প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হয়েছিল মাতৃভাষার দাবী ...
ভারতের উত্তর পূবাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের দুটি প্রধান উপত্যকা, একটি ব্রহ্মপুত্র অপরটি বরাক। পার্বত্য কাছাড়, কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ এই চারটি জেলা নিয়েই আসামের বরাক উপত্যকা। আর এই বরাক উপত্যকার নীচেই বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকা। উভয় উপত্যকার এক নির্ভীক প্রান্তিক জাতি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। ভারতে আসাম রাজ্যের কাছাড়, পাথারকান্দি, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ , ত্রিপুরা রাজ্য এবং মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সংখ্যাধিক্য।
বাংলাদেশে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের অধিক বসতি দেখা যায়, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ছাড়াও দেশের অনেক জায়গাতেই নানান প্রয়োজনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগণ নিজেদের ঐতিহাসিক আবাস গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এবং মৈতৈ মণিপুরী ( মৈতৈদের ভেতর যারা ইসলাম ধর্ম পালন করেন তাদেরকে পাঙন/পাঙান বলা হচ্ছে) এই দুই ভিন্ন জাতিকে বরাবর রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজে ‘মণিপুরী’ হিসেবে দেখানো হয়। ভারতের মণিপুরসহ উভয় উপত্যকায় বরাবর একটি আন্ত:জাতিগত দ্বন্দ্ব আছে কে মণিপুরী আর কে মণিপুরী নয় তা নিয়ে। উভয় রাষ্ট্রের উভয় উপত্যকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম বরাবর এই আন্তঃজাতিগত দ্বন্দ্ব থেকে নানান ফায়সালা নিতে চায়। আর তা হচ্ছে কৌশলে ভাষিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা না দেয়া।
ভারতের মণিপুর অঞ্চলেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতিদের ঠার বা ভাষার উদ্ভব। স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন ‘লিংগুস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ পুস্তকের ৫নং খন্ডে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ‘বিষ্ণুপুরীয়া মণিপুরী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ভাষিক সংখ্যালঘু জাতির সদস্যরা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা লাভের জন্য নিজের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করার মৌলিক অধিকার রাখে। রাষ্ট্রে প্রান্তিক জাতিদের কোনো জনমিতি, পরিসংখ্যান, তথ্য উপাত্ত জনগণের দলিল হিসেবে রাখা হয় না। যাও থাকে তার প্রায় পুরোটাই লোকদেখানো ও বানোয়াট।
বাংলাদেশে যেমন ১৯৯১ কি ২০০১ সালের সকল আদমশুমারীতেই দেশের বাঙালি বাদে অপরাপর জাতিদের জনসংখ্যা বাড়ে কমেনি সেরকম ভারতেও। ১৯৬১ সনের ভারতীয় জনপরিসংখ্যানে আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জের পাথারকান্দিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা মাত্র একজন নারী দেখানো হয়, অথচ সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা ছিল ২২,০০০ এরও বেশী। অথচ ঐ একই জায়গার জনসংখ্যা ১৯৭১ সালে দেখানো হয়েছে ১০,১৬৪ জন। রাষ্ট্রের এই জনপরিসংখ্যানিক দলিল থেকে আমরা ধারণা করতে পারি প্রান্তিক জাতি বিষয়ে রাষ্ট্র কি ধরনের মনোযোগ ও উদ্যোগ বহাল রাখে। আর তা বরাক কিংবা সুরমা উপত্যকা যাই হোক না কেন।
বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে ভাষার লড়াই, জাতিগত অস্তিত্বের সংকট এবং রাষ্ট্রের আইনগত সিদ্ধান্তগ্রহণে কার্যকরী উৎসাহ ও ইশারা দিতে পারে।
বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জী (১৯৫৫-১৯৯৬)
১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার’ ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষন, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন।
সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়।
১৯৬৫ সালের ২-৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষৎ করেন এবং তাকে আসামে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই দাবী সপ্তাহ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোড়দার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্সমন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারো আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে।
১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ(৫-২৯ অক্টোবর,১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এই পয়লা কোনো নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পয়লা নভেম্বর’ ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১-৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪-৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হয় ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১-১৩ নভেম্বর ১৯৬৯ তারিখে শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ওএসএ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে’ ব্যাপক ধরপাকড়টি হয় প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে।
১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া’ শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।
১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯-৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশণ, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ কাছাড়ের সর্বত্র ৭২ ঘন্টার গণঅনশণ পালন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস’ পালন করা হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট।
১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের’ ভেতর একটি বৈঠক হয়। ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ এবং ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ যৌথভাবে অবিলম্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে স্বীকৃতির দেয়ার বিষয়ে পদপে নেয়ার জন্য আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার কাছে মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কেবলই সিদ্ধান্তই থেকে যায় এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না।
১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ঠার ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা ও দাবীসমূহ নিয়ে প্রকাশিত দলিল (Let history and facts speak about Manipuris) আকারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাাৎ করে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয় না। আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই ‘ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ দাবীদিবস পালন করে।
১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় জাপিরবন্দ-সোনাপুরে জনসভা ও রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে ছাএ ইউনিয়ন। আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ মিছিল করে ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নলিনী সিংহ, নির্মল সিংহ, কৃপাময় সিংহ, সুরচন্দ্র সিংহদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ১২ ঘন্টা ‘রেল রোকো কর্মসূচি’ পালন করে। ১৯৮৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর বিধান সভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রিলে অনশন পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা স্থগিত করে।
১৯৯০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলে এল.পি স্কুলের কাশ বয়কট করা হয়।
১৯৯১ সালের সালের ২৬ জানুয়ারি রাজকুমার অনিলকৃষ্ণ মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং সুরচন্দ্র সিংহ সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ৬,১০,১৯ আগস্ট শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ জেলার ডিআই অফিসে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। লড়াকু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়।
কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো দ্রোহী হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ ও কুলচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৯৯২ সালের পয়লা নভেম্বর আন্দোলনকারীরা জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর ৩৬ ঘন্টার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আহবান করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহবান করেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। রাষ্ট্রীয় বৈঠকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আন্দোলনকারীরা পুনরায় ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি হতে ৪৮ ঘন্টার সড়ক অবরোধ শুরু হয়। আসামে বিধানসভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ ৩৬ ঘন্টার গণঅনশণ কর্মষূচি পালিত হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১০১ ঘন্টার রেল রোকো কর্মসূচি আরম্ভ হয় ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল হতে বুরুঙ্গা, কাটাখাল, পাথারকান্দি এলাকায়। এই কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকায় রেল চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল।
এই রেল রোকো কর্মসূচির ফলে অনেক সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির তিন জেলার ডিআই এবং ডিইইও অফিসে ১২ ঘন্টা পিকেটিং করা হয় এবং এর ফলে শিক্ষা বিভাগের অফিস পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে(মূলত: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত এলাকায়) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকা আসাম রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকার তখনও গড়িমসি ভাবই বজায় রেখেছিল।
দুনিয়ার পয়লা আদিবাসী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ ( ১৯৬৪-১৯৯৬)
আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৬ মার্চ একটি রক্তক্ষয়ী দিন। আন্দোরনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে জান দেন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসকে আর উপক্ষা করতে পারে না আসাম রাজ্য সরকার।
আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক ‘কনাক পাঠ’ তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মৈতৈ মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিতর্কের একধরনের স্থিতি ঘটে। ভাষা বিদ্রোহীদের দাবী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এলাকার জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সকল এলাকাতেই চালু করার।
তাছাড়া এখনও স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষকেরা পড়ানোর দায়িত্ব পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশে কি সকল জাতির সকল ভাষা সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাবে ?
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আপন মাতৃভাষা 'ইমার ঠার' ভাষার লাগি দীর্ঘদিনের যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের প্রতি আমাদেরও মনোযোগ রাখা জরুরী। কারন বাংলাদেশের বাঙালিরাও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মতন দুনিয়ার একমাত্র জাতি যারা আপন মাতৃভাষার লাগি জান দিয়েছেন, বুকের রক্ত ঝরিয়েছেন। দুনিয়ার আর কোনো ভাষার জন্য তো রক্ত ঝরেনি এত। জাতিসংঘ বাঙালির আন্দোলনের বিষয়কে স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
২০০০ সালে দুনিয়ার ১৮৮ টি দেশ ২১ ফ্রেুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ তৈরী হয়েছে দুনিয়ার সকলের মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিষয়ে এখনও কার্যকরী রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরী হয়নি। বলা হয়ে থাকে দুনিয়ায় চলতি সময়ে সাত হাজারেরও বেশী ভাষা আছে যার অর্ধেকেরও বেশী ভাষা বিলুপ্তির পথে। দুনিয়ার ৩০ কোটি প্রান্তিক জাতিদের ভেতর বাংলাদেশের বাঙালি বাদে অপরাপর ৪৫ বা তারও বেশী প্রান্তিক জাতির ৩০ লাখ মানুষের মাতৃভাষাও আজ এই বাঙালি বলপ্রয়োগকারী কর্পোরেট পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চরম চরম নিরাপত্তাহীনতা এবং বিলুপ্তির পথে।
বাংলাদেশের সকল জনগণের রাষ্ট্রের সংবিধান কেবলমাত্র বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রের একমাত্র সাংবিধানিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি একুশের মহান রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মনস্তত্ত্বের সাথে সম্পূর্ণই বেমানান। ২১ ফেব্রুয়ারি যদি আজ আন্তর্জাতিকভাবে সকলের মাতৃভাষার অধিকারের দাবীর প্রসঙ্গ তুলতে পারে তবে যে রাষ্ট্রে এই দ্রোহের জন্ম হয়েছে সেই রাষ্ট্রই কেন আজ রাষ্ট্রের অপরাপর জাতির মাতৃভাষাকে গুরুত্ব, মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে নারাজ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন আমাদের নতুন করে মাতৃভাষার অধিকারের জায়গায় কোনো পদপে নেতে উৎসাহিত করতে পারে। বাঙলা এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, দুনিয়ায় এই দুটি ভাষার জন্যই কেবলমাত্র জনগণের লড়াই করতে হয়েছে, বুকের রক্ত ঝরাতে হয়েছে।
যার সাথে দেশ হেসেবে বাংলাদেশেরও সম্পর্ক কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশেও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ আছেন। সুদেষ্ণা সিংহ’র দ্রোহ এই পঞ্চাশ হাজারের ভেতরও আছে। দেশের সকল ভাষিক সংখ্যালঘু প্রান্তিক জাতির সকলের ভেতরেই আছে। রাষ্ট্রকে জনগণের দ্রোহ ও দাবীকে স্বীকার করতে হবে।
তা না হলে বারবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯ মে, ১৬ মার্চ ঘটতেই থাকবে বরাক বা সুরমা উপত্যকায়। কারন প্রাণ তার আপন দ্রোহে ছিন্ন করবেই সকল অন্যায্য উপনিবেশিক বলপ্রয়োগের শাসন।
ঋণ স্বীকার : ১৯৯৫ সালে পয়লা আমার এক মাসীর কাছ থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলনের খবর জানতে পারি, বাংলাদেশ থেকে তাদেরকে একসময় আসামের হাইলাকান্দি চলে যেতে হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের প্রতি আমরা পারিবারিকভাবে সমর্থন জানাই। পয়লাই আমি এই চলতি লেখাটির জন্য ভীষণ ভাবে ঋণী কমলগঞ্জ উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কাছে যারা এই লেখার প্রান।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার দুটি পত্রিকা একটি ‘পৌরি পত্রিকা (জানুয়ারি-মার্চ/২০০৬) এবং ওয়েবসাইট http://manipuri.freeservers.com সহ আসাম থেকে প্রকাশিত বেশকিছু দৈনিক আমার লেখাটিকে গতিশীল করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে আসামের কাছাড় জেলার হেডকোয়ার্টার শিলচরের মাতৃমন্দিরে যেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ’র স্মারকস্তম্ভ ও ভাস্কর্য নির্মান করা হয়েছে সেখানেই দিনভর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ এবং প্রতিশ্রুতি মহিলা কল্যাণ সমিতির সুখদা সিনহাদের সাথে আলাপ এই লেখাটির শিরা-উপশিরাগুলোকে আরো সাহসী করেছে। *মণিপুরী থিয়েটারর পত্রিকা থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত।
...............................................................................................
লেখকঃ পাভেল পার্থ । গবেষক, জনউদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।