মেয়েটির নাম মারিয়া, বাড়ি উরুগুয়ে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়, স্বামি ছিল ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। কিছুদিন পর একটি মেয়ে হয় তার। ১৯৭৩ সালে উরুগুয়েতে সেনাবাহিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিল। সারা দেশে শুরু হল ভয়াবহ দমন-পীড়ন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উরুগুয়ে হয়ে উঠল সারা দক্ষিন আমেরিকার অত্যাচার আর নির্যাতনের কেন্দ্র। মারিয়ার স্বামি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল। কিশোরী মারিয়া একদিন গ্রেফতার হল। তার সন্তানকে কেড়ে নিল সেনাবাহিনি। তথাকথিত বিচারে তার ৭৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হল।
অন্ধকার একটি সেলে তার কারাবাস শুরু হল। কখন দিন কখন রাত, কত সময়, কোন দিন- কিছুই জানার উপায় ছিল না। মাঝেমাঝে আশেপাশের সেল থেকে বন্দীদের আর্তচিৎকার ভেসে আসত। খাবার ছিল অতি কুৎসিত, বিস্বাদ। মারিয়া কিছুই খেতে পারত না।
কিন্তু বাধ্য হয়ে কিছুদিন পর থেকে ওই খাবারই খেতে শুরু করল। জেরার সময় সামরিক কর্তারা তাকে নানা ভাবে হুমকি দিতে লাগল। তাদের প্রশ্ন একটাই- তার স্বামি কোথায় লুকিয়ে আছে তা বলতে হবে। মারিয়া কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারল না যে তার স্বামির সরকার বিরোধি কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। তবুও সেনাবাহিনি তাকে ছাড়ল না।
তাদের হুমকি, তার স্বামির খোঁজ না দিলে তার সন্তানের ক্ষতি হবে। একদিন তারা মারিয়াকে বলল, স্বামির খোঁজ না দিলে তারা তার দাঁত তুলে নেবে। এক পর্যায়ে তারা নির্যাতন থামাতে বাধ্য হল- কারণ মারিয়ার মুখে তখন আর কোন দাঁত অবশিষ্ট ছিল না। মারিয়া তার সবগুলো দাঁত হারাল। একদিন ওরা মারিয়াকে হত্যার কথা বলল।
মারিয়া বন্দুক তৈরি করার আওয়াজ শুনল। এ সময় একজন রক্ষি বলল 'খাওয়ার সময় হয়ে গেছে,গুলিটা না হয় খাওয়ার পর এসেই করব'। ক্লান্ত-অবসন্ন মারিয়া একদিন সেলে বসে ছিল। এ সময় এক কারারক্ষী এসে তাকে একটি পোস্টকার্ড দিল। মারিয়া সেটা খুলে দেখল তাতে লেখা আছে 'মারিয়া তোমার কথা ভাবছি- মার্গারেট, স্কটল্যান্ড'।
মারিয়া বলল, 'এটা ভুল ঠিকানায় এসেছে। আমি স্কটল্যান্ডের কোন মার্গারেটকে চিনি না। ' কিছুদিন পর একইরকম আরও চিঠি আসতে লাগল কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে। প্রতিটি চিঠিতে একই লেখা-'মারিয়া তোমার কথা ভাবছি'। সবগুলো চিঠিতে একটিই প্রতীক- কাঁটাতার দিয়ে জড়ানো একটি মোমবাতি।
আর যে সংগঠনটির খামে চিঠিগুলোও এসেছিলো তার নাম Amnesty International । মারিয়া এমন কোন সংগঠনের নাম আগে শোনেনি। মারিয়া জানতে চাইল তার আরও কোন চিঠি এসেছে কি না। কারা কর্তৃপক্ষ জানালো, 'সবগুলো চিঠি এখন দিতে পারছি না, শুধু আজকে আসা চিঠিগুলো নিয়ে যাও। ' তারা মারিয়াকে প্রায় ৯০০ টি চিঠি দিল।
চিঠিগুলো পড়ে মারিয়া বুঝতে পারল তার অজান্তেই সে সারা পৃথিবীতে এক অভুতপুর্ব আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। কারা কর্মকর্তা তাকে ডেকে একদিন বললেন, 'তুমি আমাদের জন্য বিশাল ঝামেলায় পরিনত হয়েছ। আমরা ঠিক করেছি তোমাকে ছেড়ে দেব। তাহলে এই চিঠির বোঝা থেকে আমরা মুক্তি পাব। যাওয়ার সময় এই চিঠিগুলো নিয়ে যেও'।
এই বলে তাকে ৪-৫ টি বড় বড় বস্তা দেখিয়ে দিল। অবশেষে ১ বছর কারাবাসের পর মারিয়া মুক্তি পেল। সেনারা তাকে আর্জেন্টিনাগামি একটি নৌকায় তুলে দিল। সেখানে সে দিশেহারাভাবে সে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ একদিন একটি বাড়ির উপর খুব পরিচিত একটি প্রতীক দেখতে পেল।
তারকাটা দিয়ে জড়ানো মোমবাতি-Amnesty International এর প্রতীক, যারা তাকে কারাজীবনে সাহস জুগিয়ে এসেছে। মারিয়া অফিসে গিয়ে তার পরিচয় জানালো। তাদের মাধ্যমে মারিয়া লন্ডনে আশ্রয় পেল। ফিরে পেল নিজের মেয়েকে। সে এখন স্বাধীন, আবার বিয়ে করে মারিয়া গিলেস্পি উত্তর ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
এ তো একজন মাত্র মারিয়ার কথা বললাম। এরকম আরও মারিয়াকে সারা পৃথিবীজুড়ে হতে হচ্ছে সরকারি পুলিশ বা সেনাবাহিনির অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতনের স্বীকার। তাদের সবার জন্য Amnesty International একটি ছায়াস্বরূপ। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই Peter Benenson ( http://en.wikipedia.org/wiki/Peter_Benenson ) কে, যিনি ২ জন পর্তুগিজ ছাত্রকে সাহায্য করতে গিয়ে এই মহান সংগঠনের জন্ম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠের ভেতর বন্দীদের মাঝে আলোর রেখা দেখাতে চাই আমরা'।
Amnesty, আরও বেগবান হোক তোমার আলোর পথে জয়যাত্রা। ৫০ তম জন্মদিনে বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত জনগনের পক্ষ হতে শুভেচ্ছা তোমাকে।
[সুত্রঃ বিবিসি বাংলা] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।