আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতিসত্তার বিকাশে ন্যায়বিচারের ভূমিকা

জাতিসত্তার বিকাশে ন্যায়বিচারের ভূমিকা ফকির ইলিয়াস ========================================== কিছু কিছু কথা আমাদের কানে বাজে। বুকে লাগে। জাতি কোথায় যাচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে গোটা জাতিসত্তার বিবেক। এমন কিছু উষ্মা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, বিচার বিভাগ হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতোই স্বাধীনতা পেয়েছে।

গেলো ১৪ মে শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে বিচারপতিদের জন্য বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রীর কড়া সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘মাননীয় আইনমন্ত্রী, আগে আপনার ঘর সামাল দেন। আপনার দায়িত্ব আগে পালন করেন। বিচারকরা অবশ্যই তাদের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। ’ এর আগে ওই অনুষ্ঠানেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ কড়া সমালোচনা করেন। প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তুলে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের জজ সাহেবদের গাড়ি নেই, রাস্তার মধ্যে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়, গাড়ি ঠেলতেও হয়- এটা কি আইনমন্ত্রী জানেন? তিনি আরো বলেন, যারা এসিরুমে বসে কাজ করেন, তারা বিচারকদের এ কষ্ট বুঝতে পারবেন না।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গাউন গায়ে তাদের কাজ করতে হয়। চার ম্যাজিস্ট্রেটকে এক কক্ষে বসতে হয়। চার ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। বিচারকাজ পরিচালনায় চার ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি আদালত ব্যবহার করতে হয় জানিয়ে প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, এর জবাব কে দেবে? তিনি আরো বলেন, ‘আইনমন্ত্রী অনেক কথাই বললেন, কিন্তু আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকা ৩ লাখ ৫৫ হাজার মামলা থেকে কমিয়ে ২ লাখ ৯১ হাজারে নামিয়ে আনলাম, সে কথা তো তিনি বললেন না। ’ প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘আইনমন্ত্রী কি জানেন আমাদের বইপত্রের অপ্রতুলতার কথা? আমি কতো কষ্ট করে সমাধান করেছি?’ একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ-এর আগে বিচার বিভাগের কাজ ও আদালতে মামলার জট নিয়ে বিচার বিভাগের কড়া সমালোচনা করেছেন।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও জনগণের দুর্ভোগ নিরসনে বিচার বিভাগ আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে আমার জানা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচারব্যবস্থা অচিরেই ভেঙে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আইনমন্ত্রী আরো বলেন, বিচারকরা ঢাকায় চলে আসার জন্য বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছুটি কাটিয়ে তারা রোববার ফিরে গিয়ে দুপুর ১২টার আগে বিচারকাজ শুরু করতে পারেন না।

সময় মতো কাজটি করলে প্রতিদিনই একজন বিচারক কমপক্ষে এক ডজন মামলার বিচার সম্পন্ন করতে পারতেন। তিনি নিম্ন আদালতের বিচারকদের সমালোচনা করে আরো বলেন, তারা কেবল চাকরি করেন, জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে তাদের কোনো মন নেই। সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে কিছু করেছেন বলে আমার জানা নেই। আইনমন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারকরা নিয়মিত আদালতগুলো পরিদর্শন না করে বছরে দু’একবার সেখানে যান। গেলে ভালো খাওয়া-দাওয়া হয়।

গিফট দেয়া হয়। মামলা নিয়ে ভাবার সময়ও বিচারকদের নেই বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী। সমন জারি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, তিন মাসেও সমন জারি করা হয় না। আমরা বলবো, এক সপ্তাহের মধ্যে সমন জারি করতে হবে। সময় জারির পর দুই মাসের মধ্যে তার নিষ্পত্তি করতে হবে।

অনেক মামলা যেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল নয়, আইনও তেমন জটিল নয়, সে ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা নেয়ারও চিন্তা করা হচ্ছে। দেশের আইন বিষয়ক এই প্রধান দুই ব্যক্তিত্বের বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য আমাদেরকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তারা দুজনে যা বলেছেন, এর বাস্তবতা দেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানেন। বাংলাদেশ সেই দেশ, যে দেশে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের আসামিরা পার পেয়ে যায়। কারণ ডিএনএ বা আরো আধুনিক ব্যবস্থায় প্রমাণের যথেষ্ট সাপোর্ট দানে রাষ্ট্রপক্ষ আগে যেমন দুর্বল ছিল, এই একবিংশ শতাব্দীতেও তেমনি দুর্বল।

এর উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। কেন হয়নি? কেন এখনো বিচারকদের প্রয়োজনীয় যানবাহন নেই? কেন সামাজিকভাবে মানুষ যথেষ্ট নিরাপত্তা পাচ্ছে না? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর আজকের প্রজন্মকে ক্রমশঃ আঁধারের দিকেই ধাবিত করছে। আইন সকল মানুষের জন্য সমান। সম্প্রতি একটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা আবার দেখিয়ে দিয়েছে। ভারত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ভারতের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।

প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সরকার জমি অধিগ্রহণের সময় কৃষকদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উত্তর প্রদেশ পুলিশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৫১ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় উত্তর প্রদেশ রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান রিতা বহুগুনা, কংগ্রেস নেতা দিগি¦জয় সিং, রাজ বাব্বরকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উল্লেখ্য, উত্তর প্রদেশে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই কৃষকরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। তাদের পক্ষে অবস্থান নিতেই রাহুল গান্ধী সেখানে গিয়েছিলেন।

আমরা দেখলাম, সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে পুলিশ গ্রেপ্তারের পর সোনিয়া গান্ধী রাজপথে নেমে আসেননি। তার দলের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও প্রভাব খাটাবার চেষ্টা করেননি। তারা আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা প্রতিবেশী দেশটির এই গণতান্ত্রিক আইনি শাসনব্যবস্থা থেকে সামান্য শিক্ষাও কি নিতে পারেন না? দুই. স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ই বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।

এরশাদের সামরিক শাসনের সময় একটি হত্যা মামলায় সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক আহমেদের রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। রায়ে আপিল বিভাগ এরশাদের শাসনামলের ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সব সামরিক ফরমান, আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবে ওই সময়কালের কিছু বিষয় শর্তসাপেক্ষে মার্জনা করা হয়েছে। বহাল রাখা হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষে করা সব চুক্তি। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী নিয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তা বহাল রাখা হলো।

সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ-১৯ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হলো। সপ্তম সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রোধ করার জন্য সংসদ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর শাস্তি নির্ধারণ করতে পারবে। ’ হাইকোর্ট আরো বলেছিল - ‘খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা'দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। তার এ কাজকে মার্জনা করা যেতে পারে না। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এরশাদ তার দায় এড়াতে পারেন না।

’ এদিকে সাম্প্রতিককালের সবগুলো রায়কে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করছে সংসদীয় বিশেষ কমিটি। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় দেয়ার পর কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে যেসব জাজমেন্ট এসেছে, সব বিষয় কমিটি পর্যালোচনা করবে। ’ তিনি বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে আদালত যেদিন রায় দিয়েছেন, সেদিনই সপ্তম সংশোধনীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। একটি সামরিক শাসন অবৈধ হবে, আরেকটি বৈধ থাকবে, তা হয় না।

’ এদিকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, এরশাদ যেহেতু মহাজোটের শরিক, তাই তার বিষয়ে সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সেটি দেখার অপেক্ষায় আছেন। সব মিলিয়ে বিচার বিভাগের এই পথচলা গোটা রাষ্ট্রে একটি কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে তা এখন মানুষের মুখে মুখে প্রশ্ন। যে কথাটি মনে রাখা দরকার, আইন মানুষের কল্যাণের জন্য। আইনকানুনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেয়া যায় না।

বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিকই মাঝে মাঝে বলেন- প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও বিচার বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের মাপকাঠি হবে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা। আমরা তাদের মুখে আরো শুনি, রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন নিরঙ্কুশ করার জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে হবে। এই যে সুমধুর বুলি, যারা ক্ষমতায় যান তারা তা খুব সহজেই ভুলে যান।

এটা জাতির জন্য, জাতির নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য দুঃখজনক। এই অবস্থার জারুরি পরিবর্তন দরকার। এই বলয় থেকে দলগুলোকে বেরিয়ে আসা দরকার। সমাজ বিনির্মাণে আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বিশ্বব্যাপী একটি চলমান প্রথা। বাংলাদেশের মানুষ চান, বাংলাদেশেও সেটা হোক জনস্বার্থে।

অবশ্যই দলীয় স্বার্থে নয়। -------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২১ মে ২০১১ শনিবার প্রকাশিত ছবি- টমাস টমাস ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.