আমারে দিবো না ভুলিতে ১৮৮৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ফিল্মের জন্য ক্যামেরা আবিষ্কার করলেন। পৃথিবী জুড়ে হৈ হৈ শুরু হয়ে গেলো। একই বছরে অস্ট্রিয়ায় জন্ম নিলো পৃথিবীর নির্মম ঘাতক হিটলার। সে বছরই আরেক শিশু জন্ম নেয়, যে কিনা পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে হাসাতে লুটোপুটি খাইয়ে ইতিহাসের সেরা কৌতুক অভিনেতা এবং নির্মাতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন।
সেই মানুষটির নাম ‘চার্লি চ্যাপলিন’।
প্রকৃতি যেন নিজের জন্যই এই কাকতালীয় ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। যদি ক্যামেরা না হতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে চলচ্চিত্র বলে কোনো কিছুর উদ্ভব হতো না এবং চ্যাপলিনও পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে পারতেন না। আবার যদি হিটলার পৃথিবীতে না জন্মাতো তাহলে চ্যাপলিন তার ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদও জানাতে পারতেন না।
চ্যাপলিনের আগমন পৃথিবীর মানুষকে থমকে দিয়েছিল।
চ্যাপলিন মানেই ব্যঙ্গ, চ্যাপলিন মানেই সারাদিনের পরিশ্রম করা মানুষের মুখে একটু হাসি।
কিন্তু কী এমন আছে চ্যাপলিনের ছবিগুলোর মধ্যে! কেন ছবিগুলো মানুষকে এতো মোহগ্রস্ত করে তুলে? সে সময়কার দুঃখী মানুষগুলো যেনো আশ্রয় খুঁজা শুরু করলো চ্যাপলিনের কাছে।
চ্যাপলিন নির্বাক ছবি করতেন। যার ছবিতে কিছু শোনা যায় না। থাকে শুধু কিছু তামাশা।
সেই তামাশার অতল গভীরে লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনের হাহাকার, রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধে মানুষের অবিরাম যুদ্ধ। মানুষের মনের গোপন সুর চার্লি ছবিতেই বেজে উঠে।
চার্লিকে একবার একজন প্রশ্ন করেছিলেন- আপনার ছবির ছবির হাসি-কান্না দুটোরই সংমিশ্রণ থাকার কারণ কী?
চ্যাপলিন তখন বললেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ দলে দলে ভেড়া নিয়ে যায় কসাইখানায়। একদিন কেমন করে একটা ভেড়া দলছুট হয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। এই না দেখে হৈ চৈ।
লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে মজা দেখতে। ভেড়ার মালিকেরা চেষ্টা করছে ভেড়াটাকে ধরতে। কিন্তু কিছুতেই ভেড়া ধরা দেবে না। ছুটোছুটি। এই সব কান্ডকারখানা দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল।
অবশেষে ভেড়া ধরা পড়লো। পড়তেই হবে। ভেড়া তো ভেড়াই। মানুষের চালাকি কি তার বোঝার ক্ষমতা আছে!! বোকা ভেড়াটাকে কাঁধে নিয়ে একজন কসাইখানার দিকে চলল। ভেড়ার পরিণতি ভেবে হঠাৎ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
তাই-তো! একটু আগে যে ভেড়ার ছুটোছুটি দেখে আমি হাসছিলাম, তার পরিণতি এখনই মৃত্যু। আর থাকতে পারলাম না। ছুটে ভেতরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। মাকে বললাম, মাগো, ওমা ওরা ভেড়াটাকে মেরে ফেলবে।
তার মানে বুঝলেন তো? একই সঙ্গে পাশাপাশি দুটি ছবি।
একটি হাসির অন্যটি কান্নার। একটি মজার অন্যটি দুঃখের। এই ঘটনা আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। এটি আমার চিন্তার জগৎকে ধরে রেখেছে। জানি না, এটাই আমার চিন্তার মূলমন্ত্র কিনা! আমার ছবিতে ঘুরে ফিরে আসে এই অনুভবের মিশ্রণ।
একটি আনন্দের অন্যটি বেদনার। ’
চার্লির চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ৫০ বছরেরও অধিক। সে হিসেবে তাঁকে বলা হয় প্রকৃতির বরপুত্র। বাল্যকাল কেটেছে অত্যন্ত দরিদ্রতার মধ্যে দিয়ে। ফুটপাথে রাত কাটানো এমনকি পচা খাবার কুড়িয়েও খেতে হয়েছে চার্লিকে।
বাল্যকালেই বুঝে গেছেন এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর ও নির্মম। বাল্যকাল থেকেই জীবন যুদ্ধ শুরু করেছেন করেছেন বলেই চার্লি চ্যাপলিন হয়ে উঠেছেন। তিনি একবার জীবন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘জীবন মানেই দ্বন্দ্বের সমন্বয়। এটা শিখতে আমাকে বই পড়তে হয়নি। ’
চার্লির ছবিগুলো আজও মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে।
মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগায়। তেমনই একটি ছবি ‘দি গ্রেট ডিকটেটর’। এটি চ্যাপলিনের সাতাত্তরতম ছবি। ছবিটি তিনি হিটলারকে নিয়ে বানিয়েছেন। এই ছবিটিতে চার্লির দেয়া একটি ভাষণ আছে।
ছবিটি প্রদর্শিত হয় ১৯৪০ সালে। কিন্তু ছবির সেই ভাষণটি এখনও বর্তমানের প্রেক্ষিতের সাথে মিশে যায়।
ভাষণটি তাহলে পড়ে ফেলা যাক :
আমি দুঃখিত, আমি সম্রাট হতে চাই না। সম্রাট হওয়ার ব্যবসা আমার না। আমি শাসনও করতে চাই না।
আমি দেশ দখলও করতে চাই না। আমি সবাইকে সাহায্য করতে চাই। সে ইহুদী-খ্রীষ্টান, সাদা-কালো যাই হোক না কেন। কিন্তু আমাদের লোভ আমাদের হৃদয়কে বিষাক্ত করে দিয়েছে, পৃথিবীটা ঘৃণায় ছেয়ে গেছে। আমরা যন্ত্রসভ্যতার অভিশাপ চাই না, আমরা চাই মানবিকতা।
যন্ত্র আমাদের নির্মম ও কঠোর করে তুলেছে। আমরা অনেক কিছু ভাবি কিন্তু অনুভব করি কম।
অ্যারোপ্লেন কিংবা রেডিও বিশ্ববাসীকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে, পৃথিবীকে ছোট করে দিয়েছে। এসব আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণ, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, সবার মধ্যে ঐক্যের বন্ধন। এসব আবিষ্কারের ফলেই এ মুহূর্তে আমার কণ্ঠও পৌঁছে যাচ্ছে সারা বিশ্বের লাখ লাখ নারী-পুরুষ, নিপীড়িত মানুষের কাছে।
আমার কণ্ঠ যে শুনতে পাচ্ছে- তাকেই বলছি, হাল ছেড়ো না।
মানুষ মানুষে ঘৃণা একদিন দূর হবেই। স্বৈরাচারী শাসকদের মৃত্যু হবেই। জনগণের কাছ থেকে ওরা যে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে সে ক্ষমতা একদিন আবার জনগণ ফেরত পাবে।
হে সৈনিক ভাইয়েরা, তোমরা ওই সব ক্ষমতালোভী শয়তানের ডাকে সাড়া দিও না।
ওরা তোমাদের দাস করে রেখেছে, তোমাদের স্বাধীন চিন্তাকে নষ্ট করে তোমাদের বুদ্ধিহীন পশুতে পরিণত করছে। প্রিয় সৈনিকভাইয়েরা, দাসত্বের জন্য যুদ্ধ করো না, যুদ্ধ করো স্বাধীনতার জন্য। আসুন, আমরা গণতন্ত্রের নামে ঐক্যবদ্ধ হই। একটা সুন্দর সুস্থ পৃথিবীর জন্য আমরা একতাবদ্ধ হই। আর এই গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে স্বৈরাচারীরা মানুষকে মিথ্যা কথা বলে ক্ষমতা দখল করেছে।
মনে রেখো স্বৈরাচারী শাসক সব সময় নিজেকে মুক্ত রেখে সবাইকে দাসে পরিণত করে। এসো, আমরা যুদ্ধ করি একটি নতুন পৃথিবীর জন্য। যেখানে বিজ্ঞান ও প্রগতি একসঙ্গে বন্ধুর মতো এগিয়ে যাবে এবং পৃথিবী সুখের স্বপ্নের দিকে অগ্রসর হবে।
মনে রেখো, মেঘ একসময় কেটে যায়, সূর্য আলো ছড়ায়। আমরাও তেমনই অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে আলোর মুখোমুখি হব।
আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়ব। আমরা এমন এক সুন্দর উজ্জ্বল পৃথিবী গড়ব, যেখানে মানুষ তার লোভ, নিষ্ঠুরতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে, ছাড়িয়ে যাবে নিজেকে। মানুষ উড়ে যাবে রংধনুর দিকে, আশার আলোর দিকে, উজ্জল ভবিষ্যতের দিকে। এমনই অসীম ক্ষমতাধর আত্মা বিরাজ করে তোমার, আমার, আমাদের সবার মাঝে। তাই হতাশ না হয়ে সাহসী হও বন্ধু।
সহায়ক উৎস: চার্লি চ্যাপলিন ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়, মমতাজ উদদীন আহমদ
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।