আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন?

জানতে ভালোবাসি,...তাই প্রশ্ন করি... শেখ হাসিনার তখনকার উক্তি ছিল, বিএনপি সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। সত্য কথা বলতে গিয়ে ড. কামাল হোসেনকে এরপর গণতান্ত্রিক ফোরাম গঠন করতে হয়েছিল। সেই থেকে যার সূচনা, তারই ফল ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মাঝে রয়েছে অনেক কর্মকাণ্ড। এদেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি দুই দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কাজ কিছুই হয়নি। বিদেশী কূটনীতিক, বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের অন্যূন ২১টি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ১০ মে কিছু পর্যবেক্ষণসহ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। রায়ের কপি এখনও পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি এও বলেছেন, রাষ্ট্রের স্বার্থে এবং জনকল্যাণের বিবেচনায় এ ব্যবস্থাকে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

দেশের রাজনীতিকরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এ সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনার ঝড় চলছে জোরেশোরে, সারাদেশে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এটিকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউ কেউ সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধীরূপে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি এও জানা গেছে, আপিল বিভাগের সব বিচারপতি এ বিষয়ে একমত হতে পারেননি।

সংখ্যাধিক্যের জোরে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। অনেকের আশংকা এ রায় বাংলাদেশে সৃষ্টি করবে এমন সমস্যা, যাতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কেউ কেউ আবার একে স্বাগত জানিয়েছেন। যেসব রাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকার বিদ্যমান, সেসব রাষ্ট্রে সরকার তার কার্যকাল শেষ করলে নতুন সরকার নির্বাচনের সময় সেই সাবেক সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক ধরনের সর্বজনীন ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার হল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ব্যবস্থায় নির্দলীয় মনোনীত দশজন উপদেষ্টা ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না এই অঙ্গীকারে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে থেকে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের কেউ শিক্ষক, কেউবা চিকিৎসক, কেউ সামরিক কর্মকর্তা, কেউবা অন্য পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তি। দুই ব্যবস্থার মিল ও অমিল দুই-ই রয়েছে। মিল হল- উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়করা অনির্বাচিত।

অমিল হচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়করা কোন দলীয় ব্যক্তি নন এবং এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের [২ক পরিচ্ছেদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার] শিরোনামে অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ৫৮ঙ সমন্বয়ে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইনটি গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালের ২৫-২৬ মার্চে, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে। এই সংশোধনী আইন অনুযায়ী ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সপ্তম, অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ সংগঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রায় সর্বমহলে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ১০ মে'র সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের এই রায় নতুনভাবে এ ব্যবস্থাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে ছেড়েছে।

সম্ভবত তাদের যুক্তি, অনির্বাচিত উপদেষ্টারা জাতীয় সংসদ সংগঠনের জন্য নির্বাচন পরিচালনা করবেন কেন? গণতান্ত্রিক সংবিধানের সঙ্গে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ভূমিকা কি সাযুজ্যপূর্ণ? তাই বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্রের শাশ্বত রূপ প্রতিফলনের জন্য এত অতিউৎসাহী উদ্যোগ। বিচারপতিরা, বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সম্মানীয় বিচারপতিদের, বিশেষ করে এবিএম খায়রুল হকের গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রতি এমন শ্রদ্ধা এবং অনুরাগের প্রতি সম্মান জানিয়েও এ প্রসঙ্গে দু'চারটি কথা বলতে চাই। এক. সংবিধান গণতান্ত্রিক হলেই কি যারা গণতন্ত্রকে কার্যকর করবেন তারা রাতারাতি গণতান্ত্রিক হয়ে যাবেন? বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামো তো তৈরি হয়ে গেছে বহু আগেই, কিন্তু সেই কাঠামো কি গণতন্ত্রের প্রাণরসে জারিত হয়েছে? আমাদের রাজনীতিকদের মন কি গণতন্ত্রের রসে সিক্ত হয়েছে? হয়নি। হয়নি যে তা বিচারপতিরাও জানেন। জেনেশুনে তাহলে জাতীয় জীবনে অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকার কেন নামিয়ে আনতে চান? দুই. কোন সমাজের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ রাষ্ট্র বিনির্মাণ করে, রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।

সংবিধান কিন্তু রাষ্ট্র তৈরি করে না। রাষ্ট্রের প্রকৃতিও নির্ধারণ করে না। সংবিধান তৈরি করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি, এমনকি রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তার নির্ধারিত হয় আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এসব ক্ষেত্রে সংবিধানের ভূমিকা গৌণ।

তিন. ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার আগে ত্রয়োদশ সংশোধনী কেন, কিভাবে, কোন পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছিল তার তো বিচারপতিদের জানার কথা। এজন্য কতজন প্রাণ দিয়েছেন, কতজন আহত হয়েছেন, দেশের কত সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে সে খবরও তাদের জানার কথা। ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয় এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। দেশে একটা No government situation তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিষ বিষাক্ত।

তবুও কোন কোন রোগের উপশম ঘটায় বিষ। সেই প্রেক্ষাপটটা আবারও স্মরণ করুন তো! আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেতা। যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপিত হয়, তখন তার ডানপাশে ছিলেন নিজামী সাহেব আর বাঁ পাশে ছিলেন জেনারেল এরশাদ। শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বিএনপি খুব জোর ১০টা আসন পাবে। বিএনপি কিন্তু পেয়েছিল ১৪০টি আসন এবং সরকারও গঠন করে।

শেখ হাসিনার তখনকার উক্তি ছিল, বিএনপি সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। সত্য কথা বলতে গিয়ে ড. কামাল হোসেনকে এরপর গণতান্ত্রিক ফোরাম গঠন করতে হয়েছিল। সেই থেকে যার সূচনা, তারই ফল ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মাঝে রয়েছে অনেক কর্মকাণ্ড। এদেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি দুই দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কাজ কিছুই হয়নি। বিদেশী কূটনীতিক, বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের অন্যূন ২১টি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। উদ্যোগ গ্রহণ করেন কমনওয়েলথ মহাসচিবও। কোন কাজ হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই-ই চাই।

তিনি ফিরে গিয়ে তার প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ানকে পাঠান একটা সমঝোতার জন্য। ৪২ দিন ঢাকায় অবস্থান করেও তিনি কিছু করতে ব্যর্থ হন। যুক্তরাষ্ট্রের রবিন র&zwnj্যাফেল ব্যর্থ হলেন। শুধু ঢাকা নয়, দেশময় শুরু হয় হরতালের মহড়া। ৬ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ১০৬ ঘণ্টা পর্যন্ত হরতাল হয়।

বন্দরগুলো অবরোধ করা হল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হল। শিল্প-কলকারখানার চাকা স্তব্ধ হল। শেষ পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ১৪৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলেন। ১৪৭ জন সদস্যকে বাদ দিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন সম্ভব নয়।

তাই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যতই অসম্পূর্ণ হোক, যতই দুর্নীতিপরায়ণ হোক না কেন, ষষ্ঠ সংসদে গৃহীত হয় ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন। সমগ্র প্রক্রিয়ায় প্রাণ হারান শতাধিক ব্যক্তি। আহত হয়ে পঙ্গু হন প্রায় হাজারখানেক মানুষ। তাদের রক্তে জন্মলাভ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একাংশের ভোটে বিশেষ করে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কলমের এক খোঁচায় একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা ভেস্তে গেল। নতুন কিছু সৃষ্টি হলে জাতি আনন্দিত হতো। শুধু ভেঙে ফেলার উদ্যোগে কেউ কেউ হয়তো খুশি হয়েছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা বড় বেশি নয়। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাতিল করে রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হল তার দায়ভার কে নেবে? প্রকৃত প্রস্তাবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হল গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ।

এজন্য প্রয়োজন হয় অত্যন্ত শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা, স্বাভাবিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, কালো টাকা এবং পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ। আগামীতে নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় সুপ্রিমকোর্ট কি Suo Moto নির্দেশ দিতে পারেন যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বডিগুলোতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দানের সময়, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিযুক্ত হোন, শুধু ক্ষমতাসীনদের অনুগত ও অনুগ্রহভাজনরা নয়। তেমনটি না হলে বিরোধী দলগুলো মানবে কেন? বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কি তা থেকে ভিন্ন কিছু? এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালীনই একবার বলেছিলেন, 'হাত-পা বেঁধে সাঁতার দেয়া সম্ভব নয়'। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান 'হাত-পা বাঁধা' অবস্থার কথা বলেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বহুদিন আগেই বলেছিলেন, এ কমিশন দন্ত-নখরহীন ব্যাঘ্রের মতো।

এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হবে কিভাবে? আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক কি? কালো টাকার আমদানি বন্ধ হবে কিভাবে? পেশিশক্তি ব্যবহারকারী 'বাজিকরদের' কথা এককালের প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখেই উচ্চারিত হয়েছে। উচ্চ এবং মধ্যম পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? ক্ষমতাসীনদের আর এক উচ্চারণ আর এক ধরনের অশনি সঙ্কেত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে আগের সরকারই তা সম্পন্ন করবে। আগের সরকার অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যদি তা চায় তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠান কিছুতেই সম্ভব হবে না এবং যা হওয়ার তাই হবে। দলীয় চণ্ডতার চরম প্রকাশ ঘটবে।

পঁচাত্তরের বাকশালের দিকে দেশ ধাবিত হতে থাকবে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কি তাই চেয়েছেন? এমনি প্রশ্ন কোন কোন মহলে উত্থাপিত হচ্ছে। দেশটা এমনিতেই বিভক্ত। এই বিভক্তি আরও বৃদ্ধি পেলে দেশটার অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে? লগি-বৈঠার প্রাবল্যে দেশটা কি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হবে না? Writer: Dr.Emajuddin Ahmed Former VC,Dhaka University June 2, 2011, 4:54 pm ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.