শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
গত সংখ্যায় ইটভাটার কথা লিখেছিলাম। ইটভাটার শেকলবন্দি শ্রম ক্রীতদাসদের কথা। ইটভাটায় অনেক কিছুই পুড়ছেÑ সীমিত কর্মসংস্থান আর অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে সেটাই স্বাভাবিক। আমার এক সহকর্মী ছিল কাকলী প্রধান। কাকলী খুব সুন্দর ছবি তোলে।
ওর লেখার হাতটিও ছিল শার্প। ওর দেখার শক্তি অসাধারণ। কাকলীর ছবি দিয়ে অনেক ফটোফিচার ছাপা হয়েছে আমার পাতায়। কাকলীর তোলা কিছু ছবিতে আমি ইটভাটার শিশুশ্রমিকদের মুখচ্ছবি দেখেছিলাম। ওরা কাঁচা মাটি কাঠের ডাইসে ঢেলে ইট বানাচ্ছেÑ ছোটবেলায় কাদামাটি ছেনে খেলাধুলা আমরা কে না করেছি।
তেমনই বয়সের শিশুরা কাদামাটি ছেনে কাঠের ডাইসে ঢেলে তৈরি করছে ইট। শিশুশ্রমÑ সস্তা না আক্রা সেই অবুঝ শিশুরা না বুঝলেও ইটভাটার মালিকরা সেটা কড়ায়-গণ্ডায় ঠিকই বোঝেন। এভাবেই শৈশবও ইটভাটায় জ্বালানি হয়ে জ্বলছে। কাকলীর তোলা ছবি আমাকে বিষণœ করেছিল আর বিষণœতা হচ্ছে সবচেয়ে সহজলভ্য বিষয় এই দেশে। ইটভাটার ছবি দেখে আবারও বিষণœতা পেয়ে বসল সেদিন।
না, কোন শিশু নয়, একজন শিক্ষকের ইটভাটার দিনমজুরির ছবি দেখে। মার্চ আমাদের স্বাধীনতার চেতনার মাস। এ মাসেই আমরা অশুভ বর্বরতার শিকার হয়েছিÑ এ মাসেই আমরা উজ্জীবিত হয়েছি স্বাধীনতার মন্ত্রে। স্বাধীন দেশে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরÑ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাÑ এই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের চেহারাটিকেই যেন আমরা ইটভাটায় ইট টানতে দেখলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত পুরো সংবাদটি না পাঠ করলে বিষয়টির মর্মস্পর্শিতা পাঠক আপনাকে বোঝাতে পারব নাÑ চলুন পুনঃপাঠ করি সংবাদটিÑ
এক বেলা শিক্ষকতা অন্য বেলা দিনমজুরি
রোদটা বড্ড তেতে উঠেছে।
দরদর করে ঘামছেন রঞ্জিত। ইটের ভারী বোঝায় টনটন করছে কাঁধটা। মাথা তুলে একবার ওপরের দিকে তাকালেন। সূর্য তখন মধ্য আকাশে। ফেরার সময় হয়ে এসেছে তার।
শেষ বোঝাটা নামিয়ে ভাটা-ব্যবস্থাপকের কাছে গেলেন। আধাবেলার মজুরি বুঝে নিয়ে ইটভাটার এক কোণে রাখা সাইকেলটার দিকে এগোলেন। ধুলোয় ভরা পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা খুলে ব্যাগ থেকে ধোয়া জামাটা বের করে গায়ে চড়ালেন। দ্রুত প্যাডেল মেরে পথ চলতে শুরু করলেন। তাকে যেতে হবে ১৫ কিলোমিটার দূরে।
একসময় একটি মাদ্রাসার আঙিনায় এসে থামলেন রঞ্জিত। ঢুকলেন শ্রেণীকক্ষে। ছেলেমেয়েরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানাল।
একটু আগে যিনি ছিলেন ইটভাটার মজুর, তিনি এই মাদ্রাসার শিক্ষক।
মানুষটার পুরো নাম রঞ্জিত কুমার রায়।
বয়স ৩৬। নীলফামারী সদর উপজেলার বেরাকুটি বরুয়া দাখিল মাদ্রাসায় বাংলা আর ইংরেজি পড়ান। কোন মাইনে পান না। সংসার চালাতে তাকে দিনমজুরি খাটতে হয়। ঘামে ভেজা সেই টাকায় চলে সংসার।
রঞ্জিতের বাড়ি মাদ্রাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ডুবুলিয়া গ্রামে। ঘরে তার স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ে।
প্রায় এক বছর ধরে রঞ্জিত কাজ করছেন সৈয়দপুরের এবিএল (২) ইটভাটায়। ইটভাটায় গিয়ে সম্প্রতি কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কোন দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইটভাটায় কাজ করি।
বিকেলে মাদ্রাসায় পড়াই। কোন দিন বিকেলে কাজ করি, সকালে পড়াই। আধাবেলার মজুরি ১০০ টাকা পাই। ছুটির দিনে পুরো বেলা কাজ করি। ’
রঞ্জিত রায় ১৯৯৫ সালে দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে øাতক পাস করেন।
২০০০ সালে এ মাদ্রাসায় যোগ দেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৫ শতাংশ আবাদি জমি বিক্রি করে সেই টাকা দেন মাদ্রাসার উন্নয়ন খাতে। কিন্তু যোগদানের ১১ বছরেও সেখান থেকে কোন পারিশ্রমিক পাননি। কারণ মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হয়নি। এতদিন বহু কষ্টে সংসার চালিয়েছেন।
এখন যেন আর চলে না।
গৃহশিক্ষকের কাজ করলে তো পারেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে রঞ্জিত বলেন, ‘এটি দরিদ্র এলাকা। যারা একটু সচ্ছল, তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে শহরের স্কুল-কলেজে। তা ছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ায় আমার কাছে কেউ পড়তে আসে না। ’ ‘রঞ্জিত কখনও ক্লাস ফাঁকি দেন না।
’ জানালেন মাদ্রাসার সুপার মো. মোস্তফা কামাল।
১৯৯৯ সালে ৮১ শতাংশ জমির ওপর মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে আর মাদ্রাসা নেই। ৩৫০টি ছেলেমেয়ে পড়ে এখানে। এবতেদায়ি শাখায় চারজন ও দাখিল শাখায় নয়জন শিক্ষক এবং তিনজন কর্মচারী আছেন।
দাখিল ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়ও (জেএসসি) ভালো ফল করেছে মাদ্রাসাটি।
ডুবুলিয়া গ্রামে গিয়ে রঞ্জিতের খোঁজ করলে একজন বাড়িটি দেখিয়ে দেন। বাঁশের বেড়ার ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। সামনে গিয়ে ডাক দিতেই বেরিয়ে আসেন তিনি।
স্ত্রী শৈব্যা রায় বলেন, ‘আমার স্বামী আমাদের জন্য যে কষ্ট করছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না।
আমাদের কষ্ট যেন শেষই হয় না। ছেলেটা বাবার কষ্ট বোঝে। তাই কখনও আবদার করে না। ’
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও রঞ্জিতের প্রতিবেশী মো. জালালউদ্দিন জানান, রঞ্জিত ছেলেটা শান্ত। ওরা চার ভাই।
বড় ভাই মারা গেছেন। অন্য ভাইয়েরা মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু রঞ্জিতকে খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে।
এবিএল (২) ইটভাটার ব্যবস্থাপক গৌরাঙ্গ সরকার বলেন, ‘উনি (রঞ্জিত) বেশ সহজ-সরল। পরে জেনেছি তিনি শিক্ষকতাও করেন।
(মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারীর প্রতিবেদন। দৈনিক প্রথম আলো, ৯ মার্চ, ২০১১, শেষ পৃষ্ঠা ‘জীবনযুদ্ধ’)
আমি এই শিক্ষকের ভেতর আমার পিতার মুখচ্ছবি আবিষ্কার করে আরও বেশি বিষণœ হয়ে পড়ি। এই শিক্ষকের কোন রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেইÑ যা আমার পিতার ছিল। পাকিস্তানি শাসক এবং শোষকদের বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয়েছে। তাদের স্বপ্নের সেই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে গোটা ব্যবস্থাটিই লড়ছে রঞ্জিত রায়দের বিরুদ্ধেÑ যাদের হƒদয়ে এখনও প্রেম আছে, প্রীতি আছে, ভালোবাসা আছেÑ আছে স্বপ্ন, মানুষ গড়ার।
আছে অসাম্প্রদায়িক অবস্থানও। প্রথম আলোর সংবাদ পড়ে অনেক পাঠক শিক্ষক রঞ্জিত কুমার রায়ের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে আগ্রহী হন। কিন্তু রঞ্জিত রায় চান তার প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি। শিক্ষক রঞ্জিত কুমার রায় নিঃস্ব নন, যতটা নিঃস্ব আমরা ওই খবরের পাঠকরা। পাঠকরা করুণা করে ব্যক্তি রঞ্জিতের পাশে দাঁড়াতে চান কিন্তু ব্যক্তি রঞ্জিত দাঁড়াতে চান প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, অনেকের পক্ষে, মনুষ্যত্বের পক্ষে, শিক্ষার পক্ষে।
রঞ্জিত পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৫ শতাংশ আবাদি জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়েছেন মাদ্রাসাটির উন্নয়নের কাজে। ১১ বছর ধরে পাঠদান করছেন শিক্ষার্থীদের, পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন এই কঠোর জীবনসংগ্রাম। রঞ্জিত নিঃস্ব হলে এতদিন টিকে থাকতেন না। রঞ্জিত স্বপ্নবান। আমাদের এই অদ্ভুত আঁধারের দেশে রঞ্জিতরাই আশার প্রতীক।
পুরাণে আমরা প্রমিথিউসের কথা পড়েছি। মানুষের ব্যবহারের জন্য দেবতাদের না জানিয়ে স্বর্গ থেকে আগুন এনে মানুষকে দেয়ার অপরাধে দেবতারা তাকে অনেক শাস্তি প্রদান করেছেনÑ এই দেশ, এই সমাজও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সেবার কাজে যারা নিয়োজিত তাদের সেই একই রকম শাস্তি প্রদানের সর্ববিধ আয়োজন করে রেখেছে। প্রমিথিউস যেমন নিজের দেবত্বের চাইতে অধিক মর্যাদা দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণকে ঠিক একই রকম আÍত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রঞ্জিত হয়ে উঠেছেন এ যুগের প্রমিথিউস।
এ দেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা নানা শ্রেণীর মাপে তৈরি করেছি।
মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। সেই শিক্ষাকে আমরা পণ্য রূপ দিয়েছিÑ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্তÑ নানা কিসিমের বোতল এবং প্যাকেটে তা প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী সেটা কিনতে পারছে। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেবল সিংহভাগ গরিব মানুষের সন্তান। আমরা জানি, অনেক বিতর্ক এবং প্রশ্নবিদ্ধ মাদ্রাসা শিক্ষা; তা সত্ত্বেও দেশের গরিব এবং এতিমদের নামকাওয়াস্তে হলেও শিক্ষার অধিকারকে সীমিত সুযোগরূপেÑ অংশগ্রহণের অবকাশ দেয়া হচ্ছে।
মাদ্রাসার ছাত্র বলতেই আমরা একটা জঙ্গি প্রতিমূর্তির কল্পনা করিÑ কিন্তু যে মাদ্রাসার শিক্ষক রঞ্জিত রায় সে মাদ্রাসার ছাত্রদের পক্ষে কি জঙ্গি হওয়ার অবকাশ মিলবে?
পাঠক, এর ঠিক বিপরীতও আছে। আমিনী-সাঈদীদের মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলো সন্দেহ নেই বিপথগামী করছে অনেক গরিব সন্তানকে। করছে এমনকি ধর্মের লেবাসে ধর্মবিরোধী মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্তও। ধারণা করি, এমন আশংকা থেকেই অনেক পাঠক কেবল ব্যক্তি রঞ্জিত রায়কে সহযোগিতা করতে চান।
কিন্তু আমি মনে করি আমিনী-সাঈদীদের কবল থেকে মাদ্রাসাগুলোকে বাঁচানো এখনকার সময়ের অপরিহার্য কর্তব্য। আমিনী-সাঈদীরা মাদ্রাসাকে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আল্লাহ্পাকের দোয়া-কালামকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছেনÑ একই সঙ্গে সলিলসমাধি ঘটিয়েছেন প্রকৃত ধর্মের। এসব ধর্মব্যবসায়ীর হাত থেকে ধর্মকে বাঁচাতে রঞ্জিতের মতো শিক্ষকদের জীবনসংগ্রামের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য। শুধু এমপিওভুক্ত করে রঞ্জিতের কষ্ট দূর করলে চলবে নাÑ কষ্ট দূর করতে হবে এর সব শিক্ষার্থী গরিবের সন্তানদের। কষ্ট দূর করতে হবে আরও অনেক শিক্ষকের যাদের রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জা চুষে চর্বি বাড়ছে আমিনী-সাঈদীদের।
মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমিনী-সাঈদীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে অবশ্যই। দাঁড়াতে হবে এ যুগের প্রমিথিউসদের পাশে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।