------ উৎসর্গ---
“যার বোধ শক্তি ছিল বলিষ্টতর
বিশেষ করে কৌতুক রঞ্জিত
যে বোধশক্তিকে দীর্ঘদিন ধরে
নিদারুন দুর্ভাগ্য কঠোর আঘাত হেনেছে, যুক্তির মাহাত্ম্য -
সেই আমার পরম প্রিয় মরহুম -
দাদা কে-
লেখাটি দাদাকে নিয়েই লেখা ।
রচনাকাল:
২৩শে এপ্রিল ’ ২০০১ইং
বেলা ৩.৫০মিঃ
১০ বৈশাখ ১৪০৮ বাংলা, সোমবার
২৩০/সি, শাহপরান হল, শাবিপ্রবি, সিলেট
বুকের ভেতরটা বার বার হাহাকরে করে উঠছে। জীবনে কখনো এমন শূন্যতা অনুভব করিনি কোনদিন। কঠিন বাস্তবতা নাটকের মতো দেখা দিল আমার আমাদের জীবনে।
৭ এপ্রিল ২০০১;
দাদা চলে গেলেন চিরতরে।
আমি সম্ভবত দাদাকে একটু বেশি ভালবাসতাম। তবে প্রকাশ করতাম না – আমার ভালবাসাটুকু কেউ বুঝেনি। আমার বাবা প্রচন্ড ভাল বাসতো দাদাকে। এই অকৃত্রিম আবেগপ্রবণ নিখাদ ভালবাসা আমি দেখিনি । তাই বাবা সারাক্ষন কাঁদেন কবরের পাশে।
ইউনিভার্সিটি ছুটি হলেই ছুটে যেতাম গ্রামের বাড়িতে। ভাই বোন, বাবা মা - দাদার টানে। সেই দাদু আজ নেই। তার ঘরটি খালি পড়ে আছে। স্মৃতি হাতড়িয়ে আমার বাবা ভেতরে ভেতরে নিরবে নিভৃতে কাঁদেন।
দাদার পুরনো “পুঁথি” গুলো হাতে নিয়ে কান্না পেয়েছিল। কি সুকরুন মিষ্ট সেই পুঁথির সুর। কমলা রানী গাজী কালু, চাপাবতী, জুলহাস সুজন, রহিম বাদশা, কত কিছুর বিচিত্র কাহিনী শুনাতেন দাদা।
আজ স্বস্তি পাচ্ছিনা যেন কিছুতেই - দাদার কথা মনে পরছে বার বার।
এতো করে কেউ কি কেঁদেছে, আমি কাউকে দেখেনি।
দাদা সব সময় জিকির করতেন, রাত জেগে তাহাজ্জুদ, সকালে ফজরের নামাজের ইকামতে আমার ঘুম ভাংতো। আমাকে ডাকতে- “ভাই ওঠ্ -নামাজ পড়। ” ইউসুফ - জুলেখা, জংগনামা, আর নাগরী পড়েতন দাদা। শ্লোক, ধাধা, গজল, গান সারাক্ষন গাইতেন। সব সময়ই কাজ করতে পছন্দ করতেন।
দাদার বড় চাচা যখন একটা মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে জেলে। তাকে ছাড়িয়ে আনতে দাদা গিয়েছিলেন – ভারতে। সেটা ১৯৩০ সালের দিকে। লঞ্চ, ট্রেনে ছড়ার- দাদার সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী - প্রথম উড়োজাহাজ দেখা।
আমার বাবা যখন পাকিস্থান আমলে “উন্ময়ন দশক” রচনা লিখে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান, আব্বা, দাদা, কাকা গিয়ে ছিলেন রাষ্ট্রীয় আমত্রনে।
মাওলানা ভাসানী তখন মারা যান। তার জানাযায় কথা দাদা বয়ান করতেন।
দাদা দড়ি, বাঁশ বেতের কাজ করতে পারতেন খুব ভাল ভাবে। তার তৈরি জিনিষ সবাই পছন্দ করতো।
জীবনে নামাজ ছাড়েনি কখনো।
সাত বছর বয়সে তার নানা নামাজ শিখানোর পড় আর নামাজ ভুলেনি । মৃত্যু সন্ধিক্ষণে এসে সারাক্ষন কান্নাকাটি করতেন। তবে খুব কষ্ট করে নামাজ পড়তেন। একটা গানের সুর মনে পরে--
“জেলা যশোহর
হইল গুরুতর-
কুকুর বাদী মামলা ইল
শুন সেই ঘটনা। ”
এরকম একটি পুথির ভাষার একটা কাহিনী শুনেছিলাম দাদার মুখে।
আজ তার প্রয়ানে শুধু স্মৃতিই ভেসে উঠছে বার বার। তার গান কানে বাজছে ভুলতে পারছিনা ক্ষনিকের জন্যেও ।
“শোন শোন মিয়াগণ,
রমজানে কতজন
রোজা ভাঙ্গিয়া তারা করিল ভোজন
কেউ নদী বা পুকুরেতে
ডুব দিয়া ভালামতে
পানি খাইয়া হইল কিছু নিবারন”
তাছাড়া সকাল বেলায় তার এই গান --আমার প্রাণে মর্ম স্পশ মনে হতো - সেই চির চেনা সুর - আমি কি করে ভুলে যাই-
“জাগরে ভাই নগরবাসী
রহমত চইল্যা যায়,
ডাকছে কোকিল, ডাকছে পাখি
ডাকছে কালা ভোমরায়,
মস্জিদের মিনারার উপর
ভোরের আযান শোনা যায়”
কেনরে ভাই আব্দুল আজিজ
আছ তুমি বইয়া .
সময় থাকতে যোগ দিলানা
নিশি পুরের মাদ্রাছায়। ”
আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চেতনায় দাদা সব সময় ছিলেন একনিষ্ট । জীবনে কারো প্রতি অবিচার করেননি, কারো ক্ষতি করেননি ।
তার সাথে যারা সমকক্ষরা ছিল দাদা জীবিত থাকতেই দাদার অনেক ক্ষতি করতে চেষ্টা করেছে। দাদা বলতেন -"সত্যের বিনাশ নাই। "
তার গান শুনি - প্রকৃতির ইথারে। সারাক্ষণ বাজছে আমার কানে-
বিছমিল্লার ফল পাইবারে একদিন
ও সোনার মুমিন।
বিছমিল্লার ফল পাইবারে একদিন।
ধর্মীয় ভাব ধারায় গান গাইতেন আর কাদতেন সারাক্ষন। বলতেন -
“কবরে কিভাবে একা থাকব”। একদিন সফর মুল্লুকের পুঁথি শুনাত শুনাতে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম -
“এমন তুফানের জোড়
কান্দাকাটি বড় সুর,
মাতন জারি জাহাজের উপর,
ধরিয়ায় মউত হইল
বেটাবেটি না দেখিল
না হইল মামু চাচার দেখা।
জানের পিয়ারা বিবি
না দেখিলাম তাহার ছবি
ঐ ছিল গো নছিবেরর লেখা।
সফর মুল্লুক কয়গো আল্লাহ
আমি জানিনা
কি গুনাহ কইরাছি খোদা
বুঝাতে পারলাম না।
ধরিযায় তুফানে আল্লা তোমারে ডাকি
না জানি সাঁতার।
খোদা তা’লা কয় জিব্রাঈল
তুমি কার পানে চাও
সফর মুল্লুক ধইয়ায় মরল
জলদি গিয়া কাঁচাও। ”
আরেক ভাবধারায় গান-
“ মেঘ নাই দেশে আইল ফোঁটা
ফকিরি কি গাছের গোটা। ”
নাত শুনলাম দাদার কাছে -
“আমার দ্বীনের নাবী মোস্তফায়
রাস্তা দিযা হাইট্যা যায়
হরিণ একখান বইস্যা ছিল
গাছেরি তলায় গো -”
জঙ্গ নামা পুথি পড়তেন । “আছরাত ছালাত ” কিতাব ছিল-
“ পয়লা আল্লার নাম লইয়া ...রসুলের নামে দরুদ বেজিয়া..”
গাজী কালুর পুঁথি শুনতাম-
“গাজী বলে কালু ভাই-
শান্ত কর মন
এত এত দাস মোরা
ভয়ের কি কারণ।
ছোট বেলায় দাদার বিছনায় শুয়ে শুয়ে ভাই বোন সবাই মিলে শুনতাম- “আলম সাধুর কিচ্ছা ”
সত্যের বক, ছয় মাসের বানিজ্য, সিকাদ্দার বাদশা, এগুলো মনে পড়ে-
“আলম সাধু কান্দেরে
বৃরখের পাতা ঝরেরে
হায় সুন্দরী হায় সুন্দরী রে
সুন্দরীরে যেইনা দেইখ্যা
ফইকড়া জামাই সাজেরে-
হায় সুন্দরী, হায় সুন্দরী রে !"
তাবলীগ জামাত, আযানে তাদের এই গান শুনিয়ে সবার সাথে বুক মিলাতেন
কারণ যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে তাবলীগে-
“ বেহেশ্তে যদি পাইতে চাও -নবীর ওছিলাতে,
জানে মালে চল ভাই তাবলীগ জমমাতে। ”
ছোট বেলায় একটা কিচ্ছা শুনা ছিল আমার -কয়েকটা লাইন-
“কি দেখলাম কি আইল
টেংগের তলে সর বইল
যাইতাম লইছলাম ইসলামপুর
বৌদ্দ পাত্ত তার এক লেংড়াঃ। ”
প্রথম জীবনে দাদা বাবা মা হারনোর পর কেটেছে চাচাদের সাথে , চাচাদের গল্প করতেন তিনি।
দাদার দুই চাচা ছিল একজন “বড় মিয়া” অন্যজন “ছোট মিয়া ”। দু’জন দেখতে একই গড়ন চেহারা ছিল।
তারা এক জায়গায় (পাঠের ব্যবসা করতেন) বিশাল কাঠাল খেয়ে ফেলেছিলেন বাজি ধরে । আসলে দু’জনে পর্যায় ক্রমে খেয়ে ছিলেন। লোকেরা মনে করেছে একাই খেয়েছে, তাদের চেহারায় এক থাকাতে পোষাক বদল করেছিল।
আমার দাদা। জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সালে বাংলা ১৩১৭ সালে।
তিনি তার সময়ের বন্যা, ঝড়, খরা, দুর্ভিয়ের কথা বলতেন। তিনি দেখেছেন ব্রিটিশদের রক্ত চক্ষু , পাকিস্থানী স্বৈর শাসন, ৭১ এর স্বাধীনতা, কালের এক জীবন্ত কিংবদন্তী সাক্ষীকে আমি হারালাম। তাকে ভুলতে পারছিনা।
স্মৃতি হাতবাড়িয়ে মনে পড়ে - আমি তখন খুব ছোট আমার ছোট ভাই (আল হাসান ফারুক) ছোট। সেই দাদুর গাড়ে ধরে লাফালাফি করতো।
দাদু তখন মারা যান তেমন কিছুই বুঝে উঠিনি।
কিন্তু দাদাকে আমি পেয়েছি অনেকদিন জন্মের পর থেকে আমার ভার্সিটি জীবনের অর্ধেক পর্যন্ত্ তার সান্নিধ্য পেয়েছি অনেক। তিনি রাগী ছিলেন -তবে বদরাগী ছিলেন না । আবার রাগ নিমিষেই থেমে যেত এবং কাছে টেনে নিতেন। পাড়ার মানুষকে প্রচন্ড ভালবাসতেন।
দাদা তার যুবক বয়সে - প্রথম বছর বিয়ে করার পর নব্বই মন পাট পেয়েছিলেন আর প্রচুর ধান পেয়েছিলেন একই বছর। এ বছরই তিনি প্রচুর টাকা পান ফসল বিক্রি করে এবং জমি কেনেন এ বছর অনেক।
দাদার একজন কাছের লোক ছিল খুবই সে খুবই গরীব ছিলেন কিন্তু ছিলেন খুব পরিশ্রমী, তিনি আমাদের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ করতেন। তার প্রতি সত্তুস্ট হয়ে দাদা বলেছিলেন - “ আব্দুল আজিজ - ত্ই একদিন সুখী হবি” আজ ঠিকই আজিজ চাচা সুখী। দাদার কাছে তিনি নতজানু হতেন।
তার নীতি কথা শুনতেন। হাদীস, কুরানের কথা শুনতেন, চোখে নীরবে বয়ে যেত পানির বন্যা।
৭ ই এপ্রিল ২০০০ তিনি চিরদিনের জন্য আমাদের পরিবারের সবাইকে রেখে পরপারে চলে গেলেন। শনিবার বিকাল ৪.১০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্য়ন্ত তিনি নামাজ ও যিকির ভুলেননি।
১৯৭৪ সালে যখন দূর্ভিক্ষ সারাদেশে। আমাদের পরিবারে খাবারের অভাব ছিলনা। গ্রামে হাহাকার। দাদা যথাসম্ভব প্রতিবেশীদের সাহায্য করছেন্ তিন বেলা খাননি। “ আমার প্রতিবেশী ভাইরা না খেয়ে থাকবে -আমি তিন বেলা খাব কেন ? ” তিনি দুপুরে ভাত খেতেন না।
দাদা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। খুব কর্মঠ মানুষ ছিলেন। গৃহস্থালী কাজ তিনি নিজে করতেন। কাজের লোকদের সাথে আন্তরিক ছিলেন। বর্ষাকালে চুরের উৎপাতে রাত ১/২ টা পর্যন্ত পচা পাটের আশ নিয়েছেল পুকুর পাড়ে বসে।
চোরেরা তাকে সজাগ ও কর্মব্যাস্ত দেখে তামাক খেয়ে গল্প করে চলে গেছে। ৪০টি আটি নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে শুতে গেছেন। আবার ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে আবার কর্মব্যস্ততা
শুরু।
দাদুর কথা আমার তেমন মনে নেই। কারণ তাকে হারিয়েছি ছোট বেলায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।