আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানবতাবাদ রক্ষায় রাষ্ট্রের সংবিধান

মানবতাবাদ রক্ষায় রাষ্ট্রের সংবিধান ফকির ইলিয়াস ================================ বাংলাদেশের সংবিধান কী হবে তা না ভেবেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেলেন আপামর মানুষ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মনিপুরি, হাজং, গারো, সাঁওতাল সবার লক্ষ্য ছিল একটি পতাকা। একটি দেশ। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৭২ সালে। সেই সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।

’ মূলনীতি ছিল- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ। শুরুতেই ধর্মনিরপেক্ষতা ইস্যুটিকে মেনে নিতে পারেনি পাক তমদ্দুনপন্থী একটি মহল। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর মুসলিম লীগের সেই পাকপন্থীরা সামরিক ব্যারাকের ছায়ায় সমবেত হয় ধর্মের লেবাসেই। পরাজিত রাজাকার শক্তিরাও রাজনীতির মওকা পায়। এরা তাদের মনমতো নানা সংশোধনী আনতে সামরিক শাসকদের প্ররোচিত করে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে দেশে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির কোনো বিধান ছিল না। ১৯৭৩ সালে ‘দ্বিতীয় সংশোধনী’ আকারে এই অপশক্তির বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা এ যাবৎকাল শাসকশ্রেণীর সকল সরকার সযত্নে সংরক্ষণ করে এসেছে এবং নিজেদের মতো ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে যতোগুলো গণবিরোধী বিধান রয়েছে, জরুরি অবস্থা জারির বিধান তাদের মধ্যে অন্যতম। কারণ, সংবিধান তার ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিকদের যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে, ‘জরুরি অবস্থা’ জারির বিধানের মাধ্যমে তা আবার কিছুকালের জন্য স্থগিত করার অর্থাৎ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সংবিধান তার ৩৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিকদের ‘বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার’ স্বাধীনতাসহ ‘বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশের’ অধিকার মঞ্জুর করেছে।

অনুচ্ছেদ ৩৭ সব নাগরিককে ‘শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার’ নিশ্চিত করেছে। অনুচ্ছেদ ৩৮ সব নাগরিককে ‘সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার’ দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান তার ৩৯ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিকদের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’, ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করেছে। অনুচ্ছেদ ৪০ নাগরিকদের ‘যে কোনো আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যে কোনো আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনার অধিকার’ মঞ্জুর করেছে। এবং অনুচ্ছেদ ৪২ প্রত্যেক নাগরিককে ‘সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করার’ অধিকার নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই, এই বিধানগুলো কী রাষ্ট্রের মানুষ ঠিকমতো ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন? না, পাচ্ছেন না। এবার আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের নিরঙ্কুশ পৃথককরণ। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও তার বাস্তবায়ন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে ধর্মভারাক্রান্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে রীতিমতো একটি ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে।

এদের সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই বহুবার ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির সঙ্গে নানান মাত্রায় আপস-মীমাংসা করেছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল কৃত ‘আওয়ামী লীগ-খেলাফত মজলিস চুক্তিনামা’র কথা দেশের মানুষ এখনো ভুলে যাননি। সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী রাজনীতির ধর্মাশ্রয়ী প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রকট রূপ ধারণ করে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান থেকে বিএনপি সংযোজিত ‘বিসমিল্লাহ’ তুলে দেয়া, কিংবা নানান ধর্মাবলম্বী মানুষের বাংলাদেশে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠাদানের জাতীয় পার্টির সেই কর্মটির বিরুদ্ধে শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। অতীতেও এসবের কোনো কার্যকর বিরোধিতা করেনি আওয়ামী লীগ।

বরং রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের পাশে নিয়ে ভোটের সময়ে সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করেছে। তা ছাড়া জাতীয় পার্টি এই সময়ে মহাজোটে ক্ষমতারও অংশীদার। মুখে যাই বলুক না কেন, ভোটের রাজনীতির খাতিরে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রতিষ্ঠা করবে, এমনটি ভাবার কোনো লক্ষণই নেই। দুই. সংবিধান সংশোধন নিয়ে গঠিত কমিটি বিশেষজ্ঞসহ আইনজীবীদের সাথে মত বিনিময় শুরু করেছে। কমিটির বেশ কিছু প্রস্তাবের সাথে একমত হলেও, কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংসদে বিচারপতিদের অভিসংশন এবং তত্ত্ববাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বিশেষ কমিটির খসড়া সুপারিশের বিরোধিতা করেন তারা।

এ ব্যাপারে কমিটির সদস্য আব্দুল মতিন খসরু বলেছেন, আমাদের কোনো সুপারিশই চূড়ান্ত নয়। আমরা এমন মনোভাবও দেখাচ্ছি না যে, আমরা যা সুপারিশ করতে যাচ্ছি তাই বহাল রাখা হবে। অন্যদের পরামর্শ নিয়ে তা বিবেচনা করার জন্যই নজিরবিহীন ঐতিহাসিক এ আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত সব আইনজ্ঞই বিচারপতিদের অভিসংশন ও জবাবদিহি সংসদে রাখার বিরোধিতা করেছেন। সে ক্ষেত্রে কমিটি এ সুপারিশ বাতিল করবে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়টি বিবেচনা করব।

প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার ব্যাপারে দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন। সংসদে বিচারপতিদের অভিসংশনের বিষয়ে তিনি কমিটির সঙ্গে একমত হয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে আব্দুল মতিন খসরু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো মতামত দেননি। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি সংবিধানের একটি ছোট বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ ১৮ আইনজ্ঞকে আলোচনায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেও এসেছিলেন ১৩ জন।

তারা হলেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম, সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল হোসাইন, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, আজমল হোসেন কিউসি, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, এ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ এবং ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। যারা মত দিয়েছেন তাদের কিছু মতামত প্রণিধানযোগ্য। এ ব্যাপারে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, আলোচনায় আমি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলিনি। তবে বলেছি, সংবিধানে কোনো ‘ইজম’ বা ‘মতবাদ’ রাখা ঠিক নয়। কোনো ইজম রাখলে সংবিধান টেকে না।

এতে এটা একজন গ্রহণ করে তো অন্যজন প্রত্যাখ্যান করে। অথচ সংবিধান এমন হওয়া উচিত, যা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। তিনি বলেছেন, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্ন সে দেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম ঢুকিয়েছিলেন। সেই সংবিধান টেকেনি। এ ব্যাপারে ড. কামাল হোসেন বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেন।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ড. এম জহির বলেন, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্র ও সংবিধানের একটাই ধর্ম থাকা উচিত, যা হচ্ছে মানুষের ধর্ম। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম চর্চার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, বিদ্যমান সংবিধানের ২(ক) তে রয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা যাবে। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধান সাক্ষ্য দেয়, জনগণের প্রয়োজনে, সমকালের সাথে পরিশুদ্ধ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংবিধান পরিবর্তন করা যেতেই পারে। কিন্তু যে দেশে ‘জরুরি আইন’ কিংবা ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’-এর মতো কালো আইনগুলো বিদ্যমান, সে দেশে মানবতার কল্যাণকর সংবিধান সংশোধন কতোটা সম্ভব। সংবিধানের ১৪১ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদ এর পরিপন্থী আইন-কানুন রচনা করার অধিকার লাভ করবে এবং ১৪১ (গ) অনুযায়ী রাষ্ট্রের এহেন স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের জন্য কোনো গণতন্ত্রপরায়ণ নাগরিক আদালতে নালিশ জানাতে পারবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র নাগরিকদের কতোগুলো মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, মিছিল-সমাবেশে যোগদানের স্বাধীনতা, সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সম্পত্তি অর্জন ও বর্জনের স্বাধীনতা, পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা হরণ করবে।

অথচ এ ব্যাপারে কোথাও কোনো প্রতিবাদ, এমনকি নালিশ জানানোর অধিকারও রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের থাকবে না। এই যে বিশেষ কালো অধ্যায়, সেগুলো বিষয়ে বাংলাদেশ কী ভাবছে? এখানে আরেকটি বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে। মনে হয়েছে, প্রধান দুই দল কিভাবে ক্ষমতা পাবে-নেবে, তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত । বিশেষজ্ঞরাও সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন। বিদ্যমান সংবিধানে ৫৮(খ) থেকে ৫৮(ঙ) পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

৫৮(গ)(৩)-এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যিনি এ অনুচ্ছেদের অধীন উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। তবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি না পাওয়া গেলে আপীল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বা সেক্ষেত্রে কাউকে না পাওয়া গেলে বিভিন্ন শর্ত অতিক্রম করে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া বা যতোদূর সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাঁদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে। যেভাবে ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতা নিয়েছিলেন। তবে বিশেষ কমিটির সঙ্গে আলোচনায় আইনজ্ঞরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরো প্রক্রিয়া থেকে বিচারকদের বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। অন্য উপদেষ্টাদের মতো প্রধান উপদেষ্টা পদেও উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে বলেছেন তারা।

সেক্ষেত্রে কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে রাজনৈতিক করার পক্ষে মত দেন। এ ব্যাপারে ড. এম জহির বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দলীয় নয়, রাজনৈতিক দলীয় হওয়া উচিত। দলগুলো থেকে আনুপাতিক হারে সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ১০ জন নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া থেকে বিচারকদের দূরে রাখা উচিত। তিনি আরো বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরো সময়টাতে নির্বাচন কমিশনকে সবচেয়ে ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন।

সে সময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন চেয়েছি। সে ক্ষেত্রে আরো ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে এ পদ্ধতি ঠিক করা যেতে পারে। তিন. বাংলাদেশে একটি প্রধান বৈষম্যমূলক সমস্যা হচ্ছে আদিবাসীদের নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার। পার্বত্য এলাকায়ই শুধু নয়, গোটা দেশের আদিবাসীরাই নিগৃহীত হচ্ছেন নানাভাবে।

তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দেশের কিছু কৃতী বুদ্ধিজীবী-লেখকদের উদ্ধৃতি আমি এখানে দিতে চাই। ক. ‘বলতে দ্বিধা নেই, আমরা আমাদের আদিবাসী অসহায় মানুষদের রক্ষা করতে পারিনি। তাদের খুন হতে দিয়েছি। দেশের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে, তারা তাদের অধিকারের কথা জানে না বলে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি।

সারা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ একটি সংস্কৃতি, একটি জীবনধারা, একটি ভাষা নিয়ে তারা ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের আদিবাসীদের রক্ষা করতে হবে। আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, আমাদের দেশের নতুন প্রজন্ম নতুন মানুষ হয়ে জন্ম নেবে। তারা জানবে পৃথিবীর প্রকৃত সৌন্দর্য হচ্ছে বৈচিত্র্যে, আমাদের দেশের হাতেগোনা কিছু আদিবাসী হচ্ছে এই বৈচিত্র্য, এই দেশের সৌন্দর্য। তারা বুক আগলে সেই মানুষদের রক্ষা করবে।

তাদের করুণা করে নয়- তাদের ভালোবেসে, নিজের একজন হিসেবে বিশ্বাস করে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা আর ঐতিহ্য আগ্রহ নিয়ে জানবে, লালন করবে, বড় করবে। যেখানে তাদের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে সেখানে তাদের সুযোগ ফিরিয়ে দেবে, নতুন সুযোগের সৃষ্টি করবে’ (মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ও লেখক, সংহতি, ২০০৬, পৃষ্ঠা-৪৩)। খ. ‘ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক সংস্কৃতি। সংখ্যাগরিষ্ঠদের দায়িত্ব ছিল সমগ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরা।

অথচ আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যদি পরমত সহিষ্ণু হই, অন্যের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে পারি, তাহলেই আমরা একটি সুখী ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারব’ (অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ঢাবি, ধরিত্রী, অষ্টম সংখ্যা, ২০০৫ পৃষ্ঠা-৮)। গ. ‘আজকে অনেক জানতে পেরেছি কীভাবে আদিবাসীরা বাঙালিদের সঙ্গে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাদের সংবিধানে ঠাঁই দেয়া হয়নি। যারা এই সংবিধান রচনা করেছিলেন তারা আদিবাসীদের বঞ্চিত করেছিলেন।

কেননা সেই সংবিধানে বাংলাদেশের সব নাগরিককেই বাঙালি বলা হয়েছিল। সংখ্যায় তারা যেই হোক না কেন সেটা বড় কথা নয় কিন্তু তারা বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, জন্মসূত্রে তারা বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের পূর্ণ নাগরিক সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে’ (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সাবেক উপদেষ্টা, হুল, ৩০ জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা-৩৫)। ঘ. ‘আদিবাসীদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। ইতিহাসকে কখনো পরিবর্তন করা যায় না। পলাশীর যুদ্ধের ফলে যা ঘটেছিল ইচ্ছে করলেই এখন আর ক্লাইভকে জীবিত করে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে না।

ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে’ (সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সংবাদ ০৯.০৮.২০০৯)। ঙ. ‘যে দেশের মানুষ তার মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে রূপান্তরিত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, সেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তার নিজের ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন- তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ দেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাংলা ভাষাভাষী সংখ্যাগুরু বাঙালির ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আদিবাসীরা এ দেশের অংশ। তাদের ভূমির অধিকার ও ভাষার অধিকার আইনগত এবং সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে’ (অধ্যাপক রেহমান সোবহান, যুগান্তর ১০.০৮.২০০৭)।

চার. বাংলাদেশে আরেকটি অন্যতম বিষফোঁড়া হচ্ছে মৌলবাদের বিস্তার। ভাবতে অবাক লাগে, দেশে ফতোয়াবাজরা আইনী বৈধতা চাইছে। এই বাংলাদেশেই অনেক আগে বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরার এক হাইকোর্ট বেঞ্চ সুয়োমোটোভাবে একটি ফতোয়ার মামলা গ্রহণ করে রায় দিয়েছিলেন যে সেই ধরনের ফতোয়া দেয়া নিষিদ্ধ, যা বিচারের রায়ের মতো কার্যকর হবে। তা প্রায় দশ বছর আগে। কিন্তু এই এক দশকে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হয়েছে? ছাতকছড়ার নূরজাহানকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও দেশে এখনো ফতোয়ার দাপট মোটেই কমেনি।

বরং এরা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধেই না না কথা বলছে। হুমকি দিচ্ছে। যা কোনো রাষ্ট্রের জন্য শুভ সংবাদ নয়। যে কথাটি স্পষ্ট বলতে চাই, তা হচ্ছেÑ যদি মানুষের জন্যই সংবিধান হয়, তাহলে সংবিধানে অবশ্যই দেশের আপামর মানুষের ইচ্ছা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।

বাহাত্তরের সংবিধানের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘ঃযে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। ’ সেই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় জাতির জনক কী বলেছিলেন তা আবার পড়া যাক। খসড়া সংবিধান বিল পেশ করার পর গণপরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রায় ৭২ দিন আমাদের এই কমিটির সদস্যরা কাজ করেছেন, চিন্তা করেছেন, আলোচনা করেছেন এবং পৃথিবীর সমস্ত সংবিধান যতোদূর সম্ভব দেখাশুনা করে একটি খসড়া আজ এই গণপরিষদে পেশ করতে পেরেছেন। আজ বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যরা সেই রক্ত লেখা দিয়ে শাসনতন্ত্র দিতে চান। শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না।

শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ তার অর্থ হলো মাঝিবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে। এখানে ফ্রি স্টাইল ডেমোক্রেসি চলতে পারে না। আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে দেশ চলবে।

চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে। ' হ্যাঁ, কথা একটাই মানুষের জন্য সংবিধান। তাই যে কোনো ইতিবাচক সংশোধনকে স্বাগত জানানো সকল নাগরিকেরই নৈতিক দায়িত্ব। ----------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা/ ১৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যা ২০১১ / ১৯ মে ২০১১ বৃহস্পতিবার ছবি- হেইডি ডীন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।