চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি সাম্রাজ্যবাদ বদলে যেতে থাকা সময়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে, নতুন নতুন অস্ত্রে শান দিয়ে তার আগ্রাসন চালিয়ে যেতে সচেষ্ট। আজকের পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদ বলতে নানা কারণে মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকেই বুঝে থাকে। তার আগ্রাসনের নানা ধরণের মধ্যে একটি নতুন দিক খুব সম্প্রতি প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। জানা গেছে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদ (এন এস এ) সারা পৃথিবীর ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছে, এবং স্বাভাবিকভাবেই এই প্রকল্প অন্য দেশের সার্বভৌমত্বকে আঘাত করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত এই নয়া প্রকল্পের খুঁটিনাটি প্রকাশ করে দিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদেই কর্মরত এক বিশেষজ্ঞ, এডওয়ার্ড স্নোডেন।
স্নোডেন এই খবর প্রকাশিত হবার আগেই আমেরিকা ত্যাগ করেন এবং বর্তমানে তিনি এই ঘটনার সূত্রে আমেরিকার জারি করা গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এড়াতে হংকং হয়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। হংকং যেভাবে আমেরিকার আদেশ উপেক্ষা করে স্নোডেনকে নিরাপদে দেশ ত্যাগে সম্মতি দিয়েছে, তেমনি রাশিয়াও যে আমেরিকার দাবিকে গুরূত্ব দিতে প্রস্তুত নয়, স্নোডেনকে আশ্রয় দেবার মধ্য দিয়েই তারা সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় আমেরিকান ষড়যন্ত্রের নক্সা ফাঁসকারী উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জও বর্তমানে আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইংলণ্ডের ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপ্রধান রাফায়েল কোরেয়া স্নোডেন এর রাজনৈতিক আশ্রয়ের পক্ষেও খোলাখুলি মত প্রকাশ করেছেন। আমেরিকার শক্তিশালী উপস্থিতি স্বত্ত্বেও বিশ্বরাজনীতির বহুমেরুকৃত চেহারাটি এই সমস্ত ঘটনায় আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে আসছে।
সেইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের জঠরেই কীভাবে তার ‘অ্যাকিলিস হিল’ মতাদর্শ ও নৈতিকতার বিষয়গুলি লুকিয়ে থাকে স্নোডেন বা অ্যাসেঞ্জরা সেটা দেখিয়ে দিচ্ছেন।
গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকাতে ৬ জুন, ২০১৩ প্রথম প্রকাশিত হয় স্নোডেন এর ফাঁস করে দেওয়া চাঞ্চল্যকর তথ্য এবং তার পর থেকেই এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে বিপুল আলোড়ন। আমেরিকা সারা পৃথিবী থেকে প্রতি ঘন্টায় কুড়ি লক্ষ গিগাবাইট (জিবি) তথ্য সংগ্রহ করছে এবং এই অতি বিপুল পরিমাণ তথ্য দুশো কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত তথ্যখনিতে সঞ্চিত রাখছে। এই গোপন প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে প্রিজম প্রকল্প। ২০০৭ সাল থেকে এই প্রকল্পটি চালু রয়েছে।
আমেরিকা ইন্টারনেটের জন্মদাতা ও সেইসূত্রে বিশ্বজোড়া ইন্টারনেট চলাচলের পথের জাংশন হিসেবে তার অবস্থান। তার স্থলভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইন্টারনেট পথ থেকেই শুধু নয়, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকার উপকুল অঞ্চল এবং ভারত মহাসাগরের তলা দিয়ে প্রবাহিত ইন্টারনেট কেবল থেকেও এন এস এ বিরাট পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিশ্বের প্রধান ইন্টারনেট দৈত্যকায় সংস্থাগুলির প্রায় সবকটিই আমেরিকান, যার মধ্যে আছে গুগুল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, ইয়াহু, ইউ টিউব, স্কাইপ, অ্যাপেল প্রভৃতি। এই সমস্ত সংস্থার কাছ থেকে আমেরিকান সরকার বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছে, কোথাও তাদের স্বেচ্ছা সম্মতিতে, কোথাও সরকারী ক্ষমতার বলে।
প্রিজম প্রকল্পর কথা প্রকাশ্যে আসার পর আমেরিকা জুড়ে প্রবল আলোড়ন উঠেছে।
ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাবার আশঙ্কায় নাগরিকরা আতঙ্কিত। কথা উঠেছে এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, যা আইন বিরোধী। মার্কিন নাগরিকদের দেশজোড়া প্রতিবাদের পর তাদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা জানিয়েছেন, কেবলমাত্র বিদেশীদের তথ্যই সংগ্রহ করা হচ্ছে, আমেরিকার নাগরিকদের নয়, আর এই প্রকল্প তাই আমেরিকার আইনের বিরোধী নয়। সেইসঙ্গে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ৯/১১ পরবর্তী সন্ত্রাস হানার জুজুকে ব্যবহার করে জানিয়েছে এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে জঙ্গী হানা রোখা সম্ভব হচ্ছে। ইতোমধ্যে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আগাম ব্যবস্থা নিয়ে ৫০ টি জঙ্গী হানাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যার ১০ টি পরিকল্পিত ছিল আমেরিকার মাটিতে।
কিন্তু এই সব ঢাল ব্যবহার করেও ব্যাপক গণক্ষোভকে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে এই তথ্যের একাংশ আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ব্রিটেন, ইজরায়েলের মতো তার মিত্র দেশদের সঙ্গেও ভাগ করে নিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এই প্রকল্পের খবরে ব্যাপক দুশ্চিন্তা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ন্যায় বিষয়ক কমিশনার ভিভিয়ানে রিডিং আমেরিকার অ্যাটার্নি জেনারেলকে চিঠি লিখে এই প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স এর মতো দেশগুলি এ ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে চিন, রাশিয়ার কাছ থেকেও। তবে এই সমস্ত দেশগুলি নিজেদের নাগরিকদের থেকেও গোপনে এই ধরণের তথ্য সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কোনও কোনও মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ও অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলি যখন এই প্রকল্পে তাদের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনিয়তার আঘাতের বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি আক্রান্ত হচ্ছে দেখেও ভারত সরকার নিশ্চুপ হয়ে আছে। বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারকে অবশ্যই কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তার নাগরিকদের অধিকারকে সুরক্ষিত করতে হবে। তবে শাসক ইউ পি এ সরকার যেখানে অতীতে নিজেদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের মন্ত্রীদের পরিবর্তন ঘটিয়েছে আমেরিকার অঙ্গুলি হেলনে, সেখানে এ নিয়ে তারা কতটা প্রতিবাদ জানাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
প্রথম ইউ পি এ সরকারের আমলে ইরানের সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন চুক্তিতে উদ্যোগী আমেরিকার অপছন্দের পেট্রোলিয়ম মন্ত্রী মণিশঙ্কর আইয়ারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বসানো হয়েছিল বশংবদ মুরলী মনোহর দেওরাকে। ক্রমশই নিউক্লিয় চুক্তি, যৌথ সামরিক মহড়া সহ নানা বিষয়ে আমেরিকার রণনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গীভূত হয়ে পড়া শাসক শক্তিকে তার নাগরিকদের স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে ব্যাপক গণ আন্দোলনই। অন্যদিকে প্রিজম এর মত ‘উচ্চ প্রযুক্তি’গত বিষয়কে গণ আন্দোলনের বিষয় করে তোলার জন্য তার প্রকৃতিগত দিকটিকে সহজবোধ্যভাবে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। এ জন্য বিশেষজ্ঞ ও গণ আন্দোলনের কর্মীদের উপযুক্ত মেলবন্ধন প্রয়োজন। আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বিজ্ঞান প্রযুক্তি জগতের অনেক জটিল বিষয়কে আশ্রয় করেই হানা দেবে, আর এই বিষয়গুলির মোকাবিলায় জনগণকে সমাবেশিত করে তুলতে হলে তাদের এই বিপদগুলি সম্পর্কে পরিচিত করার দায়ভার বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে, বিশেষভাবে কমিউনিস্ট কর্মীদের নিতে হবে।
নিজেদের নিয়মিত প্রশিক্ষিত করে তোলা ও তাকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই এই সমস্ত বিষয়ে ব্যাপক গণজাগরণ তৈরি করা সম্ভব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।