আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেচের জন্য কম খরচে সৌরশক্তি

কেরানীগঞ্জে ১০ বিঘা জমিতে সৌরশক্তিচালিত পাম্প দিয়ে সেচকাজের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়েছে ছবি: সৈকত ভদ্র আকাশে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে চৌচির। রেহাই নেই কৃষিজমিরও। পানির অভাবে ধানখেত খটখটে, শুকনো। মরে যাচ্ছে ধানের চারা। লোডশেডিং বা অন্য কোনো দুর্যোগ, দুর্ঘটনার কারণে বিদ্যুৎ নেই।

জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। পাম্প চালানোর মতো জ্বালানি তেল কেনারও উপায় নেই কৃষকের। বিদ্যুৎ কবে আসবে, তার ঠিক নেই। কৃষকের মাথায় হাত! এবারের চিত্রটি ভিন্ন। শুকনো খেতের পাশের জমিতেই কৃষক হাসিমুখে কাজ করছেন।

পাম্পের পাইপের পানি পড়ার কলকল শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিয়মিত সেচ হওয়ায় ধানের চারা বেড়ে উঠছে। বাতাসে ধানের কচি শিষগুলো দোল খাচ্ছে। যে সূর্যের তাপে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যাচ্ছে, কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না—সেই সূর্যের তাপ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ চলছে কৃষিজমিতে। শুনতে গল্পের মতো মনে হলেও এরই মধ্যে সৌরশক্তি দিয়ে ‘সোলার পাম্প’ ব্যবহার করে কৃষিজমিতে সেচকাজ করা হচ্ছে।

দেশে যখন বিদ্যুৎ আর জ্বালানির তীব্র সংকট, তখন বিকল্প উৎস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে সৌরশক্তি। দেশের বিভিন্ন স্থানে সৌরশক্তিচালিত পাম্পের ব্যবহার শুরু হয়েছে আগেই। এর পাশাপাশি এই নিয়ে নানান গবেষণাও হচ্ছে। তারই একটি গবেষণার মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার আটিবাজারের পাশেই বামনসুর গ্রামের ১০ বিঘা জমিতে শেষহয়েছে। এখানে সৌরশক্তিচালিত সোলার পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে তা চাষের জমিতে সরবরাহ করা হয়েছে।

দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে এই প্রকল্পের কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। গোড়ার কথা বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। তাই চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের সরবরাহ নেই। এ কারণেই অনেক সময় লোডশেডিংয়ের অন্ধকারের মধ্যে থাকতে হয়। সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বেড়ে যায়।

চাহিদা পূরণ করতে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ে লোডশেডিং। বেসরকারিভাবে কৃষিজমিতে সৌরশক্তিচালিত সোলার পাম্প দিয়ে সেচকাজ পরিচালনা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির সেচকাজে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে কাজ শুরু করেন। এস এম লুৎফুল কবির নিজস্ব অর্থায়নে তাঁর কর্মস্থল বুয়েটের পুরকৌশল ভবনের ছাদে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেন।

সেই গবেষণা নিয়ে ‘বিজ্ঞান প্রজন্ম’ পাতায় বিশেষ প্রতিবেদনও ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির নজরে আসে। তারা অধ্যাপক লুৎফুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ প্রকল্প মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক অনুদান দিতে আগ্রহী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ৪০ লাখ টাকা এ প্রকল্পের জন্য দেয়। এ প্রসঙ্গে লুৎফুল কবির বলেন, ‘টাকার জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করতে পারিনি।

টাকা পাওয়ার পর সৌরশক্তিচালিত পানি উত্তোলনক্ষম সেচব্যবস্থায় আটিবাজারের এ প্রকল্প চালু করি। ’ প্রাথমিক লক্ষ্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন কৃষি সেচকাজে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ লাগে। এস এম লুৎফুল কবির বললেন, ‘আমরা যদি এর একটি বড় অংশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তবে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা যেত অনেকখানি। ’ প্রাথমিক এই লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ শুরু করেন অধ্যাপক লুৎফুল কবির ও আবদুল হাসিব চৌধুরী। কাজ শুরুর আগে তাঁরা দেখলেন, সেচকাজে সৌরশক্তি ব্যবহার নিয়ে আগেও বেশ কিছু চেষ্টা করা হয়েছে।

কিন্তু কোনোটাই মাঠপর্যায়ে সফলভাবে প্রয়োগ হয়নি। সফল না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে লুৎফুল কবির বলেন, সফল না হওয়ার মূল কারণই হলো সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্যানেল বা সোলার প্যানেলের খরচ। তিনি জানান, এ ব্যবস্থার প্রধান খরচটা হচ্ছে সৌর প্যানেল কিনতে। তাই সৌর প্যানেলের খরচ কীভাবে কমানো যায়, কিংবা একই পরিমাণ প্যানেল দিয়ে কীভাবে বেশি পানি সেচ করা যায়, সে বিষয়টিই ছিল লুৎফুল কবির আর তাঁর দলের গবেষণার মূল বিষয়। মূল বিষয় তিনটি প্রকল্পটি মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আগে লুৎফুল কবির তিনটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন।

১. সৌরশক্তি ব্যবহারের জন্য কোনো ব্যাটারি ব্যবহার করার প্রয়োজন রয়েছে কি না। যদি শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে হয়, তাহলে ব্যাটারির বিকল্প নেই। অথচ এই ব্যাটারি খরচ বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়া এটি প্যানেলের দীর্ঘস্থায়ী নয়। ২. বিদ্যুৎচালিত পাম্পগুলোতে এসি (অলটারনেটিং কারেন্ট) মোটর ব্যবহার করা হয়।

সৌর প্যানেলগুলো ডিসি (ডাইরেক্ট কারেন্ট) বিদ্যুৎ তৈরি করে। যদি এসি মোটরই ব্যবহার করা হয়, তাহলে ডিসি শক্তিকে এসিতে রূপান্তরিত করতে হলে ইনভার্টার প্রয়োজন হবে, যা কিনা আবারও খরচ বাড়িয়ে দেবে। আর সেই ইনভার্টার নষ্ট হওয়ার প্রবণতাও বেশি। ৩. কী আকারের পাম্প ব্যবহার করা হবে, সেটাই ছিল অধ্যাপক লুৎফুল কবির আর তাঁর দলের বড় চিন্তার কারণ। সূর্যের আলো সারা দিন একরকম থাকে না।

সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সকালে আর বিকেলের দিকে অল্প শক্তি পাওয়া যাবে। দিনের মধ্যভাগে বেশি শক্তি পাওয়া যাবে। পাম্পের আকার যদি এমন হয় যে দিনের বেশির ভাগ সময় তা চলবে, তাহলে বড় আকারের সোলার প্যানেল ব্যবহার করতে হবে। আর যদি সোলার প্যানেলের ক্ষমতা অনুযায়ী পাম্প বাছাই করা হয়, তাহলে শুধু সূর্য যখন তীব্র থাকবে, তখনই পাম্প চলবে। গবেষণার সাফল্য লুৎফুল কবির বলেন, ‘এ তিনটি প্রাথমিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয় আমাদের প্রকল্পে।

তিনটি আলাদা বিষয় সফলভাবে গবেষণা সম্পন্ন করতে পেরেছি। বামনসুর গ্রামে প্রকল্পের প্রথম সাফল্য হলো সৌরশক্তিতে চলা সোলার পাম্পে কোনো ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়নি। এতে কোনো শক্তি সঞ্চয় করে রাখার দরকার হয়নি। সরাসরি সূর্যের তাপের শক্তি নিয়ে পানি উত্তোলন করা হয়েছে। প্রকল্পে সরাসরি ডিসি মোটর চলেছে সোলার প্যানেলের বিদ্যুতে।

এতে কোনো কনভার্টার ব্যবহার করা হয়নি। কনভার্টার ব্যবহার না করার ফলে খরচ অনেক কমে গেছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় সাফল্য এটি। ’ ‘তৃতীয় সাফল্যটি এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ’ বললেন লুৎফুল কবির।

জানালেন, ‘প্রকল্পে আমরা সূর্যের আলো সর্বোচ্চ ব্যবহার করার নিশ্চয়তা দিতে পারি। সারা দিন সূর্যের তাপ একরকম থাকে না। তাই যখন তাপ কম থাকে (সকালে ও বিকেলে), তখন পাম্প দিয়ে পানি তোলা যায় না। এতে কৃষিজমির অনেক ক্ষতি হতে পারে। এ প্রকল্পে আমরা দেড় ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি ও তিন ইঞ্চির পাইপ ব্যবহার করেছি পানি তোলার জন্য।

’ তিনি বলেন, সকালে যখন সূর্যের আলো কম থাকে, তখন দেড় ইঞ্চি পাইপ দিয়ে পানি তোলা হয়। আবার যখন সূর্যের আলো দুপুরের দিকে সর্বোচ্চ থাকে, তখন একসঙ্গে তিনটি পাইপ দিয়ে পানি তোলা সম্ভব হয়েছে। একইভাবে সূর্যের আলো কমার সঙ্গে পানি তোলার পাইপের সংখ্যাও কমে যাবে। এতে যেমন সূর্যের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে, একই সঙ্গে দিনের কোনো সময়ই পানি তোলা বন্ধ হবে না। ’ তবে এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো এর ব্যবহার বাড়লে কৃষক রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমোতে পারবেন।

কারণ, বর্তমানে সেচকাজের জন্য গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় রাত ১১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। ফলে ওই সময় কৃষককে থাকতে হয় মাঠে। কিন্তু সেচের পানি যদি কেবল দিনের বেলাতেই পাওয়া যায়, তাহলে কৃষক রাতে নিজ ঘরেই থাকতে পারবেন, যেমনটি পেরেছেন এই প্রকল্প এলাকার কৃষক। কম খরচে বেশি পানি আগে সবার ধারণা ছিল, সোলার প্যানেলের খরচ অনেক বেশি। অধ্যাপক লুৎফুল কবির জানান, এ প্রকল্পের খরচ অন্য ব্যবস্থার চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম।

পুরো সৌর প্যানেলটিতে মোট খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার কাছাকাছি। স্থায়িত্ব ধরা হয়েছে ২৫ বছর। ২৫ বছরের মধ্যে আর কোনো বড় খরচ নেই বললেই চলে। কৃষিজমিতে তিন মাস ব্যবহারের পর প্যানেলগুলো বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা যাবে। বাসাবাড়িতে ডিসি বিদ্যুৎচালিত উপকরণ ব্যবহার করতে পারলে তখনো ইনভার্টার ছাড়াই সেটি ব্যবহার করা যাবে।

দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার সৌরশক্তিচালিত বেশি পানি উত্তোলনক্ষম কৃষি সেচব্যবস্থাটিতে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পের গবেষণা সহকারী সফররাজ হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পে কোনো বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। এ প্রকল্পে ব্যবহূত প্যানেল এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। ’ বাতাস ধানের শিষে দোল দিচ্ছে। আর কিছুদিন পর কৃষকের উঠান ভরে যাবে সোনালি ধানে।

সে স্বপ্ন নিয়ে জমিতে কাজ করছেন কৃষক রহমত আলী। ‘৩২ বছর ধইরা এই জমিতে ধান ফলাই। যহন ধানে উঠান বইরা যায়, তহন মনে আর কোনো কষ্ট থাহে না’—বলেন রহমত আলী। সূর্যের আলোয় বিআর-২৯ ধানের সবুজ কচি পাতাগুলোর মতো ঝিলিক কৃষকের মুখেও। লুৎফুল কবির বলেন, বিদ্যুৎ বা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এনে সেচকাজে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

সরকারের সহযোগিতা পেলে সেচকাজে সৌরশক্তি ব্যবহার করে কৃষক রহমত আলীর মতো দেশের প্রত্যেক কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব বিজ্ঞান প্রজন্ম প্রতিবেদক, প্রথম আলো, ০৫-০৬-২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।