শারদশশীর অনন্ত অপেক্ষায় তোর চোখের সবুজ রঙ আকাশনীল হয়ে গেলে ঠিক ধরে নিস আমি হারিয়ে গেছি ঘাসেদের দলে...
আমার আব্বু। মানুষ হিসেবে খুব সহজ সরল। মারপ্যাচ বোঝেন কম। যেটা বোঝেন সেটা হল নিজের কাজ। সংসার সন্তান এগুলোকে কিছুটা অবহেলাই করেছেন তিনি সারাজীবন।
কাজ আর অফিস। অফিস আর কাজ। এমনকি বাসায় বসেও অফিসের কাজ।
একটু বড় হবার পর বুঝতে পারলাম, আব্বু তার সন্তানের কাছে প্রথম যা চান, সেটা হল পড়াশোনা। শেষ যা চান, তাও ঐ পড়াশোনাই।
আমি ছোটবেলায় থেকেই ততটা ভাল ছাত্র ছিলাম না। যদিও রোল ৫ এরনিচে নামেনি কখনো। আব্বুর তাতেই আপত্তি। কেন ১ম হবেনা আমার ছেলে? ক্লাস টুতে উঠে প্রাইমারী ছেড়ে যাব যখন, তখন অবশ্য রোল দুই ছিল আমার। ক্লাস থ্রি তে ভর্তি হলাম শহরের নামকরা স্কুলে।
কোন কোচিং ছাড়াই। (এখন দেখতে অবাক লাগে বাচ্চাদের ক্লাস ১ এ ভর্তি হবার জন্যও কোচিং করতে দেখে। এত চাপ ওরা সহ্য করে কিভাবে?)
যাহোক, স্কুলে এসে রেজাল্ট আর ততটা ভাল থাকল না। ২০ এর ভেতর থাকতে লাগলাম। আগেই বলেছি পড়ালেখা কোনকালেই অতটা ভাল লাগত না আমার! আমি বরঞ্চ ছবি আকতে খুব ভালবাসতাম।
এটা দেখে আব্বু আমাকে ছবি আকা শেখার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যখন সিক্সে উঠলাম, পড়েলেখার চাপ বেশি বলে ওখান থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হল আমাকে। আকিবুকির সেখানেই ইতি। আমি আর কখনো ইচ্ছে করে আকার খাতা মেলে বসিনি। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন।
বই পড়তাম খুব। গল্পের বই, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর ম্যাগাজিন। আব্বু মোটেও এগুলো পছন্দ করতো না। আব্বুর হাতে পরলেই সব শেষ। ছিড়ে কুটিকুটি।
টিফিনে কটা টাকাই বা পেতাম! ১০ টাকা মনেহয়। সেটাই জমিয়ে জমিয়ে কত বই, কমিকস! আর সেগুলো যখন আব্বু ছিড়ে ফেলতো, তখন মনে হত দুনিয়াতে তার চেয়ে বাজে আর কেউ নেই।
নাইনে উঠে গানের নেশা পেয়ে বসল। দিনরাত লিখি আর লিখি। কোনটা কবিতা হয়, কোনটা হয় লিরিক।
কোনটা ছোটগল্প আর কোনটা কিছুই না। সেগুলো ছিড়ে ফেলি। মাঝে মধ্যে ডাচম্যানের যে কবিতা টবিতা গুলো আপনারা ধৈর্য্য নিয়ে পরেন, সেগুলোর প্রায় সবই ঐ সময় লেখা।
আব্বু এস এস সি পর্যন্ত আমাকে নিয়ম করে পড়া ধরত। বসত স্কেল নিয়ে।
না পারলেই ঠাস! কত যে মার খেয়েছি! ইন্টারে উঠে আর আব্বু আমাকে পড়া ধরত না। শুধু বলেছিল, তুমি বড় হয়ে গেছ, নিজের ভালটা তোমাকেই বুঝতে হবে। আমি বুঝিনি। নতুন মুক্তির স্বাদ পেয়ে সব কথাগুলো উড়ে গিয়েছিল দমকা হাওয়ার মত। পড়ালেখা এতই খারাপ হল যে ইয়ার ফাইনালে ফেল করে বসলাম।
বাসায় চিঠি পাঠানোর কথা ছিল কলেজ থেকে। ভয়ে ভয়ে থাকতাম। পরে অবশ্য পাঠায়নি। সেকেন্ড ইয়ারেও তুলে দিয়েছিল। সরকারী কলেজ বলে কথা!
কলেজ ম্যাগাজিনে আমার কবিতা আর ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল।
আব্বুকে দেখালাম। আব্বুকে সেটা দেখে খুশি হয়েছে বলে মনে হয়নি। উলটো আম্মুকে বকা দিত, তোমার ছেলে এসব করেই উচ্ছন্নে যাবে।
আজ পর্যন্ত আব্বুকে আমি সবচেয়ে খুশি দেখেছি আমার এস এস স্যার রেজাল্টের দিন। ওইদিনের মত আব্বুকে আমি আর কখনোই খুশি করতে পারিনি।
আমারই ব্যর্থতা।
আব্বুর কে অনেক বলেকয়ে একটা গিভসন অ্যাকুয়েস্টিক গীটার কিনে ফেললাম। আব্বু বলেছিল, গিটার কিনে দিলাম, কিন্তু এতে যেন পড়ালেখার কোন ক্ষতি না হয়! আমি কথা রাখতে পারিনি।
এ প্লাস পেলাম না ইন্টারে। ঢাকায় চলে এলাম।
ছোটবেলা থেকে নাকি আমি বলতাম ইঞ্জিনিয়ার হব। আব্বু আমাকে ইলেক্ট্রিকালে ভর্তি করিয়ে দিল। যদিও পড়তে চেয়েছিলাম সি এস ই। আব্বু রাজী হয়নি। ঢাকায় এসে প্রথম প্রথম ভাল লাগত।
মনে হত যাক আর ঝাড়ি খেতে হবে না!
ছোটবেলা থেকে অনেক স্ট্রাগল করে বড় হয়েছে আব্বু। সেদিনের সেই ছোটপদ থেকে স্ট্রাগল করেই আজ আব্বু একটি প্রথম সারির ইন্সুরেন্স কোম্পানীর ডি এম ডি। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। আমি পারবোতো পুরণ করতে? মা বাবার একটাই মাত্র সন্তান আমি। প্রত্যাশার চাপটা তাই অনেক বেশি।
আমি ভাবতাম আমার অন্যান্য কাজগুলো বোধহয় আব্বুকে স্পর্শও করে না। আমি ভুল জানতাম। গতবার বইমেলায় কিছু ব্লগার মিলে আমরা একটা গল্প সংকলন বের করেছিলাম। আবার সবুজ অঙ্গন সাহিত্য সংকলনে একটা কবিতাও গিয়েছিল। আব্বুকে বইদুটো আমি নিজ হাতে দেখিয়েছিলাম।
আব্বু কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কিন্তু পরে আম্মুর কাছে জেনেছি আব্বু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার গল্পটা পড়ত। আব্বুর কোনদিনই বই পড়ার অভ্যাস ছিলনা। কিন্তু এবারের বইমেলায় আব্বু আমাকে অবাক করে দিয়ে ৫ টা বই কিনে দিয়েছিল। নিজের জন্যও (এই প্রথম) ৪ টা বই কিনেছিল, যা দেখে আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম।
আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল এবারেও আমার লেখা আছে এমন কোন বই বেরিয়েছে কিনা! সেদিন অনেক দেরীতে হলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম আব্বু ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারে না।
আমি বুঝি আব্বু যেভাবে বড় হয়েছে তাতে আমার যেসমস্ত চিন্তাভাবনা সেটা আব্বুর কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু আমারো তো কিছু স্বপ্ন ছিল। সেগুলর ভবিষ্যত এখন না না থাকার মাঝামাঝি। আব্বুর সাথে খুব কম বিষয়েই আমার মতৈক্য হত।
কিছুটা ভয় ও পাই তাকে। আব্বুর সাথে আমার কমিউনিকেশন গ্যাপ অনেক। ছোট থেকেই আব্বুকে সেভাবে কাছে পাইনি। আব্বুর কাছে মিথ্যাও বলি অনেক। এই মিথ্যার ভারেই মনে হয় নরকে যাব! দিন শেষে হয়ত আব্বুর সাথে একবার কথা হয়, কোনদিন তাও হয় না।
হলেও তার বিষয়বস্তু হয়, পড়ালেখা ঠিকমত করছি কিনা, আর আমার শরীর ভাল আছে কিনা। এছাড়া খুব কম সময়েই আব্বুর সাথে আমার অন্য কোন বিষয়ে কথা হয়।
এখন যখন ঢাকায় থাকি, অনেক মিস করি তাকে। আম্মুর সাথে আমার জমে বেশি। তবুও আব্বুটা একটা আলাদা মানুষ! তাকে শ্রদ্ধা করি।
তার সততার জন্য, সরলতার জন্য। আব্বুটা খুব বোকা। নিজের কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাই মাঝে মাঝে রাগারাগী করি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে পারিনা।
এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। কষ্ট পাই। স্যরি বলতে কেন যেন বাধে। গলায় এসে আটকে যায়। বলা হয়না আমি ঝগড়া করতে চাইনি।
আমার খারাপ লাগছে। আব্বু আমি স্যরি। কখনো বলা হয়ে ওঠেনি আব্বু আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি, তোমার কথা ভাবি। তুমি আর দশজনের মত সাধারণ কেউ নও আমার কাছে...
শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়ে ওঠে কই?? গলায় এসে আটকে যায়। সাহস করে বেরও হতে পারেনা...
এলোমেলো হয়ে গেল লেখাটা।
আমার অনেক অপারগতার মধ্যে একটা হল গুছিয়ে লিখতে না পারা। আরো অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা করছিল। না থাক। ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।