আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুতপা - ২

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই বিয়ে নিয়ে খুব একটা স্মৃতি নেই । বাবার কেন যেন মনে হয়েছিল তিনি আর এক সপ্তাহ বাঁচবেন । তাড়াহুড়ো করে সব হল। শৈশব থেকে বাবার রক্তচক্ষুতে মা ছিল দেবীর আশ্রয। কিন্তু নদীর জল এত বয়ে গেছে মাকে বলেও লাভ হবে না।

বাকি থাকল প্রহরীর মতো একটার পর একটা আদেশ শুনে যাওয়া। বাবা তার কক্ষে ডেকে পাঠালেন, স্পষ্ট করে তার সিদ্ধান্তটা বললেন, আমার হাতে হাজার বিশেক টাকা গুঁজে দিলেন যাতে বিয়ের পর কলকাতায় ঘুরে আসি। কলকাতায় কোন শহরে কার বাড়িতে থাকব সেটাও আমাকে বলে দিলেন। আমি যে সহপাঠী সীমাকে পছন্দ করি এমন কথাটা বলার সুযোগ থাকল না । ইচ্ছে হয়েছিল জরুরী কোন অজুহাতে বিয়েটা পণ্ড করি।

বলতে পারতাম এক্ষুণি যেতে হবে ঢাকায়, তারপর আর না দেখা দিয়ে নিজের মত চলি। কিন্তু তাতে বাবার মৃত্যুটা ত্বরান্বিত হত। আর সেই সহপাঠীর প্রতি ভাল লাগা প্রাথমিক স্তরে। মেয়েটাকে একসময় খুব অহংকারী মনে হত। রূপবতী মেয়েরা এতদিন একলা থাকে না।

লাইব্রেরীতে পরীক্ষার আগে এক সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে হল। মেয়েটা বহুদিনের প্রেম ভেঙে গেছে জেনে ভাললাগাটা নুতন ডালপালা ছড়াতে শুরু করছিল। তবে হুট হাট ভালবাসি বললে ওজনটা কমে যাবে এজন্য সরাসরি জানানো হয়নি। যদি জানতাম এমন করে বিয়ে ঠিক হবে তবে নিশ্চয়ই জানিয়ে দিতাম। মুখে না হলেও সীমা আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছিল।

প্রেম ছাড়া প্রতিটি পদক্ষেপ মেয়েরা এভাবে কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। বাবার শরীরের আশঙ্কা ছাড়াও ত্রপার কথা ভাবছিলাম। সে সদ্য পিতৃহারা মেয়ে। বিয়ে ঠিক করেছে তার বড় মামা আর আর আমার বাবা। ও পক্ষের আয়োজন মামার বাড়িতে।

ত্রপার নির্দোষ। মুরুব্বীরা যেখানে বিয়ে দিত সেখানেই যেত । এখন বিয়েটা ভেঙে গেলে তার যে চাপ সেটা কি সে সহ্য করতে পারবে? যদি আত্মহত্যা করে বসে! এসব ভেবে ভেসে চললাম যেদিকে আমাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক একবছর পর জুন মাসে বাবা মারা যায় হার্ট এটাকে । আমার মনে হয় বিয়েতে বাবা যে আনন্দ পেয়েছিল সারাজীবনে এতটা আনন্দ পায় নি।

আমি অভিনয়ই করেছি তবে অভিনয়টুকু ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। বিয়ের আগের দিন তিনি হুইল চেয়ারেই ঘুরে বেড়ালেন বারান্দা থেকে সিমেন্টের বেদী। ফুলগাছ ছাঁটালেন। বাড়ির ভেতরে ঘাস কাটাতে লোক আনালেন। লাউডস্পীকারে গান বাজলো উনার পছন্দের ।

ইলেকট্রিশিয়ানেরা ধমক খেয়ে দ্বিগুন পরিমান লাল হলুদ বাতি ঝুলিয়ে দিল ছাদ থেকে। পরিস্থিতি মানুষকে কাপুরুষ করে দেয়। কাপুরুষ না হলে বিয়ের মতো ঘটনাও অভিনয় করে যায় কেউ! বিয়ের আসরে বসেও ত্রপা আর সীমা - দুটো মেয়ের পাশাপাশি তুলনা করছিলাম । সীমার প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ফর্সা চেহারার পাশে শ্যামলা সাধারণ ত্রপা খুব ম্লান মনে হয়। একটা অদ্ভুত ধারণা আমার মাথায় আসে।

আর তখনই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ত্রপাকে আমি ভালবাসি না। মনের ভেতর স্থান না পেলে সৌন্দর্য থাকা না থাকা তো একই কথা। বিয়ের হৈচৈ শেষ হল। রাতে দরজা বন্ধ সবাই চলে গেলে নববধূটি বিছানায় বসেই থাকল।

আমি বাড়ির সবার সঙ্গে অভিনয় পাঠ সমাপ্ত করে হাফ ছাড়লাম। মেয়েটির কাছে গিয়ে খুব আহত না করে তাকে বললাম, ত্রপা, শোনো, আজ এই রাতে তোমাকে কিছু না বললেই নয়। প্রথমত: আমি বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত না। আমার কাছে পেশার চেয়ে বড় কিছু নেই। বাবা অসুস্থ এজন্য সিদ্ধান্তটা অনিচ্ছায় মেনেছি ।

যা হবার হয়েছে। ডাক্তারীতে সুস্থির হবার আগে আমি এসবে আর এগোতে চাইনা। ত্রপা বুঝতে না পেরে বলল, আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আমি তাকে বললাম, আমি দুদিন পরই চলে যাচ্ছি । অনেকদিন ফিরব না।

তুমি এখানেই থাকবে। যতদিন শহরে থাকব একলাই কাটাতে হবে। সে বলল, আপনি ভাল জানেন। আমার কাছে আপনি বড়। যেভাবে বলবেন সেভাবেই থাকব।

পুরো কথা শেষ হল না। সুতপাকে মুক্তি দেবার জন্য সুদুর প্রসারী ভাবনায় ডুবে গেলাম আমি। মেয়েটি বহুক্ষণ অপেক্ষা করে এক সময় বলল, আপনি ঘুমাবেন না? আমি নিরুত্তাপ গলায় বললাম, -তুমি ঘুমিয়ে পড়। ভোরে উঠতে হবে। মেয়েটি নরম গলায় বলল, -একটা কথা বলি।

আপনি কিন্তু আমাকে সুতপা নামে ডাকবেন। আমার আপন ছিল বাবা সে মারা যাবার আগ পর্যন্ত এই নামেই ডাকতো আমাকে। বিয়ের ধকলে সে খুব ক্লান্ত ছিল। মেয়েটি জায়গা ছেড়ে খাটের একপাশে শুয়ে থাকল। বুঝতে পারছিলাম না সে জেগেই আছে কিনা।

মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লে সন্তর্পনে মেঝেতে কাঁথা দিয়ে বিছানা পাতলাম। বিয়ের পরদিন ছোট খাট কিছু আনুষ্ঠানিকতা হলেও সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় ছাড়া কিছু ছিল না। পরদিন রাতে ত্রপা সহজ হল। বলল, আপনি কি আমার দিকে রাগ করেছেন? গত রাতে নিচে ঘুমালেন যে। -না, রাগ হবে কেন।

কিন্তু তোমাকে আরও কিছু কথা বলা দরকার। এখন না। দু'দিন যাক দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত ১০ টা জানান দেয় । ত্রপা ঘরে ঢোকার আগে স্নান সেরেছে। তখনও চুল ভেজা।

লম্বা মসৃণ চুলে তাকে ভাল লাগছিল। সে আমার দিকে না তাকিয়ে শক্ত গলায় অসহিষ্ণু হল। -না, আপনি এখনই বলুন। আমি কিছু মনে করব না। সুতপা খাটে বসে ছিল।

আমি চেয়ারে বসে দেখতে পেলাম তাকে। মৃদু ফ্লুরোসেন্টের আলো তার প্রশস্ত কপালে। সাদায় লাল বলপ্রিণ্টের শাড়ীতে পুরনো দিনে ছবির মেয়ে মনে হচ্ছে তাকে। এরকম একটি মেয়ে যে একান্ত আমার জন্য এই ঘরে অপেক্ষা করছে বিশ্বাস হল না। বুকের পশমে চিন চিন টের পাই।

কিন্তু এই আকর্ষণটা গতকাল কোথায় পালিয়ে ছিল? নিজের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছিল কেননা সহজ একটা ঘটনাকে জটিল করেছি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার অন্তর্গত উচ্ছাস হেরে গেল উচ্চাকাঙ্খার কাছে। বাবা মা আর ক'টা দিন। আমার ইচ্ছে দেশের বাইরে যাবার। বড় পড়াশোনা করার।

সীমা পরিণত ও শিক্ষিত। পরিস্থিতির স্বীকার যেটা তাকে বললে হয়তো মেনে নেবে। তার পর.. কথা পাল্টালাম। বললাম -থাক এসব। তুমি কাল খুব কষ্ট পেয়েছ জানি।

ডাক্তার হতে হলে আবেগ ঝেড়ে ফেলতে হয়। জীবন বাঁচাতে অনেক শক্ত কাজ করে ফেলতে হয় আমাদের। ভূমিকাটা প্রয়োজন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাটলাম। পিছন থেকে বলতে সুবিধা হবে।

বললাম -আমি বিয়েটা না মেনে নিলেই হত। কিন্তু এরমধ্যে বিশাল ভুল হয়ে গেছে। বাবার কথা ভেবে মেনেছি। এখন আমি মুক্তি চাই। জানি না কি করে হবে।

আমি তোমাকে স্পর্শ করব না । কাল চলে যাব। আমি মুক্তি চাই এখান থেকে। মেয়েটি কথা শেষ হওয়া মাত্র অস্ফুট স্বরে কেঁদে উঠল। হু হু করে চোখ দু হাত ঢেকে চিৎকার করতে থাকল।

এ কি বলছেন আপনি.. আমি অবস্থা বেগতিক টের পাই। পাশের ঘর থেকে কেউ ছুটে আসবে তাই ছুটে গিয়ে তার হাত ধরলাম। থামো, কী করছ - বাড়ি জুড়ে প্রশ্ন উঠবে, ফিস ফিস করে অনুনয় করলাম সে চুপ করল আমি বললাম, তোমার মতো আমিও দ্বিধাগ্রস্ত। আমি সবার সঙ্গে অভিনয় করেছি তোমার সঙ্গে করতে চাই না। কাপড় বদলে ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম।

শুয়ে থাকলাম কিন্তু ঘুম এল না। পূব দিকের জানলাটা খুলে দিলাম। তন্দ্রা এসেছিল কিন্তু তার ঘোরে দেখতে পেলাম এয়ারপোর্ট লাউণ্জে বসে আছি। মাথার উপর বিমানের সময় বলছে কেউ। সীমা চলে যাচ্ছে।

ছুটে গিয়ে ভালবাসার কথাটা বলতেই সে বলল, মাথা খারাপ তোমার। বহু আগে থেকেই প্রবাসী এক ছেলেকে ভালবাসি। এক সঙ্গে পড়লে সুসম্পর্ক হয়। সেটা তো ভালবাসা নয়। আর তোমাদের ছেলেদের তো মুশকিল একটু ঘনিষ্ট হলেই ভাবো প্রেমে গদগদ হয়ে যাচ্ছে।

আমি বাতি জ্বাললাম। ঘড়িতে রাত পৌনে তিনটা। বিছানায় সুতপা কাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে । বহুক্ষণ নিরবে কেঁদেছে বোঝা যায়। সে মুহুর্ত খুব বেশী অপরাধী মনে হয় নিজেকে।

বিছানায় তার পাশে বসে বাম হাতটা মুঠোর ভেতর নিয়ে প্রথম বারের মতো ডাকলাম, সুতপা। মেয়েটা ঘুম ভেঙে চেয়ে অবাক হয়ে ডান হাতে শাড়ী ঠিক করে নেয়। বসে। আমি আনাড়ির ছেলের মতো তাকে কাছে টেনে নেই। কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে বলি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।

খুব ভুল দিকে যাচ্ছিলাম। যা বলেছি ও সব মিথ্যে। বিশ্বাস কর সব মিথ্যে। পরদিন থেকে আমাদের নতুন সংসার তৈরীর স্বপ্ন শুরু হয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি একা থাকব না।

কাজটা সহজ করে দেয় মা। বলল, ঢাকায় বাড়ি ভাড়া করে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে। (চলবে) --- ড্রাফট ১.০ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।