আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতির নামে প্রতারণা ।। পর্ব-এক

চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর যাবত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতি বা এম এল এম পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এক ধরনের হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ সকল তথাকথিত প্রতিষ্ঠান তাদের এ প্রতারণার পদ্ধতিকে সমাজসেবা বলে আখ্যায়িত করে। মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা ঢুকিয়ে, লোভ দেখিয়ে, জালের মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের হুজুগের কার্যক্রম। স্বভাবতই প্রশাসনের নাকের ডগাতেই। মজার ব্যপার যে, এ প্রতারণার কথা প্রথম প্রথম কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশ হয়েছিল।

এর বিপরীতে এ সকল প্রতিষ্ঠান সংবাদের প্রতিবাদ করে, তারা নিজেদের আইনানুগ বৈধতার কথা জানায়। ফলে এটাও প্রতিয়মান হয় যে, তাদের সাথে প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। শুধু তাই নয় এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সম্মেলন অথবা ওরিয়েন্টেসন প্রোগ্রামে সাবেক এবং বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আনাগোনাও একই অর্থ প্রমাণ করে। কেউ কেউ পাকিস্তান আমলের 'বিউটি বক্স'-এর কথা স্মরণ করেন; তবে সম্ভবত বাংলাদেশে গত ১৯৯১ সালের দিকে 'বিনা পুঁজি' নামে এর যাত্রা; এর পর 'যুব উন্নয়ণ প্রকল্প', 'মহিলা যুব উন্নয়ণ' ইত্যাদি নামে কিছু কূপন বিক্রির মাধ্যমে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ পদ্ধতি বিলুপ্তির পর বেশ কিছু পরিবর্তন এনে এসব প্রতারক চক্র নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলো জিজিয়ান, টংচেং, সি এস ডি ইত্যাদি নামে।

তারই ধারাবাহিকতায় 'ডেসটিনি-২০০০' এই বৃত্তেরই একটি অংশ। এ প্রতারণার সর্বশেষ ও আধুনিক সংযোজন হলো 'ইউনিপে টু ইউ' এবং 'স্পিক এশিয়া'সহ নতুন কিছু নাম। হুজুগে বাঙালির সার্থক আয়োজনই যেন এ পদ্ধতি। এইসব প্রতারক চক্র যে জাল ছড়াচ্ছে তা আপাত চোখে কোন ফাঁকি ধরা পড়েনা। আর এই সুযোগে এই তথাকথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত স্বল্প সময়ে অসাধু পথে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে।

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কি? প্রথমে শুরু হয়েছিল এভাবে যে, এই সব প্রতিষ্ঠান তার একটি অতি সাধারণ মানের পণ্য বাজার দর থেকে অত্যাধিক লাভে এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে অথবা বলা যায় সদস্য হবার জন্য কিনতে বাধ্য করায়। এ ক্ষেত্রে তারা এমন পণ্যও আমদানী করে যা চলতি বাজারে নেই। ঐ ক্রেতাকে লোভনীয় এই শর্ত দেয় যে, এম এল এম পদ্ধতির অর্ন্তভূক্ত সদস্য হলে এক সপ্তাহে ১২০০০/=(বারো হাজার টাকা) টাকার বেশি কমিশন বাবদ আয় করতে থাকবে। এর জন্য এটুকু কাজ করতে হবে যে, এই নেটওয়ার্কে তাকে আর দুজন সদস্য বাড়াতে হবে ( কোন কোন প্রতিষ্ঠানে তিনজন) বা অর্ন্তভূক্ত করাতে হবে। ফলে এ নেটওয়ার্কে সদস্য এই ভাবে ২ জন থেকে ৪,৮,১৬ এভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে।

ধরুন যখন একজনের মাধ্যমে তৃতীয় ধাপ বা ৮ম সদস্য হবে ( ঐসব ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন হতে পারে) তখন থেকে প্রথম সদস্য বা লোভী ক্রেতা পণ্য বিক্রি বাবদ একটা কমিশন পেতে থাকবেন এবং এই পদ্ধতির সপ্তম ধাপে এসে ক্রয়কৃত ঐ পণ্যটির মূল্য ফেরত পাবেন। তারপরও এভাবে যতদিন এ পদ্ধতিতে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিপাবে এবং পণ্য বিক্রি হতে থাকবে ঠিক ততোদিন এই সদস্য বা ক্রেতা কমিশন পেতেই থাকবেন। যা তাকে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত করবে। কারণ হিসেবে দেখা যায়, যেহেতু কেবলমাত্র কোন সদস্যের মাধ্যমেই এই পণ্য ক্রয় ও নতুন সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে তাই এ জাল যতো ছড়িয়ে যাবে এই কমিশনের পরিমাণ ততোই বাড়বে। আপাত দৃষ্টিতে এর মধ্যে কোন জালিয়াতি ধরা পড়ছে না।

কারণ ঐ সকল প্রতিষ্ঠান একটা পণ্য বিক্রি করছে এবং একটা পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রেতাকে কমিশন দিচ্ছে, যা ঐ ক্রেতাকে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত করবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান তার কথা রেখেছে, পণ্য বিক্রিও করছে এবং বেকার যুব সাধারণ সহ সবাইকে একটা কমিশন দিয়ে কর্ম সংস্থানের সুযোগও দিচ্ছে। কিন্তু এই পদ্ধতিকে যদি আমরা একটু খোলাসা করে যাচাই করি এবং এর পরিণতি সম্পর্কে জানি তবে এই জালিয়াতি ধরা পড়বে। জালিয়াতিটা কি? একটি সাধারণ উদাহরণের মাধ্যমে জালিয়াতিটা বোঝানো যেতে পারে। ধরুন যে একজন ব্যক্তি ঐসব প্রতিষ্ঠানের যে কোন একটির সদস্য হলো পরবর্তীতে ২,৪,৮,১৬,৩২ এই ভাবে জ্যামিতিক হারে সদস্য বাড়তে থাকলো।

তার পরিচিতি মহল ভেঙ্গে বেড়িয়ে এসে সারা শহরে কিংবা জেলায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। খুব দ্রুত এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হলো যে, নতুন সদস্য পাওয়াটা ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ প্রতি ১০০ জন সদস্যকে খুঁজে নিতে হচ্ছে আরও ২০০ জনকে তারপর ২০০ জন ৪০০ জনকে। জেলা শহরে সদস্যের বন্যা বয়ে চলেছে, আর নতুন সদস্য হতে ইচ্ছুক এমন লোক পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা নিচের পিড়ামিড আকৃতির সদস্য সংখ্যার ছকটা দেখলেই বুঝতে পারবো যে কত দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে- ক্রম পর্যায় >> নেটভূক্ত সদস্য + পূর্ব-সদস্যে = মোট সদস্য ১. >> ০১ + --- = ০১ ২. >> ০২ + ০১ = ০৩ ৩. >> ০৪ + ০৩ =০৭ ৪. >> ০৮ + ০৭ = ১৫ ৫. >> ১৬+ ১৫ = ৩১ ৬. >> ৩২+ ৩১ = ৬৩ ৭.>> ৬৪+ ৬৩ = ১২৭ ৮. >> ১২৮+ ১২৭ = ২৫৫ ৯. >> ২৫৬+ ২৫৫ =৫১১ ১০. >> ৫১২+ ৫১১ = ১০২৭ ১১. >> ১০২৪+ ১০২৭ =২০৮৭ ১২. >> ২০৪৮ +২০৮৭ = ৪০৯৫ ১৩. >> ৪০৯৬ +৪০৯৫ = ৮১৯১ ১৪. >> ৮১৯২ +৮১৯১ = ১৬৩৮৩ ১৫. >> ১৬৩৮৪ +১৬৩৮৩ = ৩২৭৬৭ ১৬. >> ৩২৭৬৮ +৩২৭৬৭ = ৬৫৫৩৫ ১৭. >>৬৫৫৩৬ +৬৫৫৩৫ = ১৩১০৭১ ১৮. >> ১৩১০৭২ +১৩১০৭১ = ২৬২১৪৩ ১৯. >> ২৬২১৪৪ +২৬২১৪৩ = ৫২৪২৮৭ উপরের ছক থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, একটি শহরের লোকসংখ্যা যদি ২,৫০,০০০ (আড়াই লক্ষ) জন হয় তাহলে মাত্র ১৮ তম স্তর বা ধাপ পর্যন্ত যেয়ে এই পদ্ধতি থেমে যাবে অর্থাৎ ১৮তম স্তরে সদস্য সংখ্যা হবে মোট ২৬২১৪৩ জন; এবং এর পরের স্তরের জন্য ৫২৪২৮ জন সদস্য লাগবে যা ঐ শহরে বা জেলায় নেই।

এ ব্যপারটি যদি আরও জনবহুল শহর বা জেলায় হয়, ধরি তা ২০,০০০০০ জনসংখ্যার শহর, তাহলেও তা আর মাত্র দুই স্তরে শেষ হবেই। দেখুন- ২০. >> ৫২৪২৮৮ + ৫২৪২৮৭ = ১০৪৮৫৭২ ২১. >> ১০৪৮৫৭৩ + ১০৪৮৫৭২ = ২০৯৭১৪৫ জালিয়াতির জাল কত দ্রুত বাড়ছে এবার তা বোঝা সহজ হয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক তৃতীয় ধাপ থেকে প্রথম ক্রেতা বা সদস্য কমিশন পেতে থাকলো এবং অষ্টম ধাপে তার ক্রয়কৃত পণ্যটির মূল্য সম্পূর্ণ ফেরত পেল। তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, প্রথম সদস্য যখন তার টাকা ফেরত পেয়ে লাভবান হতে শুরু করলো, তখন অর্থাৎ অষ্টম ধাপে সর্বমোট ২৫৫ জন এই জালে ধরা পড়লো। এই হিসেবে আড়াই হতে তিন লক্ষ জনসংখ্যার কোন শহরে যখন ২৬২১৪৪ জন লোক সদস্য হবে তখন লাভবান হবে মাত্র ৪০৯৬ জন সদস্য।

আর বাকী সদস্যদের খুঁজে বের করতে হবে ৫২৪২৮৮ জন আগ্রহী সদস্যকে, ঐ শহরে যা অসম্ভব। এখানেই খেলাটির সমাপ্তি ঘটবে। এসব প্রতিষ্ঠান এভাবে অধিক মূল্যে খুব অল্প সময়ে পণ্য বিক্রি করে এবং দেশের অধিকাংশ দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে মিথ্যে প্রলোভনে অপ্রয়োজনীয় পণ্য গছিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। এটা এক ধরনের বড় প্রতারণা। ইউনি পে টু ইউ : মোটা দাগের কারবার মাত্র বছর খানেক হতে মোটা দাগের প্রতারণা শুরু হয় বিভিন্ন নামে।

এ ক্ষেত্রে পূর্বের কৌশলে সামান্য কিছু পরিবর্তন এবং অতি মুনাফা দেখিয়ে অর্থাৎ দ্বিগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে এ ব্যবসার অবতারণা হয়। এক্ষেত্রে হুজুগকেই সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ দ্বিগুণ লাভের আশায় মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করা। ঠিক একই ভাবে অনেকের নিকট থেকে টাকা নিয়ে কিছু ব্যক্তিকে অর্থ দিচ্ছে এবং বাকী অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্রের হোতারা। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ সব প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসা জমজমাট আকার ধারণ করেছে, জনসাধারণও না বুঝেই অধিক লাভের আশায় এদের ফাঁদে ধরা দিচ্ছে।

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসার নামে সমাজের বৃহৎ জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করে থাকে। তাই প্রশ্ন উঠে যে, এগুলো বৈধতা পায় কি করে? অবশ্য এই জালিয়াতি শুধু যে বাংলাদেশে হচ্ছে তা নয় সারা পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। রয়েছে সংঘবদ্ধ কতোগুলো আন্তর্জাতিক চক্র। এরা গড়ে তুলেছে ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েভ সাইট। বাংলাদেশে প্রথম এই জালিয়াতি ডেভলপ করে হংকং ও সিঙ্গাপুর ভিত্তিক চায়নিজ প্রতারক চক্র।

এরই ফলে বর্তমান বাংলাদেশে এ জালিয়াতির স্রোত বইছে। এখনই সময় এসব জালিয়াতি কঠোরভাবে বন্ধ করা। তা না হলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি, বেকার যুব সমাজসহ আপামর জনসাধারণ এই মিথ্যে প্রলোভনে প্রতারিত হতে থাকবে। এসব জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সেই সাথে সচেতন নাগরিকেরও রয়েছে এর প্রতিরোধের দায়িত্ব। ------------------------------------------------------------------- তথ্যসূত্র: ১. ইয়া পেরেলম্যান, 'অঙ্কের মজা' মির প্রকাশন, মস্কো।

২. ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন ওয়েভ সাইট। ৩. বাংলা ও ইংরেজি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.