আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবে শুরু আমার লেখালেখি ও প্রথম সন্তানসম উপন্যাসঃ রঞ্জিত জননী

বাস্তবতার ভার্শন ২.৭.১২ এ আছি। নিয়মিত আপডেট হচ্ছি। সময়টা ২০০৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে সারাদিনর কাজকর্মের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা।

স্থায়ী পৈতৃক নিবাস গাজীপুরের উত্তর ছায়াবিথীতে পিতার নজরদারিতে থাকি। পড়তে মন বসে না, আবার না পড়ে উপায়ও নেই। বিজয় দিবস তো কি? পড়াশোনা নিয়ে কোন কথা নাই। সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র হওয়ার পরেও ফিজিক্স, ক্যামেষ্ট্রি, বায়োলোজির প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবুও যখন বোঝা চাপিয়ে নৌকায় চড়েছি, মাঝপথে এসে নৌকা থামানোর কোন উপায় নেই।

হয় পার হও, নাহয় ফিরে যাও। সায়েন্সের বিষয়গুলো পছন্দ না হলেও ইংরেজী, বাংলা আর সামাজিক বিজ্ঞানের প্রতি ভীষন আগ্রহ ছিল। আর এর মূলে ছিলন অক্ষয় স্যার। আমার প্রিয় শিক্ষক। পড়াশোনার বিষয়বাদেও তার কাছে দেখাতাম আমার বিভিন্ন সময়ে লেখা বিভিন্ন গল্প, কবিতা ছড়া।

সেগুলো কেমন ছিল, সে প্রসঙ্গে না যাওয়াটাই বোধহয় শ্রুতিমধুর হবে। তিনি আমার প্রতিটা লেখা দেখেই বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করতেন। হয়তো বা মনে কষ্ট পাই, তা তিনি চাইতেন না। প্রতি সপ্তাহে মোট চারটি পরীক্ষা থাকতো। প্রথম প্রথম প্রতিটা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর খাতা জমা দেওয়ার সময় খাতার ভেতর নিজের লেখা গল্প,কবিতাগুলো গুজে দিতাম।

খাতা যখন মার্কিং করে ফিরিয়ে দেওয়া হতো, সেই সাথে সেই এক্সট্রা খাতাতে(গল্প/কবিতার খাতাগুলোতে) লিখে দিতেন ভাল। আস্তে আস্তে সরাসরিই তার হাতে লেখাগুলো দিতাম। অন্যান্য দিনের মতন সেদিনও মানে ২০০৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বরেও বিজয় দিবস উপলক্ষে একটা ছোট গল্প তাকে লিখে জমা দিলাম। তিনি মুখ দিয়ে কিছু না বললেও লেখাটি দেখবার সময় তার মুখে যে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো, সেটা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো না। মনে মনে আশাহত হলাম।

মনের ভেতরে জেদ চাপলো। আরো লিখলাম, এবং আগেরগুলোর চেয়ে তুলনামূলক ভালো মনে করে নিজেকে স্বান্তনা দিলাম। তিনিও সেগুলোকে ভালোই বললেন। কিন্তু যুদ্ধ বিষয়ক কোন লেখা দিলেই তিনি কোন মন্তব্য করতেন না। মনে মনে ভাবলাম, এবার বেশ চিন্তা-ভাবনা করে, যুদ্ধ বিষয়ক বই ঘাটাঘাটি করে খুব ভালো রকমের কোন গল্প লিখবো।

এদিকে এসএসসি পরীক্ষা চলে এসেছে। শীতকালের প্রচন্ড শীতে সারাদিন পড়াশোনা আর ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্রিকেট খেলেই সময় পার করতে লাগলাম। এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই একদিন বাসা থেকে পালিয়ে বইমেলায় গেলাম বাবার কঠিন নজরদারিকে ফাকি দিয়ে গাজীপুর থেকে শাহবাগ। সময়টা খুব সম্ভবত পাঁচ তারিখ। বইমেলার প্রথম শুক্রবার।

শীতের শেষ বিকালে মেলায় ভিড় বাড়ছে। হরেক রকমের বই। অনেক পাঠক। একেকজন লেখককে ঘিরে পাঠকরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছি তাদের কাছে যাবো কি না।

সে সময়টায় আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে খুবই পছন্দ করতাম। কেন যেনো মনে হতো আমি খুবই তুচ্ছ। চারপাশের এত আয়োজনের সাথে নিজেকে মেলালাম। খুবই বেমানান লাগছিল। রাস্তার ধারের আইল্যান্ডে বসে পড়লাম।

বসে বসে মানুষদের আসা-যাওয়া, বই কেনা দেখছি। এমন সময় একজন আমার পাশে এসে বসলো। হুমায়ূন আহমেদ বলে প্রথমে ভড়কে গেলাম। তারপর দেখি অনেকেই তাঁর কাছাকাছি এসে বসছে। অনেকের হাতেই বই, একটা অটোগ্রাফের আশায়।

তিনিও বেশ আনন্দের সঙ্গেই অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমি উঠে যেতে লাগলাম। উঠে দাঁড়ালাম'ও। দাড়িয়েই দেখি চোখের সামনে উন্মাদের স্টল। বুঝতে বাকী রইলো না।

তিনি কে? আহসান হাবীব। সালাম দিয়ে কথাবার্তা বললাম। তাঁর একটা বই কিনলাম। অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য এগিয়ে দিলাম বইটা। আমার একটা কার্টুন একে দিলেন।

চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। তারপর আর কোন কথা নাই, সোজা বাড়ি চলে এলাম। এরপর বাড়ি ফিরে এলাম। সারাদিন কোথায় ছিলাম জানতে চাইলে বলেছিলাম, একটা বন্ধুর বাসায় পড়তে গিয়েছিলাম। এসএসসি পরীক্ষা দিলাম।

এসএসসি পরীক্ষার অবসর সময়েই ভাবলাম, আচ্ছা এবার নাহয় একটু লেখালেখি নিয়ে ঘাটাঘাটি করা যাক। বাসায় তখন গল্পের বই খুবই কম। বছর দুয়েক আগেও বাসাভর্তি বই ছিলো। কিন্তু সব বই অযত্নে রাখার কারণে সবগুলোই হারিয়ে গিয়েছিলো, কিংবা উইপোকা খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলো। তাই সম্বল খুবই কম।

বাবাকে বই কিনে দিতে বললেও তিনি দিলেন মাত্র দুইটা বই। একটা জোছনা ও জননীর গল্প আর আরেকটা নিষিদ্ধ লোবান। জোছনা ও জননীর গল্প বইটি কিনবার আগেই সাতবার পড়ে ফেলেছিলাম। তবে আবারো সেটিকে সংগ্রহ করলাম। তখন পড়েছিলাম শুধুই পড়বার খাতিরে, আর এখন পড়তে হচ্ছে গবেষণার খাতিরে।

নিষিদ্ধ লোবান অবশ্য আগে পড়া হয়নি। বইগুলো পড়ি আর শিহরিত হই। আহ কত কষ্ট করে, কত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই না বাংলার নিরীহ মানুষেরা নয়টা মাস পার করেছিলো। চোখ ভিজে আসলো, দুইটা কারনে। প্রথম কারণ তখন দেশের জন্য আবেগ কাজ করছিলো আর দ্বিতীয়ত আমি কখনোই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প লিখতে পারবো না সেজন্য।

দমে গেলাম না। বাসা থেকে অনুমতি নিলাম ময়মনসিংহে যাবো। সেখানে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন, ও সেখানকার বয়স্ক লোকজনদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাহিনী শুনলাম। অনেকেই জামালপুর, ও জামালপুর পেড়িয়ে গ্রামগুলোর কথাই বেশি করে বললো। হয়তো বা যুদ্ধের সময় তারা গ্রামের দিকেই থাকতো, এখন ময়মনসিংহ শহরে থাকছে।

আমার দাদাবাড়ীও জামালপুরের ভেতরের একটি গ্রামেই। কাউকে না জানিয়ে সেই গ্রামেও গেলাম। সেখানে গিয়েও বয়স্ক লোকজনদের যারা যুদ্ধের সাক্ষী, তাদের কাছ থেকে তাদের মুখ থেক যুদ্ধের কাহিনী শুনলাম। যা কথাই শুনি টুকটুক করে ডায়েরীর মতন একটা খাতায় সবকিছু লিখে রাখি। বাসায় ফিরে এলাম।

আমার বাবার কাছেও বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের কাহিনী শুনতাম। যুদ্ধের সময় তিনি কি করেছিলেন, তার অন্যান্য চাচাতো ভাইরা যে মুক্তিযোদ্ধা সে কথাও জানলাম। আমার বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে(হাপানি রোগের কারনে) সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। তবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা, খাবার, নিরাপত্তা দিয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি নিজ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের খবর, শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আত্মীয়দের জানিয়ে দিতেন। কে বেঁচে আছে, কে মারা গেলো, কবে কে আসবে? কার গায়ে গুলি লেগেছে, কবে কোথায় অপারেশন হবে এসব তথ্য তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের জানিয়ে দিতেন।

সেসব কাহিনীও শুনলাম, আমার আমিনূর রহমান খান চাচার লেখা “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও রণাঙ্গনের স্মৃতি” নামক বইটিও তিনি আমাকে পড়তে বললেন। সেই বইটিও পড়লাম। এসএসসি পাশের পর ঢাকায় পড়তে এলাম আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, পরিবার ছাড়া থাকব। ভালোই লাগছিলো।

যেমনটা আমি চাই, ঠিক তেমনই একা নিঃসঙ্গ নিরিবিলি। ঢাকায় আসার পর যা কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম, সেগুলো নিয়েই প্রাথমিক লেখালেখির শুরু করলাম। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বইও পড়তে থাকলাম। একটা একটা করে গল্পের অনুচ্ছেদ লিখি আর মনে হয় আহ কি ভালো হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরেই মনে হয়, কিছুই হয়নি।

তারপর আবারো লিখি, আবারো কাটি, আবারো ছিড়ি। এই গল্পটির পাশাপাশি আমি আরো অন্যান্য বিষয় নিয়েও গল্প লিখতে শুরু করলাম এবং বিভিন্ন পত্রিকা-ম্যাগাজিনে ছাপানোর চেষ্টা করলাম। তারা আমাকে আশাহত করলেন। লেখার মাঝে হয়তো বা পরিপক্বতার অভাব ছিলো। তাই তারা সেগুলোকে বাতিল বলে ঘোষনা করলো।

তখন আবারো জেদ চেপে বসলো, কেন লেখা বাদ হবে? আমি আবারো লিখবো। আবারো লিখলাম, আবারো বাদ পড়লো। এদিকে একেকটি লেখা বাদ হয়, আমি একেকটা লেখা ফেসবুকে শেয়ার দিতে শুরু করলাম। ফেসবুকের বন্ধুরা আমার লেখা দেখল। তারা কি মনে করে পছন্দ করলো আমি জানি না।

কারণ আমার লেখাগুলো খুবই সস্তা টাইপের। যেগুলো পত্রিকা-ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা বুঝতেন। এদিকে ২০১১ সাল চলে এসেছে। আবারো বইমেলা। আহসান হাবীব স্যারের সাথে দেখা হবে এই আশা করে বইমেলায় গেলাম।

দেখা পেলামও। শুরু হল তাকে বিরক্ত করার পালা। মানুষকে অতি আগ্রহের সঙ্গে হাসিমুখে বিরক্ত করার অসাধারণ ধৈর্য্য মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে জন্মলগ্ন থেকেই দিয়েছেন। আমার বিরক্তির শিকার হলেন আহসান হাবীব স্যার। অসাধারণ ধৈর্য্য ক্ষমতার অধিকারী এ মানুষটা হাসিমুখে সব বিরক্তি মনের ভেতরে চেপে রাখলেন।

তাকে আমার লেখা বিভিন্ন গল্প, কবিতা দেখানো শুরু করলাম(যেগুলোকে আমি বাথরুমের এক নং পঁচা সাবান বলে আখ্যায়িত করি)। তিনি কি দেখে বললেন, হ্যা ভালোই তো লিখো। চালিয়ে যাও। ছোট্ট এই কয়টা শব্দ। তবুও এত্ত উৎসাহ পেলাম বলার মতন না।

আমার কাজের উদ্যম বেড়ে গেলো। সারাদিনে পড়াশোনা, আড্ডাবাজির ফাকে একটু সময় পেলেই লেখালেখি নিয়ে বসে পড়ি। আর এক একটা লেখা শেষ হলেই হাবীব স্যারকে দেখাই। তিনি বরাবরের মতই বলেন “ভালো। ” কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের কেবল মুখ দেখলেই ভেতর থেকে প্রেরণার জন্ম হয়।

আশাবাদী হতে সাহস দেয়। মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া সোজা কোন কথা না। কিন্তু এরা খুব সহজেই একেবারে মানুষের মনের ভেতরে জায়গা করে নিতে পারে। আহসান হাবীব স্যার তেমনই একজন। এরপর মাঝে মাঝেই তার অফিসে গিয়ে হানা দেই।

তিনিও আমার আগমণ বিপদের কারণ জেনেও না বলতে পারেন না। এদিকে যেহেতু আত্মবিশ্বাস কিছুটা বেড়েছে, আবারো পত্রিকা-ম্যাগাজিন অফিসে গেলাম লেখা ছাপানোর জন্য। হয়তো বা সেখানে কোন যন্ত্র আছে, যারা আমার নাম বা মুখ দেখার সাথে সাথেই অটোমেটিকভাবেই “না” বলে দেয়। ২০১২ সালের বইমেলার। হাবীব স্যারের কাছে আমার কিছু অখাদ্য পান্ডুলিপির খসড়া দেখানোর জন্য উন্মাদের স্টলের সামনের আইল্যান্ডে বসে আছি দুজন।

স্যার পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে বসে আছেন। মাঝে মাঝে দু এক পাতা ওল্টাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ফ্যানদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরপরই আমার সিগারেটের নেশা উঠে। স্যারের সামনে প্রথম দেখার দিনই তিনি তার সামনে সিগারেট খাওয়ার পারমিশন দিলেও আমি তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে সিগারেট কখনো খাইনি।

এরপরেও পরবর্তী সময়ে আমাকে কয়েকবার সিগারেট তাঁর প্যাকেট থেকে বের করে দিলেও আমি খাইনি। যেহেতু খাইনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থেকে, সেহেতু নিজের ইচ্ছায় কখনো এই কাজটি তাঁর সামনে করবো তার প্রশ্নই আসে না। বলে রাখা ভাল, স্যার এই কাজটা শুধু যে আমার সঙ্গেই করেছেন তা না, তিনি তাঁর অনুজদের তাঁর সামনে ফ্রি করার জন্য এই কাজটি করেন। আমার সঙ্গে বিশেষ কোন খাতির তাঁর সাথে এমনটি কেউ মনে করলে একান্তই নিজ দায়িত্বে মনে করবেন। আমি তাঁকে বললাম আমি একটু অন্য স্টল থেকে ঘুরে আসি।

তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বাংলা একাডেমি পেরিয়ে ব্যাচেলর ষ্টাফ কোয়ার্টারের পুরি, পিয়াজু, চপ খেয়ে এক কাপ চা আর প্রিয় ব্র্যান্ড মার্লব্রো সিগারেট হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। কোথা থেকে তিন চারটা পনেরো-ষোল বয়সী মেয়েরা এগিয়ে আসল। সাথে একজন বয়স্কা মহিলা। কারোর মা হবেন হয়তো।

খেয়াল করলাম তারা আস্তে আস্তে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। সবার মাঝে যে মেয়েটি ছিল সে একদম সামনে এসে বলল, "আপনি কি সার্জিল ভাইয়া?" আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এ হয়তো বা কোন ফেসবুক সেলিব্রেটি ফ্রেন্ড মনে হয়। অবাক হয়ে বললাম, "জ্বি। " মেয়েটি তার মা'র দিকে তাকিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, "মা ইনি সার্জিল খান।

" ততক্ষণে আমি হাতের মুঠো থেকে বাধন আলগা করে সিগারেট ফেলে দিয়েছি। মাত্রই ধরানো সিগারেটটা আমার জুতার তলায় পিষে একাকার হয়ে যাচ্ছে এই মনঃকষ্টে আমি ভদ্র-মহিলা ও সেই কিশোরীদের প্রতি যারপরনাই বিরক্ত হলাম। তবুও, আমি ভদ্র-মহিলার দিকে তাকিয়ে স্লামালিকুম না বলে আসসালামুয়ালাইকুম দিয়ে একটা লম্বা হাসি টেনে বললাম, কেমন আছেন? দুই জনের মধ্যে সৌজন্য কথোপকথন শেষ হতেই দেখি সেই মেয়েটি তাঁর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা কিছু অফসেট কাগজ এগিয়ে দিল। তখনও আমি সম্পাদনার কাজ করি না। লেখালেখি করলেও সেটা কেবল আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড আর আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কেউ জানতো না।

তাই সম্পাদকের জ্বালা কি সেটা তখনো অনুধাবন করে সারি নি। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম "কি এগুলো?" সে কিছু বলল না, আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে বলল, "খুলে পড়ুন। " কথার মাঝে অস্পষ্টতা রাখা মেয়েদের স্বভাব। তারপরেও কেন যেনো মেয়েদের এই অস্পষ্ট কথাগুলো শুনতে ছেলেদের বড় ভালো লাগে! আমি স্পাইরাল বাইন্ডিং করা খাতাটা খুললাম। খুলে দেখি আমার অখাদ্য স্ট্যাটাস সমূহকে এই মেয়ে কিভাবে যেন সংগ্রহ করে প্রিন্ট করে বাইন্ডিং করে নিয়ে এসেছে।

নিজের লেখা যেহেতু তাই জিনিসটা কতটুকু খারাপ, তা আর নতুন করে দেখার কিছু নাই। মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটির মুখে তখন খই ফুটতে শুরু করল। সে তাঁর পরিচয় আমার কাছে গোপন রাখল কিন্তু সে আমার স্ট্যাটাস নিয়মিত দেখে, আমি যে সবাইকে স্ট্যাটাসে জানান দিয়ে বইমেলায় যাই, এটা জেনে সে প্রথম দিনেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এবং এও বলল, সে আমাকে ফ্রেন্ড লিস্টেও রাখেনি। কারণ ফ্রেন্ডলিস্টে রাখলে আমি তাকে খুজে বের করব।

কিন্তু সে নাকি আমার বিরাট ফ্যান। আমি তো অবাক। আমি কি এমন সুপারম্যান, যে আমারও ফ্যান থাকবে? তাও আবার একটাও গল্প কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এখন এই মেয়েকে কি না আমাকে অটোগ্রাফ দিতে হবে। কি মুসিবত।

সেই ভদ্র মহিলার দিকে আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ভদ্র-মহিলা আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে করুণা করলেন না। নিরুপায় হয়ে কয়েকবার বুঝাতে চেষ্টা করলাম আপনারা হয়তো ভুল লোককে ধরেছেন। আমার মতন দেখতে কাউকে মনে হয় আপনারা খুজছেন। মিথ্যা কথায় কাজ হল না।

আমি অসহায় ভাবে আত্ম-সমপর্ণ করলাম। আমি লক্ষ করলাম আমার চোখের কোণা ঝাপসা হয়ে আসছে। মানব জীবনের কিছু পরাজয়ের স্মৃতি খুবই মধুর। এ পরাজয়ে প্রতিশোধ নিতে কখনো ইচ্ছে করে না, বরং বার বার পরাজিত হতেই ইচ্ছা করে। আজ প্রায় এক বছর হতে চলল এ ঘটনার।

জানি না সে এই স্ট্যাটাস দেখবে কি না? তবে শুধু এটুকু বলতে চাই, অখাদ্য সাহিত্য কিংবা বিকলাঙ্গ গল্প জন্ম যা'ই দেই না কেন, এইসব পাগলদের জন্যই মনে হয় কিছু লিখে যাই। মানুষের ভালবাসাকে উপেক্ষা করার মতন মানসিক শক্তি খুব কম মানুষেরই থাকে। এদিক দিয়ে আমি খুবই দুর্বল। কিছু বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতির মধ্যেও পড়েছিলাম। কোন এক লেখকের কাছ থেকে দুর্ব্যাবহার পাওয়ার পর আমি মনে করছিলাম আমি যদি কখনো লেখালেখি করি, তবে আমার পাঠকদের সাথে আমি কখনো দুর্ব্যবাহার করব না।

যতক্ষণই তাদের সাথে থাকব, ততক্ষণই রাখব মাতিয়ে রাখব। কিন্তু কিছু কিছু পাঠকরা এটিকে আমার দুর্বলতা মনে করেন। বিশেষ করে আমার পাঠিকারা। এই পর্যন্ত সাতজন পাঠিকাদেরকে পেলাম, যারা আমার প্রেমের সম্পর্ক জানার পরেও আমার সঙ্গে ভিন্ন রকম সম্পর্কে জড়াতে চায়। আর পাঠকদের ক্ষেত্রে তারা ঘাড়ে চড়ে বসে ফায়দা লুটতে শুরু করে।

এই পর্যন্ত কম করে হলেও বারো জনের মতো প্রকৃত সুযোগসন্ধানী পাঠকদের পেলাম, যারা আমার সঙ্গে কেবল খাতির জমিয়েই নিজেদের ফায়দা লুটতে প্ল্যান করলো, এবং স্বাভাবিক ভাবেই ব্যর্থ হল। আমি এমন কোন লেখক না যে আমার সঙ্গে তাদের প্রেমের স্বপ্ন কিংবা কাঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে; আমি কোন বিশ্বপ্রেমিক না কিংবা আমি কোন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর এমডি না যে আমার কাছে হাজার হাজার টাকার বিজনেস আছে। ফাকতল দিয়ে যারা আমার সত্যিকারের পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের আমি ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রাখার চিন্তা করি। যা বুঝতে পারছি, আমাকেও কঠিন হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমি বাঙালী, আমার পাঠক-পাঠিকারাও বাঙালী।

তাদের যদি থাকে ছলচাতুরী, আমার আছে আবেগ। আর আবেগ অবশ্যই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই আবেগ আমি ভুল জায়গায় ব্যয় করতে চাই না। তাই বলে থেমে থাকিনি কখনো। লিখেই চলেছি।

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্পটার কথা আমার স্মরণে থাকলেও কাগজেকলমে লিখতে বসিনি। এর মাঝে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ফুডপয়জনিং এর কারণ হাসপাতালে ভর্তি হলাম উত্তরা সেন্ট্রাল হাসপাতাল। ডাক্তাররা আমার অবস্থা বেগতিক দেখে “আইসিইউ” তে ভর্তি করে দিলেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার হার্টবিট যখন ত্রিশের ঘরের দিকে, তখনও আমার চেতন থাকলেও কথা বলতে পারছিলাম না। তবে আমার মন কথা বলছিলো।

মনে হচ্ছিলো, “ইশ! আমি কি তাহলে আমার এই আশাটা পূরণ করতে পারবো না। চোখ দিয়ে কান্না গড়িয়ে পড়লো। ” তার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হঠাৎই হার্টিবিট ফল করা শুরু করলো। সাতাইশ, উনিশ, তেরো, সাত। সাত আর ছয়ের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চলছে।

আমি তখনও অচেতন। যেভাবেই হোক, আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসলাম। মনের ভেতরে ধারণা জন্মে গেল। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। নাহলে জীবনের এই আশাটা কখনোই পুরণ হবে না।

লেখা শুরু করলাম, এবং ২০১২ এর মার্চের দিকে প্রথমবারের মতন সেই গল্পটা দাড় করালাম। দাড় করানোর পর দেখতে পেলাম এটা আর গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রীতিমত একটা উপন্যাস হয়ে গেল। আমি পুরো উপন্যাসটা বিভিন্ন প্রথম সারির লেখকদের দেখাতে আগ্রহী হলাম। আহসান হাবীব স্যারকেও দেখাতে দিয়েছিলাম।

তিনি দেখলেন, আরো কয়েকজনকে দেখালাম। একজন প্রথম সারির লেখক, নাম বলবো না, তিনি আমার উপন্যাসটা মাত্র পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তার কাছে বিক্রি করতে বলেছিলেন। একজন লেখক যে কখনো আরেকজনের লেখাকে নিজের বলে চালানোর চিন্তা ভাবনা করতে পারে, এই নির্মমতার সাথে পরিচিত হলাম। এরপর আমি নজর দিলাম আবারো আমার অন্যান্য গল্প লেখালেখির দিকে। ততদিনে আমি বুঝে উঠতে পেরেছি, কবিতা জিনিসটা খুবই কঠিন একটা জিনিস।

এর জন্য শুধু লিখে গেলেই হয় না। কোন একজন মনীষী বলেছেন, “একজন কবির ছন্দ শিখতেই লেগে যায় বিশ বছর। ” একজন কবির অলঙ্কার হল তার ছন্দ। সেখানে আমি নিজেকে কবি বলে দাবী করি কিভাবে? কিন্তু এই দাবীটা আমাদের বর্তমান সময়ের অধিকাংশ তরুণরাই করে। তারা নিজদের কবি বলে জাহির করতে চায়।

এমন কিছু কবির সঙ্গেও পরিচয় হল। এদের মাঝে একজন সুযোগসন্ধানী, কবি(!) ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচয় হল। যদিও এর কথার সাথে কাজের বিন্দুমাত্র মিল না থাকার কারণ অতীব আঁতেলীয় কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে এর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলি। যাক গে ওসব কথা। আমি বুঝে ফেললাম কবিতা আমাকে দিয়ে হবে না।

লেখালেখিতেই মনোযোগ বেশি দিলাম। আশ্চর্য্যের বিষয়, এবার কিছু ম্যাগাজিনে আমার লেখা বিনা জটিলতায় ছেপে দিলো। এবং কিছু টাকাও পেলাম। আমি টাকা নিতে অস্বীকার জানালাম। কারণ আমি টাকার বিনিময়ে লিখতে আসিনি, আমি এসেছি আমার যোগ্যতার বিচার করতে।

২০১২ সালের জুলাই মাস। বছরের এই সময়টায় বৃষ্টি বেশি পড়ে। ঘরে পড়ে আছি। শুধু শুধু যে পড়ে আছি তা না, জন্ডিসে আক্রান্ত প্রায় মাস দুয়েক হল। কাজের কাজ শুধু ঘুমানো, ঘড়ি ধরে পথ্য জাতীয় খাবার খাওয়া, শুয়ে শুয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বই পড়া আর মাঝে মাঝে শরীর একটু চনমনে লাগলে আমার রচিত প্রথম উপন্যাস “রঞ্জিত জননী” বইটি লেখা।

দুই মাস পরে যে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা, সে চিন্তা মাথাতে নেই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জটিল জটিল ইকুয়েশন চোখে দেখলেই টেনশনে বমি এসে যেতো। জুলাই মাসের এমনই একদিন। সন্ধ্যা থেকে খুব বৃষ্টি, রঞ্জিত জননীর সপ্তম অধ্যায় শেষ করে খাবার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি। খাওয়া শেষে ফেসবুকে একটু ঢু মারবো।

খাওয়া শেষে ঢু মারতে গিয়ে আমি স্তম্ভিত। যার গল্প,উপন্যাস পড়ে জীবনের কঠিন দুঃসময়গুলোতে একটু ভরসা পেতাম, বেঁচে থাকবার আনন্দ পেতাম, জীবনকে বুঝতে পারতাম, সেই মানুষটি আমাদের সবার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে কঠিন আঘাত দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে! খুব কাছের আপন-জন মারা গেলে আমি কাঁদি না। জীবনের কোন এক সময় বুঝতে পারলাম পুরুষদের কাঁদতে নেই। তাদের কান্না ভয়াবহ শোকের প্রতিচ্ছায়া। কিন্তু এরপরেও নিজের অজান্তেই কাঁদলাম খুব।

ভয়াবহ শোক তো বটেই। মাথার উপরের ছায়া সরে গেলো। আর কখনো তিনি আমাদের ছায়া দিবেন না। আজকালকার যুগে ফেসবুক-ব্লগের কল্যানে সবার সাথে নিজের মনের ভাব ভাগাভাগি করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি চলে গেলেন, একের-পর এক স্ট্যাটাস, পোস্ট দিতে লাগলাম।

লেখক ও যুগান্তর পত্রিকার ইশতিয়াক আহমেদ ভাই আমাকে বললেন, তাঁর পত্রিকায়, হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে “ফেসবুকে তারুণ্যের শোক” শিরোনামে একটা ফিচার ছাপানো হবে। আমাকে বললেন ফ্রেন্ডলিস্টের কয়েকজন বন্ধুদের সেরা স্ট্যাটাসগুলো নিয়ে তাঁকে যেনো পাঠাই। প্রায় এগারো জনের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে তাঁকে জমা দিলাম। সাতাইশ তারিখ শুক্রবারের উনিশ কুঁড়িতে সেটা ছাপা হল। এই স্ট্যাটাস কালেকশন করতে গিয়ে দেখলাম অনেকের লেখনী শক্তি অনেক সুন্দর, অনেক আকর্ষণীয়।

তো মনে মনে ভাবলাম এরকম একটা বই বের করলে কেমন হয়, যেখানে সব একদম নতুন লেখকরা তাদের লেখা জমা দিয়ে একটা বই বের করবে? মানুষকে অতি আগ্রহের সঙ্গে হাসিমুখে বিরক্ত করার অসাধারণ ধৈর্য্য মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে জন্মলগ্ন থেকেই দিয়েছেন। আমার বিরক্তির শিকার হলেন আহসান হাবীব স্যার। অসাধারণ ধৈর্য্য ক্ষমতার অধিকারী এ মানুষটা হাসিমুখে সব বিরক্তি মনের ভেতরে চেপে রাখলেন। তিনি তরুণদের অনুপ্রাণিত করেন প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে। এ খবর আমি জানতাম।

সে সুযোগ নিয়ে স্বার্থপরের মতন তাঁকে এই বই বের করার কথা জানালাম। অন্য সবার মতন আমাকেও তিনি ফিরিয়ে দিলেন না। উৎসাহ দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ কর। ভালো কিছু করো। আমি আছি।

” আমাকে কাজে পেয়ে বসলো। প্রথমে ফেসবুকের কয়েকজন বন্ধুদের এ বিষয়ে পুরোপুরি বললাম, যে তারা আগ্রহী কি না? জুনায়েদ ভাই, আলাউল ভাই, ইফতি ভাই তারা বললেন “হ্যাঁ ভাই আমরা রাজি। ” এরপর ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলে ফেললাম, সেখানে এই বিষয়ে পুরো কথা তুলে ধরলাম, “একটি গল্প সংকলন বইয়ে ১৬জন নতুন লেখকদের গল্প ছাপানো হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন!” প্রচুর সাড়া পেলাম। গ্রুপে সদস্য সংখ্যা চোখের পলকে বাড়তে লাগলো।

শুরুর দিকে অনেক ঝড়ঝঞ্চা বয়ে গিয়েছিলো। কেউ কেউ শুধু শুধু গ্রুপে এসে মেম্বার হয়ে পড়ে থাকে স্রেফ গল্প পড়ার আশায়, কেউ কেউ বললেন আবার “ভাই অমুক দিন গল্প দিবো” তারপর কে কি ধাঁচের লেখা জমা দিবে কে দিবে না এই নিয়ে দোটানা, কারোর লেখায় গ্রহনযোগ্যতার অভাব, কারোর পরীক্ষাজনিত সমস্যা, কেউ কেউ ব্যক্তিগত হতাশায়, কেউ প্রিয়জন হারানোর শোকে অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়ায়, কেউ আবার আত্মগর্বের কারণে মাথা নোয়াতে রাজী না হওয়ায়, কেউ আবার আলসেমির কারণে ভুগে গ্রুপ থেকে চলে যাওয়া ইত্যাদি হাবিজাবি সমস্যার মুখোমুখি হলাম। সিলেক্ট হওয়া গল্পের মাঝেও আবার আরেক ঝামেলা। “আমার গল্প সিলেক্ট হয়ে গিয়েছে, পায় কে আমায়?” এমন অবস্থায় কয়েকজনকে পেলাম। এরা একবার বলে আমাদের সঙ্গে আছে আরেকবার বলে নাই।

একজন একেবারে শেষ মুহুর্ত্যে চলে গেলো। আরেকজনের একেবারে শেষ মুহুর্ত্যে ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলাম; তাঁর গল্পে কোন প্রকার এডিটই করা যাবে না। নিজের গল্প নিজে এডিট করবে। বানান ভুল, ভাষাগত অসঙ্গতি, গল্পের প্রতি আকর্ষণের অভাব থাকলে এর জন্য আমি দায়ী নই। ফেসবুকের বিভিন্ন বন্ধুদেরকে বললাম আমার এই উদ্যোগের কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিতে, শত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও মহিউদ্দীন কাউসার ভাই, আলিম আল রাজি ভাই, আসিফ মেহদী ভাই, তানভীর আহমেদ, ভাই আল নাহিয়ান ভাই সহযোগিতা করলেন।

তাদের বন্ধুদের সবার কাছেই পৌছে দিলেন আমার এই উদ্যোগের কথা। মোট ৪৬টা লেখা জমা পেলাম মেইলে, ফেসবুক মেসেজে, ব্লগের কমেন্টে। এগুলোর মাঝে আবার অধিকাংশই প্রেমের গল্প। বাংলাদেশের প্রেমিক-প্রেমিকার হার যে কতখানি, তার ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান এই গল্পগুলো পড়ে পেলাম। এরই মাঝে কয়েকজনের গল্প পড়ে বিস্মিত হলাম।

এত সুন্দর গল্প মানুষ লিখে কি করে? গল্প তো না যেনো বাস্তব ঘটনা। কারোর কারোর গল্পে হাত দেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করিনি। সম্পাদক সেসব জায়গাতেই হাত দেয় যেখানে দুর্বলতা থাকে। সবল জায়গায় হাত দিয়ে সম্পাদকের কোন কৃতিত্ব নেই। বিভিন্ন ক্যাটাগরি থেকে বিভিন্ন গল্প সিলেক্ট করলাম।

জীবন ঘনিষ্ঠ কাহিনী, সাম্প্রতিক সময়ের সমস্যাকে কেন্দ্র করে কাহিনী, প্রেমের গল্প, রম্য, ভৌতিক, সায়েন্স ফিকশন রহস্য উদঘাটন সব স্বাদের গল্পই পেলাম। আমার একই সাথে খুব আনন্দ লাগছিলো আবার একই সাথে খুব খারাপ লাগছিলো। অসুস্থ শরীর, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার মাঝে একদিকে পরীক্ষার পড়া, আরেকদিকে বইয়ের কাজ করতে লাগলাম। শেষের দিকে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ভোররাত পর্যন্ত জেগে থেকে কাজ করে পরদিন সকালে পরীক্ষা দিতেও গিয়েছি। ৪৮টা গল্পের মাঝে ১৬টা গল্প বাছাই করলাম।

একেকটা গল্প সিলেক্ট করি, মনে হয় "এইত্তো! অনেক খানি কাজ এগিয়ে গেলো। অনেক আশাবাদী মনে হচ্ছে। " আবার একেকটা গল্প বাদ দেই, আর মনে হয়, "আমার কাছে আমার গল্পগুলো যেমন সন্তানসম, তেমনি প্রত্যেকের কাছেই তার গল্প সন্তানসম। তাদের সন্তানসম একেকটি গল্প বাদ দিচ্ছি। " নাড়ির বাঁধন ছেড়া সন্তানের মৃত্যু হলে বাবা-মায়ের যে কষ্ট লাগে, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট না লাগলেও মনের বাঁধন ছেড়া সন্তানসম সৃষ্টিকর্মের মৃত্যু ঘটলেও অনেক কষ্ট লাগে।

এই কষ্ট কেবল সে-ই বুঝে যার যায়। নাড়ির বাঁধন ছেড়া নষ্ট সন্তানকে শাষন করলেও বাবা-মায়ের মনের গহীনে তার জন্য ভালোবাসা থাকে। সন্তানসম একেকটি লেখার প্রতিও ঠিক তেমনই ভালোবাসা থাকে লেখকের মনে। তা সেই লেখা যেমনই হোক। হাসপাতালে রোগী মারা গেলে রোগীর আত্মীয়রা যেমন আবেগের বশীভূত হয়ে ডাক্তারের বংশবৃত্তান্ত বের করে ফেলেন, এমনকি অনেকে ডাক্তারের উপরে গায়েও হাত তুলে ফেলেন; সেরকম কিছু না হলেও আমিও এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আবেগী, অভিমানী লেখকদের থেকে।

বুঝাতে পারিনি, কতটুকু খারাপ লেগেছিলো; গল্প বাদ দিতে, তাদের অভিমানগুলো শুনতে। লেখকদের অভিমান বড় কঠিন অভিমান। এ জিনিসটা আমার অজানা নয়। নিজের জায়গা থেকে অনুধাবন করে আমি সব সময় ভালো-খারাপের মাঝামাঝি থাকতে পছন্দ করি। নিজে আবেগ প্রবণ হলেও কিভাবে কিভাবে যেনো প্রয়োজনের সময় আমার আবেগগুলো উবে যায়।

আবেগ এমনই, বাতাস পেলেই জ্বলে উঠে, আবার বাতাস পেলেই উড়ে যায়। যাক গে নিজের সম্পর্কে অনেক ব্যক্তিগত হাইপোথিটিক্যাল কথাবার্তা বলে বিরক্ত করছি। অভ্যাসগত সমস্যা, সহজে যায় না। এসব সমস্যাগুলোকে উৎরে ১৬জনের একটা পরিবার হল। অনেকেই নতুন, অনেকের লেখাই আগে কখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি, একসঙ্গে হরেক স্বাদের গল্প, সবকিছু মিলিয়ে একটা বিশেষ আকর্ষণ বোধ করলাম।

বইটাকে ঘিরে অনেক আশা’র জন্ম নিলো। আহসান হাবীব স্যারের কাছে গেলাম সবগুলো গল্প নিয়ে। তিনি সবগুলো গল্প থেকে কয়েকটি গল্প সিলেক্ট করে দিলেন। আমি সিলেক্ট করলাম কয়েকটি। বিভিন্ন ধাঁচের গল্প বিভিন্ন আঙ্গিকে লেখা।

যে কারোর পড়েই প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হবে। সময়ের শত ব্যস্ততার মাঝেও আহসান হাবীব স্যার প্রচ্ছদ একে দিয়ে, অলংকরন করে দিয়ে আমাদের বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার সুযোগ করে দিলেন। আমার দায়িত্ব শেষ হল। একঝাঁক নবীনদের সাথে আমিও মিশে গেলাম। আমিও নবীন, লেখক হিসেবেও, সম্পাদক হিসেবেও।

কঠিন একটা দায়িত্ব পালন করলাম। বইটিতে বৈচিত্রতা রাখার চেষ্টা করেছি। বৈচিত্রতা রাখার জন্যই বারবার গল্প সিলেক্ট করা শেষ হয়ে গেলেও আবারো সেগুলোকে বাতিল করে নতুন লেখকদের গল্প সিলেক্ট করতে হয়েছিলো। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি? তবে চেষ্টা করেছি ভালো কিছুই উপহার দিতে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করেছি প্রত্যেকেই।

এবার শুরু হল প্রকাশক খোজার পালা। চাকরী খুঁজতে গিয়ে মানুষের জুতার তলা ক্ষয়ে যায়। প্রকাশকদের কাছে লেখা ছাপানোর জন্য অফিসে অফিসে ঘুরতে ঘুরতে আমার গায়ের রংবেরঙের নতুন শার্টের রঙ জ্বলে গেলো। কিছু প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় প্রকাশকের সাথে কথা বললাম। তারা পান্ডুলিপি না দেখেই বই ছাপাতে এমন কিছু অঙ্ক বললো, যা শুনে যে কেউই জীবনেও বই ছাপাতে আগ্রহী হবে না।

আরো প্রকাশকের সাথে কথা বললাম, তারা যে অঙ্ক বললো, তা আগেরজনের চেয়েও উচু মানের রসিকতা হয়ে গেল। আমি হতাশ হয়ে গেলাম। এদিকে ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। আমি যে ল্যাপটপে আমার সব লেখা সংগ্রহ করি, সেই ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক জ্বলে গেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

আমার সব লেখাই এক ধাক্কায় হারিয়ে গেল। চোখের জলকে সেদিন আটকে রাখতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। প্রত্যেক মা'ই সন্তানের জননী। নিজের লেখা গল্প প্রতিটি লেখকের কাছে সন্তানসম। নাড়ির বাঁধন ছেড়া সন্তানের মৃত্যু হলে বাবা-মায়ের যে কষ্ট লাগে, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট না লাগলেও মনের বাঁধন ছেড়া সন্তানসম সৃষ্টিকর্মের মৃত্যু ঘটলেও অনেক কষ্ট লাগে।

এই কষ্ট কেবল সে-ই বুঝে যার যায়। নাড়ির বাঁধন ছেড়া নষ্ট সন্তানকে শাষন করলেও বাবা-মায়ের মনের গহীনে তার জন্য ভালোবাসা থাকে। সন্তানসম একেকটি লেখার প্রতিও ঠিক তেমনই ভালোবাসা থাকে লেখকের মনে। তা সেই লেখা যেমনই হোক। আমি আবারো কাজে নেমে পড়লাম।

এবার আরো জোরেশোরে। কারন ইচ্ছা এই উপন্যাসটিকে এবার সবার হাতে পৌছে দিতেই হবে। নতুন উদ্যমে পুরনো কাজ করলাম। পাশাপাশি অন্যান্য গল্প উপন্যাসও লেখা শুরু করলাম। ফেসবুকের পাশাপাশি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হতে থাকলো।

টুকটুক করে এগিয়ে পুরো উপন্যাসটি শেষ করলাম। আহসান হাবীব স্যারকে আবারো বিরক্ত করা শুরু করলাম। তিনি বিরক্ত হলেও হাসিমুখেই আমার লেখার প্রতি বিভিন্ন মন্তব্য করতে শুরু করলেন। আমি উৎসাহ পেলাম। উপন্যাসটির নাম দিলাম “রঞ্জিত জননী।

” মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মদের কাছে পুরোই কঠিন একটি বিষয়। কি রকম ভয়াবহতার মাঝে, আবেগের মাঝে, প্রতিশোধের মাঝে এদেশের সাত কোটি মানুষ নয়টি মাস পার করেছিলো, সে ধারণা আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মরা কল্পনাও করতে পারবো না। অনেকটা যে অন্ধ লোক জন্মের পর কখনোই হাতি দেখেনি সে হাতির গঠন কেমন তা বুঝবে কি করে? তবে এরপরেও দুঃসাহস দেখিয়ে উপন্যাসটি লিখেছি। কারণ এই গভীরতাটি ফুটিয়ে তোলা যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানদের মাঝে আজকেও যেমন কঠিন, যখন বয়স বাড়বে তখনও ঠিক একই রকমের কঠিনই থাকবে। আর এই দুঃসাহস দেখিয়েছি শুধুই আবেগ থেকে।

যদি কিছুটা আবেগকে ভাগাভাগি করা যায় প্রজন্মের আমার সমসাময়িক বয়সের মানুষদের সাথে। শুধুমাত্র এজন্যই এই দুঃসাহস। তবে এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই পড়তে হয়েছে। আহসান হাবীব স্যারের ৭১’র রোজনামচা বইয়ের কিছু গল্পকে কেন্দ্র করে এবং বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী ও যোদ্ধাদের মুখ থেকে শোনা বিভিন্ন কাহিনীর সংমিশ্রণে লেখাটি লিখে শেষ করলাম। এটি কেবলই যুদ্ধ ভিত্তিক একটি উপন্যাস।

কোন ইতিহাসের দলিল নয়। জানি না পাঠকদের কাছে বইটি কেমন লাগবে? তবে লেখাটি লিখে কখনো বা কেদেছি, কখনো বা উত্তেজনায় পুরো শরীর শিহরিত হয়ে গেছে, কখনো বা সেইসব মানুষদের জন্য বুকের ভেতরে মোচড়ে উঠেছে। শুরু থেকে যে প্লাটফর্ম ধরে এগুচ্ছিলাম, সেই প্লাটফর্ম আর শেষ করতে পারিনি। লেখালেখির এই এক দোষ, গদবাধা কোন কিছু দিয়ে লেখা যায় না। উপন্যাসটা কোন ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস নয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়কার ঘটনাগুলো প্রথমে সংগ্রহ করেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক সকল রকমের বিষয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.