তৃতীয় বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্যে দুটি জিনিশ দরকার : বন্দুক ও কবর। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে চলমান জনজীবন গণমাধ্যমের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। বলা যায়, জীবন এখন গণমাধ্যমনির্ভর। সমাজের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, চিন্তা-দুশ্চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া বা গণমাধ্যম। সাক্ষর লোকজন প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে আলোড়িত হন।
তাদের প্রভাবে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীও আলোড়িত হয়। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দুয়ার তো সবার জন্য উন্মুক্ত। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে তথ্য প্রবাহও এখন অবাধ। কোন তথ্যই আজকাল সহজে কেউ গোপন রাখতে পারে না। ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি তথ্যপ্রবাহ ও গণযোগাযোগ অঙ্গনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
এ দিগন্ত দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। ২০০৫ সালে বিশ্বে বস্নগারের সংখ্যা ছিল ২২ মিলিয়ন। মাত্র পাঁচ বছরে এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে ১০০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়ায়। এ বাস্তবতায় গণমাধ্যম সম্পর্কিত স্বাধীনতার সনাতন ধারণা বদলানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যুগসঙ্গত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ না করলে সামাজিক সুষম বিকাশ ব্যাহত হবে।
তাই জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অধিকার ও কর্তব্যের সমন্বয়সাধন আবশ্যক। একসময় পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনই ছিল প্রধান গণমাধ্যম। এখন সে প্রধান্য নেই। উন্নত দেশে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বেও তথ্যপ্রযুক্তির ঢেউ লেগেছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কেউ শঙ্কিত। তবে পিছনে তাকিয়ে গণমাধ্যমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে হতাশার দিকটি দুর্বল হয়ে আসে। রেডিও চালু হওয়ার পর অনেকে বলেছিলেন, সংবাদপত্রের দিন শেষ। আবার টিভি দৃশ্যপটে এলে বলা হলো, রেডিওর বারোটা বেজে গেল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতার দাবি অনুযায়ী প্রতিটি মিডিয়াই নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আর প্রিন্ট মিডিয়ার একটি বাড়তি শক্তি আছে_ প্রিন্ট মিডিয়া পাঠকের মন-মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। পাঠকের কল্পনা শক্তি উসকে দেয়। অন্য মিডিয়া অনেকটা তাৎক্ষণিক। মন-মননে ততটা গভীর রেখাপাত করতে পারে না। খবর শোনা এবং পত্রিকায় পড়া অথবা দৃশ্য স্ক্রিনে সরাসরি দেখা ও প্রিন্ট মিডিয়ায় পড়ে কল্পনায় চিত্র এঁকে দেখা এক কথা নয়।
তাই অন্য মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান দাপট সত্ত্বেও সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার নয়। অবশ্য এক্ষেত্রে সংবাদপত্রের বিষয় বৈচিত্র্য এবং চলার পথ মুক্ত রাখার প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত। বাংলাদেশে বলা যায় একটু বেশিই আলোচিত, এ জন্য যে গণতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে স্থিতিশীলতা ও নৈতিক একটি মান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে অনেক বিষয়ই উচ্চমাত্রার আলোচনায় থাকে না।
ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এত হৈচৈ প্রায় নেই-ই। আমাদের সমাজ এখনো ভাঙাগড়ার পর্যায়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। ঔপনিবেশিক আমলের মানসিক পশ্চাৎপদতা এবং বর্তমান মুক্ত বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যের লড়াইয়ে জয় হবে আধুনিকতার, জয় হবে প্রগতির। এ জন্য যে, আধুনিক ধ্যান-ধারণায় শাণিত অনেক সংস্থা-সংগঠন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সময়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়।
জেলাপর্যায়েও এখন পেশাজীবীরা সজাগ ও সক্রিয়।
বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার কম। সরকারি হিসাবেই কয়েকশ কেবল দৈনিক পত্রিকাই বের হয়। শিক্ষার হার, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব প্রভৃতি বিবেচনায় বলা যায়, দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপন্ন নয়। এরপরও স্বীকার করতে হবে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিষ্কণ্টক নয়।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক বাধা বিদ্যমান। গত পনের-ষোল বছরে চবি্বশ জনের মতো সাংবাদিককে প্রাণ হারাতে হয়েছে। নানা নির্যাতন, হুমকি, চাপ আছে; জেল-জুলুমও আছে। সত্য প্রকাশে কারও কারও রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বিঘি্নত হয়। এতে সাংবাদিক হন ক্ষোভের শিকার।
চাপ-তাপ-হুমকি এবং সহকর্মীদের লাঞ্ছনার মুখে বস্তুনিষ্ঠ, মুক্ত সাংবাদিকতা তাই আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ এবং কঠিন। এই রূঢ় বাস্তবতায় বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছেন।
এই পটভূমিতে সিলেট অঞ্চলও পিছিয়ে নেই। সাংবাদিকতার অঙ্গনে সিলেট সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের হাত ধরে আধুনিক জীবনের দাবি পূরণে অগ্রসর হচ্ছে। একসময় যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অনগ্রসর।
রাজধানী থেকে সিলেটে দৈনিক পত্রিকা আসত বাসি হয়ে পরের দিন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ারও এত প্রসার ছিল না। সাক্ষরতার গড় হারও ছিল কম। কিন্তু এখন গ্লোবাল ভিলেজের কনসেপ্ট শুধু ধারণাই, নয় বাস্তবেও প্রতিষ্ঠিত। ঢাকার পত্রিকাগুলো মফস্বল সংস্করণের কাজ মধ্য রাতে সম্পন্ন করে রাতেই পাঠিয়ে দেয় নিজস্ব বাহনে।
স্থানীয় পত্রিকার আগে ঢাকার পত্রিকা চলে আসে বাজারে। সিলেট পত্র-পত্রিকার একটি ভালো মার্কেট। উল্লেখ করা যেতে পারে নব্বই দশকের কথা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর গণতান্ত্রিক সরকার সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করে। এ উদারতার সুযোগে সারাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের জোয়ার আসে।
সিলেট অঞ্চলেও এর ঢেউ এসে লাগে। একঝটকায় সিলেটে পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক। সারাদেশেই তখন সংবাদপত্রের সংখ্যাধিক্য আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সিলেটের বেলায় বিষয়টি অভিজ্ঞ মহল কিঞ্চিৎ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করেছিলেন। সিলেট অঞ্চলের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শতাধিক বর্ষের ঐতিহ্যের পথ ধরেই এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটেছে। দেশের প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক 'যুগভেরী' (প্রথম প্রকাশ ১৯৩৩) বের হতো সিলেট থেকে (এখন দৈনিক)। সেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা থেকে যখন কোন দৈনিক পত্রিকা বের হচ্ছে না তখন সিলেটের সাপ্তাহিক 'নওবেলাল' প্রগতির ঝা-া উড়িয়ে চলেছে। হয়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের মুখপাত্র। উল্লেখ্য, দৈনিক আজাদ ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
ব্রিটিশ আমলে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার যুগেও এ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, সবুজপত্রের কাটতি কলকাতার পরই সিলেটে সবচেয়ে বেশি। সিলেট সেই সময় থেকেই পত্রপত্রিকার ভালো মার্কেট।
এর কারণ এই নয় যে, এখানে ধনীর সংখ্যা বেশি বরং এখানকার ঐতিহ্য এর মূল কারণ। এখানকার সাংবাদিকদের তৎপরতায় দীর্ঘদিনে গড়ে উঠেছে একটি বড় পাঠকসমাজ।
বিষয়টি অর্থের নয়, রুচি ও পাঠাভ্যাসের। তাই সিলেটের সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। এখানকার সংবাদপত্র জোয়ারের ফসল নয়, বরং উর্বর পশ্চাৎভূমির ফসল। এখানকার সংবাদপত্র আকস্মিক নয়, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অতীতে সিলেটের শিক্ষার হার ছিল জাতীয় গড় হারের তুলনায় বেশি।
ষাটের দশক থেকে শিক্ষার হার হ্রাস পায়। কিন্তু এরপরও পত্রিকা পাঠকের সংখ্যা কমেনি। একেকটি পরিবারে স্থানীয় পত্রিকাসহ একাধিক দৈনিক নিয়মিত রাখার রেওয়াজ সম্ভবত সিলেটেই সবচেয়ে বেশি চালু আছে।
সিলেট নগরী থেকেই এখন দৈনিক পত্রিকা বের হয় দশটি। অথচ ১৯৮৪ সালের আগে স্থানীয় সাপ্তাহিক ও ঢাকাই দৈনিক-কেন্দ্রিক ছিল এখানকার সাংবাদিকতা।
তিক্ত হলেও স্বীকার করতে হবে যে, সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মান উন্নয়ন হয়নি। পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিলেট প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতিকে র্যাব উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। পরে তার বিরুদ্ধে দুটো মামলা করে। জরুরি অবস্থায়ই একটি মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পান।
পরে অপর মামলায়ও তিনি খালাস পান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ ঘটনায় ঢাকার কোন প্রতিষ্ঠান সোচ্চার হয়নি। আমরাও সোচ্চার হতে পারিনি, যেটুকু দরকার ছিল। শুধু মানবাধিকার সংগঠন অধিকার, রিপোর্টার্স সেন্ট ফ্রন্টিয়ার্স এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল। আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও আজ পর্যন্ত এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার হয়নি।
আমাদের আরেক সহকর্মী ফতেহ ওসমানী এক বছর আগে দুর্বৃত্তের হাতে খুন হন। খুনের মামলায় এক বছরের বেশি সময় পরেও চার্জশিট হয়নি। এটি দুঃখজনক। সম্প্রতি দৈনিক জালালাবাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে হয়রানিমূলক চাঁদাবাজির মামলা করা হয়। এ নিয়ে যখন সাংবাদিকরা প্রতিবাদে সোচ্চার ঠিক তখন একমাস পর একই ঘটনায় আরেকটি মানহানির মামলা করা হয়েছে।
কয়েক দিন আগে শাবিতে একজন সংবাদকর্মীকে (সে একজন ছাত্র) বহিষ্কার করা হয়, কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই। পরে হাইকোর্টে রিট করা হলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অতিসম্প্রতি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের এক সংবাদকর্মীকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের দায়ে ইউএনও ডেকে নিয়ে জেলে পাঠিয়েছেন। শহরের বাইরের সংবাদদাতারা বলতে গেলে অনারারি কাজ করেন। দু-একটি দৈনিক ছাড়া বাকিগুলোর আর্থিক ভিত্তি খুব দুর্বল।
তবে সিলেটের পরিবেশ প্রসংসনীয়। দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত সন্ত্রাসী চক্র আছে। অনেক স্থানে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চাপ আছে। তবে সিলেট এক্ষেত্রে অনেকটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। সিলেটে জঙ্গি শেখ আবদুর রহমানের কোন ঘাঁটি ছিল না_ আশ্রয় নিয়েছিলেন মাত্র।
একযোগে বোমা বিস্ফোরণে জড়িত ব্যক্তিরা ছিল বহিরাগত। এরপরও সিলেট মুক্ত সাংবাদিকতায় একান্ত নিরাপদ নয়। আছে প্রচ্ছন্ন ভয়ভীতি। নীতিবিচ্যুতিও ক্ষেত্রবিশেষে আছে, আছে অন্যায় নির্যাতন। অধিকাংশ পত্রিকায় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ঘড়ে ওঠেনি, প্রচলিত নিয়োগবিধিরও অনুসরণ নেই।
এখন সিলেটে সাংবাদিকদের বহু প্রশংসিত ঐক্যশক্তিতেও চিড় ধরার উপক্রম হয়েছে। এটি দুঃখজনক। তবে আমরা এ থেকে উত্তরণে সচেষ্ট রয়েছি। সিলেট জাতীয় মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই সমস্যা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত উদ্যোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর হতে হবে।
মুক্ত সাংবাদিকতায় এখন বহির্গত বাধা-বিপত্তি আছে, আলোচনাও আছে, সেই সঙ্গে আছে অভ্যন্তরীণ অন্তরায়_ বলা যায় কম আলোচিত। করপোরেট পুঁজি বা বিজনেসের মতো এখন করপোরেট জার্নালিজম প্রসার লাভ করেছে। গ্রুপ-গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় এক্ষেত্রে সত্য মার খায়। আছে সাংবাদিকদের একাংশের অতিরিক্ত রাজনীতিপরায়ণতা। দলবিশেষের প্রতি রাজনৈতিক অন্ধ আনুগত্য প্রবল হয়ে পেশাগত নৈতিক সততা ব্যাহত হয়।
এ ছাড়া মালিক ও কিছু সাংবাদিক আত্মস্বার্থে সত্যবিচ্যুত হন। বলা যায়, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নেই বলে কেউ আত্মবিক্রয় করে বসে। কিন্তু এ মানসিকতার লোকদের জন্য তো জীবিকার অন্য পথ খোলা আছে। তবুও কালো ভেড়া সব জায়গাতেই আছে। তাই নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইতিবাচক প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
রাজনীতি সবসময় চাইবে সংবাদ মাধ্যমের সমর্থন। এক্ষেত্রে সেই ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হিকির গেজেটের ঘোষণা ড়ঢ়বহ ঃড় ধষষ ঢ়ধৎঃরবং নঁঃ রহভষঁবহপবফ নু হড়হব আমাদের নীতি হতে পারে।
প্রতিটি পেশার সর্বজনস্বীকৃত নৈতিক একটি মানদ- থাকে_ সাংবাদিকতারও আছে। ১৯২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সম্পাদক সমিতি লিখিত প্রণয়ন করে। আমাদের দেশে তেমন কোন লিখিত দলিল নেই।
তবে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট আছে, আছে প্রেস কাউন্সিলের ২৫টি নীতিসংবলিত আচরণবিধি। এরপরও আমাদের সাংবাদিকতায় বিচ্যুতি-বিকৃতি আছে। মুক্ত গণমাধ্যমের স্বার্থে এই ঘাটতির দিকটি দেখতে হবে। অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে বার্নাড শ'র ঋৎববফড়স রিঃযড়ঁঃ ড়নষষরমধঃরড়হ রং ধহধৎপযু মন্তব্যের আলোকে আত্মসমালোচনার পথ ধরে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। বলা হয়, সাংবাদিকতা সবসময় বিবেকের কাছে জবাবদিহি করে।
কিন্তু বিবেক ভোতা হলে এর খেসারত দিতে হয় সাংবাদিক সমাজকে। বৃহত্তর পরিসরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও সমাজ।
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সাংবাদিকতার বিকাশ আমাদের কাম্য। এক্ষেত্রে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে সাংবাদিকতা ছিল মিশন, এখন হয়েছে প্রফেশন। অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতা একটি পেশা।
আর প্রতিটি পেশারই উপজাত কিছু সমস্যা অন্তত আমাদের সমাজে আছে, তাই সাংবাদিকতার ছায়ায় অপসাংবাদিকতা হয়। এটি হচ্ছে, কারণ সাংবাদিকতা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা থেকেই মূলত অসংখ্য অপকর্মের সৃষ্টি। উন্নত দেশে ঢালাও দুর্নীতি, ঘাপলা, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা নেই। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক্সপ্লয়েট বা বস্ন্যাকমেইল করে অপসাংবাদিকতার সুযোগও কম।
আমাদের দেশে কাচের ঘরে অনেকের বাস। দুষ্ট প্রকৃতির লোক এর সুযোগ গ্রহণ করে।
চারদিকে দুর্নীতির নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা আছে। তাই বলে সাংবাদিকও এ দলে শরিক হবে?_ কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। মানুষ সবখানে হতাশ হয়ে আসে সংবাদপত্রে।
নির্ভর করে সাংবাদিকের ওপর। এ ছাড়া সমাজের স্বার্থে অন্যের বিচ্যুতি ফাঁস করে সাংবাদিক। তিনিই যদি নীতিছুট হন তাহলে সমাজের আর কোন ভরসা থাকে না।
সাংবাদিকদের মধ্যে অবশ্য এখনো সৎ ও সাহসী মানুষের সংখ্যা বেশি। অথচ তাদেরও হয়তো আর্থিক নিরাপত্তা নেই।
অভাব আছে বলেই রাহাজানি সমর্থন করা যায় না। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা অপসাংবাদিকতা প্রসঙ্গে একবার লিখেছেন : 'ডজনকে ডজন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব সংবাদপত্রে সাংবাদিক তৈরি করতে গিয়ে নাপিতের হাতে ক্ষুরের বদলে কোদাল দেয়া হয়েছে। অথচ আগেকার দিনে সংবাদপত্র ছিল সাংবাদিক তৈরির কারখানা। তাই কারখানায় তৈরি খাঁটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপসাংবাদিকতার অভিযোগ আসত না'।
(প্রথম আলো ১৪ আগস্ট ৯৯)।
প্রবীণ এই সাংবাদিকের বক্তব্যে প্রচ্ছন্ন একটি ক্ষোভ আছে। তিনি মনে করেন, সংবাদপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যেখানে সেখানে সাংবাদিক গজাচ্ছে। এতে অপসাংবাদিকেরও জন্ম হচ্ছে। এ বক্তব্যে সত্যতা আছে, তবে ভুললে চলবে না যে সাংবাদিকতার সংকোচন গণমুখীনতার লক্ষণ নয়।
অতীতে সংবাদপত্র একটি ছোট বৃত্তে বন্দী ছিল। এত লোকের সংশ্লিষ্টতাও ছিল না। তাই অপসাংবাদিকতা রোধে সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশ ও বিস্তার রোধ করা যায় না যেমন শিক্ষিত নীতিহীন লোকের সংখ্যাধিক্য দেখে শিক্ষার সংকোচন সমর্থন করা যায় না। এটা ঠিক, সংবাদপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অযোগ্য লোকের আনাগোনা বাড়ছে। সাংবাদিকতার মানও আশানুরূপ বাড়ছে না।
' কিন্তু এর জন্য সব জানালা বন্ধ করে দিলে কোনদিনই সংবাদপত্রের প্রার্থিত মান নিশ্চিত হবে না।
মুক্ত প্রেসের জন্য সাংবাদিক সমাজের নীতিনিষ্ঠা ও পেশাগত ঐক্য বড় প্রয়োজন। মুক্ত গণমাধ্যম গণতান্ত্রিক সুস্থ সমাজেরও প্রধান পূর্বশর্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসন বলেছিলেন : বিৎব রভ ষবভঃ ঃড় সব ফবপরফব যিবঃযবৎ বি ংযড়ঁষফ যধাব ধ মড়াবৎহসবহঃ রিঃযড়ঁঃ হবংিঢ়ধৎবৎ ড়ৎ হবংিঢ়ধঢ়বৎ রিঃযড়ঁঃ ধ মড়াবৎহসবহঃ, ও ংযড়ঁষফ হড়ঃ যবংরঃধঃব ধ সড়সবহঃ ঃড় ঢ়ৎবভবৎ ঃযব ষধঃবৎ. এসব সুবচন সবাই জানে। তবু কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না।
তাই সাংবাদিকদের সজাগ ও সচেষ্ট হতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে ঐক্যবোধ সর্বাগ্রে প্রয়োজন। অতিসম্প্রতি প্রেস কাউন্সিল দুটো পত্রিকাকে হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে তিরস্কার করেছে। তাদের আক্রমণের শিকার ছিলেন সাংবাদিক। এ ধরনের অনৈক্যের সুযোগ নেয় অপশক্তি ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী।
তাই পেশাগত ঐক্যের মাধ্যমে সাংবাদিকদের একটি প্লাটফর্মে আসতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা নিন্দা ও তিরস্কার পর্যন্ত সীমিত। প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রেস কাউন্সিল ও আদালতের মধ্যবর্তী সাংবাদিকদের একটি নির্ভরযোগ্য সংগঠন হতে পারে। থাকতে পারে সাংবাদিকদের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং সেল।
হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও প্রেসের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক সাংবাদিকদের সংহতি সংযোগ আবশ্যক। বর্তমানে বিচ্ছিন্ন যে প্রয়াস ও তৎপরতা আছে, তা যথেষ্ট নয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে সময়ের দাবি পূরণে সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ এখন। মিডিয়ার প্রভাব এখন অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি।
তাই এর সদ্ব্যবহারে আমাদের সযত্ন প্রচেষ্টাই কাম্য। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।