এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি
বিমলেন্দু সেনগুপ্ত কর্তৃক অনুদিত ও ইয়াকভ পেরেলমান লিখিত অঙ্কের খেলা গ্রন্থটি আমি পড়েছিলাম অনেক ছোট বেলায়, আমাকে গণিতের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা এনে দিয়েছিল বইটি। পরবর্তীতে অনেক সমস্যা নিজেই তৈরী করেছি, নিজেই সমাধান করেছি, কম্পিউটার সাইন্সে পড়তে এসে প্রচুর মজার এবং জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে, কিন্তু ছোট্টবেলার সেই বইটিকে আমি সবসময়ই বুকের মাঝে একটি বিশেষ স্থান দিয়ে রেখেছি। বইটিতে ছিল কয়েকটি গল্প, আজ ইচ্ছে করছে সেখান থেকে একটি গল্প সবার সাথে শেয়ার করতে, কারণ, অনেকেই হয়তো পরেননি বইটি। যারা আগেই এই গল্পটি জানেন, তাঁদের জন্য এই পোস্ট নয়। গল্পটি ধর্মীয় বিচারে অন্যরকম হতে পারে, ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্ম দুটির পৌরাণিক গল্পগুলো কাছাকাছি হলেও আদর্শ ভিন্ন, গল্পগুলোর কিছু কিছু স্থানে দেখা যায় উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম, কিন্তু আমার আলোচনার বিষয় সেটা নয়।
আমি কোন ধর্ম বিদ্বেষী নই, ধর্মান্ধও নই, আমি শুধু গণিতের প্রতি ভালোবাসা থেকে ইয়াকভ পেরেলমানের এই গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি এবং গণিতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আজ আপনাদের সঙ্গে গল্পটি শেয়ার করছি। পড়ে দেখুন, কিছুটা ভালোলাগা আপনাদেরও ছুঁয়ে যায় কি না। কিছু বানান অনুবাদক অন্যভাবে লিখেছিলেন, আমি তাদের চলিত রূপ আর লিখিনি, সেভাবেই রেখেছি।
১. মহাপ্লাবন
বাইবেলে আছে, পৃথিবীতে একসময় বৃষ্টির জলে এমন মহাপ্লাবন হয়েছিল যা সবচেয়ে উঁচু পর্বতকেও ছাপিয়ে উঠেছিল। এই কাহিনীতে আছে-"পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে পরে ঈশ্বরের খুব অনুতাপ হয়েছিল।
"
ঈশ্বর বললেন, "যে মানুষকে সৃষ্টি করেছি তাকে বিনষ্ট করে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলে দেব আমি, মানুষ, পশু, লতাপাতা বা আকাশের পাখি, সবকিছু!"
একমাত্র ন্যায়পরায়ণ নোয়া-কেই বাঁচাতে চেয়েছিলেন ঈশ্বর। তিনি তাঁকে পৃথিবীর আসন্ন ধ্বংস সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে একটা জলযান বানাতে বললেন, যা হবে ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া এবং ৩০ হাত উঁচু। জাহাজটা ছিল তেতলা। শুধুমাত্র নোয়া এবং তাঁর পরিবারবর্গ বা তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের আত্নীয়-পরিজনই নয়, পৃথিবীর সমস্ত জীবিত প্রাণীর বংশরক্ষা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সময়ের পক্ষে পর্যাপ্ত খাবার ও একজোড়া করে প্রতিটি জীবিত প্রাণী এই জাহাজে নেবার জন্যে নোয়াকে নির্দেশ দিলেন ঈশ্বর।
পৃথিবীর সমস্ত জীবিত প্রাণীকে ধ্বংস করার উপায় হিসেবে ঈশ্বর বেছে নিলেন এই মহাপ্লাবনকে। সমস্ত মানুষ আর পশুকে বিনাশ করার হাতিয়ার হল জল। তারপর নোয়া এবং যে সমস্ত প্রাণীকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হল তারাই সৃষ্টি করবে নূতন মানবংশ ও জীববগৎ।
বাইবেলের বর্ণনাঃ "সাতদিন গত হলে প্লাবনের জল এল মাটির বুকে...চল্লিশ দিন, চল্লিশ রাত বৃষ্টি ঝড়ে পড়ল পৃথিবীতে...জল বেড়ে উঠে ভাসিয়ে তুলল সেই জাহাজকে...অন্তহীন জলরাশি জমল পৃথিবীর উপর। আকাশের নীচে উঁচু হয়ে ছিল যত পাহাড়পর্বত সব ডুবে গেল জলের নীচে।
পনের হাত উঁচু হয়ে জমে রইল জল...পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী হল বিনষ্ট। শুধুমাত্র বেঁচে রইলেন নোয়া আরা জাহাজে যারা ছিল তাঁর সঙ্গে। "
বাইবেলের বর্ণনামতো আরও ১১০ দিন সেই জল জমে রইল পৃথিবীর উপর, তারপর কমে গেল। তখন যে সমস্ত জীবজন্তুকে তিনি রক্ষা করেছিলেন তাদের সঙ্গে জাহাজ থেকে বেরিয়ে এসে নোয়া নতুন বসবাসের জন্য পৃথিবীতে নামলেন।
মহাপ্লাবনের কাহিনী থেকে দুটো প্রশ্ন উঠেঃ (১) উচ্চতম পর্বতগুলিকেও ডুবিয়ে দেয়ার মতো বৃষ্টি কি সম্ভব? (২) নোয়ার জাহাজে কি সত্যিই পৃথিবীর বংশধরদের জায়গা হওয়া সম্ভব ছিল?
২. মহাপ্লাবন হওয়া কি সম্ভব?
দুটো প্রশ্নেরই সমাধান অঙ্কের সাহায্যে করা যেতে পারে।
মহাপ্লাবনের এই জল এল কোথা থেকে? আকাশ থেকে নিশ্চয়ই। তারপর সেই জল গেল কোথায়? সারা পৃথিবীর জল মাটিতে শুষে নেয়া সম্ভব নয়, অন্য কোন উপায়ে উবে যাওয়াও সম্ভব নয়। একমাত্র যে জায়গায় এই জল যেতে পারে তা হল বায়ুমন্ডলে; অর্থাৎ এই জল বাষ্প হয়ে যেতে পারে। তাহলে বায়ুমন্ডলেই এখন জলটা আছে। এখন যদি আকাশের সমস্ত বাষ্প জমে জলবিন্দুতে পরিণত হয় ও পৃথিবীতে ঝরে পড়ে তাহলে আবার একটি মহাপ্লাবন হয়ে সর্বোচ্চ পর্বতগুলিকেও ডুবিয়ে দিবে।
দেখা যাক ব্যাপারটা সম্ভব কিনা।
বায়ুমন্ডলে কতটা আর্দ্রতা আছে আবহবিদ্যার বইতে তা পাওয়া যাবে। তাতে আছে, প্রতি বর্গমিটার জায়গার উপরিভাগে যে বায়ুমন্ডল রয়েছে তাতে গড়পড়তা ১৬ কিলোগ্রাম বাষ্প থাকে এবং ২৫ কিলোগ্রামের বেশি কখনোই থাকতে পারে না। যদি এই সমস্ত বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে তাহলে সেই জলের গভীরতা কত হতে পারে মাপা যাক। ২৫ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ ২৫,০০০ গ্রাম জলের আয়তন হবে ২৫,০০০ ঘন সেন্টিমিটারের সমান।
এই আয়তন হবে প্রতি ১ বর্গ মিটার, অর্থাৎ ১০০x১০০=১০,০০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গার উপরের স্তরে। জলের আয়তনকে ভূমির ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করলে জলস্তরের গভীরতা পাওয়া যাবেঃ ২৫,০০০:১০,০০০=২.৫ সেমি।
প্লাবনের জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঠতে পারে না, কারণ, বায়ুমন্ডলে এর চেয়ে বেশি জল থাকাই সম্ভব নয়। আবার এইটুকু জল জমা হতে পারে একমাত্র যদি মাটি এই বৃষ্টির জল শুষে না নেয়। [অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাত অনেকসময় ২.৫ সেমিকে ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে জল বায়ুমন্ডল থেকে সোজাসুজি শুধু সেই জায়গায় পড়ে না, পাশাপাশি অন্য অঞ্চল থেকেও বাতাস জল বয়ে আনে। বাইবেলের মতে মহাপ্লাবন একই সঙ্গে সারা পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিয়েছিল জলের নীচে, সুতরাং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে জল আসা সম্ভব ছিল না। ]
আমাদের হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে মহাপ্লাবন যদি হয়েও থাকে তাহলেও জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঠতে পারেনি। এভারেস্ট পর্বতের উচ্চতম শৃঙ্গ হচ্ছে ৯ কিমি উঁচু, অর্থাৎ এই জল থেকে অনেক অনেক উঁচু। বাইবেলে জলের গভীরতাকে মাত্র ৩,৬০,০০০ গুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছে!
আবার যদি বৃষ্টি হয়ে প্লাবন হয়েও থাকে, তাহলে ঠিক যাকে বৃষ্টি বলে তা হয়নি, একটা ঝিরঝিরে বর্ষণ হয়েছে মাত্র।
কেননা ৪০ দিন ধরে বিরামহীন বৃষ্টির ফলে যদি মাত্র ২৫ মিমি জল জমে, তাহলে দৈনিক বৃষ্টি হতে হবে ০.৫ মিমিরও কম। শরৎকালে যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে থাকে, তাতেও এর ২০ গুণ জল হয়।
৩. ঐ রকম একটা জাহাজ ছিল কি?
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা ধরা যাক, নোয়া যে সমস্ত প্রাণীকে রক্ষা করেছিলেন ঐ জাহাজে তাদের সকলের জায়গা হওয়া কি সম্ভব ছিল?
দেখা যাক, মোট জায়গা ছিল কতটা? বাইবেলে আছে, জাহাজটা ছিল তিনতলা। প্রতি তলা ৩০০ হাত লম্বা আর ৫০ হাত চওড়া। প্রাচীন পশ্চিম এশিয়ার লোকদের ভেতর 'এক হাত' বলতে যে মাপ বোঝানো হতো তাকে দশমিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করলে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ সেমি বা ০.৪৫ মিটার।
তাহলে প্রতি তলা ছিল ৩০০x০.৪৫=১৩৫ মিটার লম্বা আর ৫০x০.৪৫=২২.৫ মিটার চওড়া।
তাহলে প্রতিটি মেঝের মাপ ছিল ১৩৫x২২.৫=৩০৪০ বর্গ মিটার (প্রায়)।
সুতরাং তিনটে তলা মিলিয়ে প্রাণীদের জন্য মোট জায়গা ছিল ৩০৪০x৩=৯১২০ বর্গ মিটার।
এখন দেখা যাক, কেবল স্তন্যপায়ীদের জন্যেই এই জায়গা যথেষ্ট কি না। স্থলে স্তন্যপায়ী আছে প্রায় ৩৫০০ জাতের।
আর নোয়াকে স্তন্যপায়ীদের জন্যই কেবল জায়গার ব্যবস্থা করতে হয়নি; যে ১৫০ দিন ধরে জল পুরোপুরি কমে যায়নি ততদিন চলার মতো যথেষ্ট খাবারেরও জায়গা দিতে হয়েছিল। তারপর আবার এ কথা ভুললে চলবে না যে শিকারী প্রাণীদের নিজেদের জন্যেই শুধু জায়গা হলে চলবে না, তাদের শিকারের জন্যেও জায়গা দরকার। আবার এই শিকারের খাদ্যের জন্যেও জায়গা দরকার। জাহাজের প্রতিজোড়া স্তন্যপায়ীর জন্য জায়গা ছিলঃ
৯১২০:৩৫০০=২.৬ বর্গ মিটার।
নিঃসন্দেহে এই জায়গা পর্যাপ্ত নয়।
বিশেষত আরও একটা জিনিস ধরতে হবে। নোয়া ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্যও কিছু জায়গার প্রয়োজন ছিল, এবং প্রাণীদের খাঁচাগুলোকে ফাঁক ফাঁক করে রাখতে হয়েছিল।
স্তন্যপায়ী ছাড়াও নোয়াকে অনেক প্রাণী নিতে হয়েছিল। হয়তো তারা স্তন্যপায়ীদের মতো এতো বড় নয়। কিন্তু তাদের ভেতর আছে অনেক বেশী জাতি ও প্রকারভেদ।
তাদের সংখ্যা প্রায় এইরকম দাঁড়াবেঃ
পাখি.......................১৩,০০০
সরীসৃপ.....................৩,৫০০
উভচর.......................১,৪০০
অঙ্গুরীমাল................১৬,০০০
পতঙ্গ..................৩,৬০,০০০
কেবল স্তন্যপায়ীদেরই যদি ওই জাহাজে গাদাগাদি করে থাকতে হয়, তাহলে অন্যান্য প্রাণীর জন্যে ওখানে তিল ধারণ করার জায়গাও ছিল না। পৃথিবীর যাবতীয় জীবিত প্রাণীর জন্য জায়গা দিতে হলে জাহাজকে তার আসল মাপের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বড় হতে হয়। তাহলে বাইবেলের কথামতো এটা ছিল একটা বিরাট জাহাজ। নাবিকদের ভাষায় বলতে গেলে জাহাজটার আকৃতি ছিল ২০,০০০ টন জল স্থানচ্যুত করার মতো। সেই যুগে যখন জাহাজ নির্মাণ শিল্পের শৈশব অবস্থা তখনকার লোকদের পক্ষে এই বিরাট মাপের জাহাজ তৈরির কায়দাকানুন জানার কথা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
জাহাজটা বড় হতে পারে, কিন্তু যে বিরাট কাজের বর্ণনা বাইবেলে দেওয়া আছে তা পালন করার মতো বড় ছিল না। প্রশ্নটা আসলে পাঁচ মাসের উপযুক্ত খাবার দাবার সহ একটা পুরো চিড়িয়াখানা নিয়ে যাওয়ার মতোই।
মোদ্দাকথা, বাইবেলে প্লাবনের গল্পকে মিথ্যে করে দিচ্ছে অঙ্কের হিসেব। আসলে ওরকম কিছু ঘটাই অসম্ভব। যদি কিছু হয়েও থাকে তো মনে হয় কোন স্থানীয় বন্যা হতে পারে।
বাকি গল্পটা কল্পনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।