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করার জন্য আবেদন করেছে কলম্বিয়া। তাদের দাবি, এটিই দক্ষিণ আমেরিকার আদি রেড ইন্ডিয়ানের ঐতিহ্যের অংশ। আর প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে কলম্বিয়ানরা এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
ঠিক তখন বুঝলাম কেন আমাদের এখানে আনা হয়েছে। কারণ তাতে বিশ্বের ১০৩টা দেশের সামনে কলম্বিয়ার দাবিটি উঠে এল।
অনুষ্ঠানের বাকী কিছু আর লিখলাম না। ছবি দিয়ে দিচ্ছি।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।