একটি শিশু জন্মাল; একটি শিশু মরে গেল। একজন রাজপুত্র, অন্যজন হতভাগ্য। একজন রাজবধূ, অন্যজন দরজির বউ। একজন রাজরানি, অন্যজন ঘুঁটেকুড়ানি। একজনের ঠাটবাটের খরচ জোগায় রাষ্ট্র; অন্যজন অভাবের জ্বালায় আত্মঘাতী মায়ের হাতে মরে যায়।
অঙ্কের হিসাবে এক থেকে এক বাদ গেলে শূন্য থাকার কথা। কিন্তু সব শিশু তো সমান না। পৃথিবীতে প্রতিদিন মরে যাওয়া ২৫ হাজার শিশুর (পাঁচ বছরের কম বয়সী) চেয়েও দামি একটি শিশুর জন্ম। পৃথিবীতে প্রতিদিন মারা যায় তিন লাখ ৩৭ হাজার শিশু। এই ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দেয় না।
কিন্তু ব্রিটিশ রাজপুত্রের জন্মসংবাদে বিশ্বব্যাপী মাতোয়ারা লেগে যায়। পুরাকালে মহাপুরুষের জন্মদৃশ্যে ডানাঅলা দেবদূতেরা দেখা দিতেন, আর এখন রাজশিশুর জন্মসঙ্গী হন টেলিভিশন ক্যামেরাঅলা সাংবাদিকেরা। শিশুটি জন্মাবে বলে আমাদের জানতে হয় একটি বিদেশি পরিবারের পারিবারিক খুঁটিনাটি। শিশুটি জন্মাবে বলে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানেরা অগ্রিম শুভেচ্ছা বাণী লিখে রাখেন। কারণ, শিশুটি হবু রাজা।
সেই হবু রাজার বাবু প্রজারা বিছানাপত্র নিয়ে অভিজাত হাসপাতালটির সামনে রাত জাগে।
আর ওদিকে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম আলিয়ারায় দুই ভাই নীরবে মরে যায়। শিশুপুত্রদের পানিতে ফেলে মা-ও ঝাঁপ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের দোষে বা গুণে তিনি বেঁচে যান। কী অদ্ভুত এক পৃথিবী! আলিয়ারার রোমেনা আক্তারও মা, ব্রিটিশ রাজবধূ কেট মিডলটনও মা। ভবিষ্যতে ব্রিটেনের সম্রাট হবে কেট মিডলটনের ছেলেটি, অথচ কিনা গ্রামীণ নারী রোমেনা আক্তার তাঁর আদরের সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘সম্রাট’।
তাঁর আরেক সন্তানের নামও ছিল রাজকীয়: তাজিন, যার অর্থ সম্মানিত। ছেলে দুটি আর নেই। সন্তান হত্যার জন্য রোমেনা আক্তারকেই সবাই দুষবে, দারিদ্র্যকে কেউ অভিযোগ করবে না।
ব্রিটেনের এই শিশুর পূর্বসূরি সাতজন রাজা ভারতবর্ষের ওপর, সেই সূত্রে আমাদের ওপরও রাজত্ব করে গেছেন। ব্রিটেনের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে বছর বিয়ে করেন, সেই বছর ভারতবর্ষ দুই টুকরা হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়।
তখনো কমনওয়েলথ সূত্রে ব্রিটেনের রানি আজাদ পাকিস্তানেরও রানি। রানি এলিজাবেথের বিয়ের চার বছর আগে কুখ্যাত তেতাল্লিশের (১৯৪৩) মন্বন্তরে অবিভক্ত বাংলায় ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়—যার অধিকাংশই ছিল পূর্ব বাংলার। ইংরেজ শাসনে আরও একবার দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। ইতিহাসে সেই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিসেবে পরিচিত। ১৭৬৯-৭০ সালের সেই দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় এক কোটি বাঙালি।
বাংলাদেশের প্রতি তিনজনের একজন সে সময় না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল। বাংলার বস্ত্রশিল্পের সাফল্যের নায়ক তাঁতি সমাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপীয়দের মধ্যে কার্ল মার্ক্স সেই দুর্ভিক্ষ স্মরণে লিখেছিলেন, বাংলার শ্যামল প্রান্তর মানুষের হাড়ে শ্বেতশুভ্র হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটেনের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির অন্তিম শিকার হিসেবে দেশভাগের দাঙ্গায় নিহত হয় আরও পাঁচ লাখ মানুষ। এর সবই ঘটেছিল বর্তমানে ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ রাজপরিবারের অভিভাবকত্বে।
কত সহজেই আমরা ভুলে যাই।
সাংবিধানিকভাবে ব্রিটেন সংসদীয় পদ্ধতিতে শাসিত হলেও ব্রিটিশ রাজা-রানিই রাষ্ট্রপ্রধান। সুতরাং আড়াই শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অনাচারের দায় ব্রিটিশ রানি এড়াতে পারেন না। অথচ সেসব ভুলে আজও আমাদের অনেক বাদামি চামড়ার সাহেব ব্রিটেনের নামে জয়ধ্বনি দেন। বাস্তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অস্তমিত হলেও তাঁদের মনে ব্রিটিশ সূর্য এখনো মধ্যগগনে।
ব্রিটিশ রাজপুত্রের জন্মের অছিলায় সেটা আবারও প্রকাশিত হয়ে পড়ল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।