ছবিটি সত্যিই হৃদয়কাড়া, তাই না? দেখতেই কেমন যেন এক স্বর্গীয় ভাল লাগায় মনটা ভরে উঠে। এমন কেউ নেই যে ফুলকে ভালবাসে না। প্রত্যেক শিশুই যেন এক একটি ফুলের প্রতিচ্ছবি। এখন চিন্তা করুন এরকমই অনাগত একটি শিশুকে আপনি হত্যা করছেন, হয় মাতৃজঠরে (যা কিনা একটি শিশুর জন্য পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ স্থান), ছুরি ঢুকিয়ে টুকরো টুকরো করে, মাথা মুচড়িয়ে ভেঙ্গে অথবা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই বিষ দিয়ে বা জ্যান্ত মাটি চাপা দিয়ে। হয়ত আপনি পারবেন না, কিন্তু সভ্য জগতের কিছু মানুষরূপী পশু একাজগুলো নির্বিকারে করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি পপুলেশন রিসার্চের বিখ্যাত জার্নাল Lancet-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রের তথ্যানুযায়ী গত দশ বছরে ভারতে ছয় মিলিয়ন (৬০ লক্ষ) গর্ভজাত কন্যা শিশুকে ইচ্ছামূলকভাবে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মূলে রয়েছে আল্ট্রাসাউন্ড টেকনোলজি, যার মাধ্যমে গর্ভজাত শিশুর লিংগ নির্ধারণ করা যায়। ভারতে ১৮৭১ সালের আদমশুমারীর পর থেকে কন্যাশিশু হত্যার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তবে লিংগ নির্ধারণ প্রযুক্তির কল্যানে ৮০’র দশকের পর থেকে গর্ভজাত কন্যা হত্যাযজ্ঞের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। একই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, গত ৩০ বছরে (১৯৮০-২০১০) ১২ মিলিয়ন (এক কোটি বিশ লক্ষ) গর্ভজাত কন্যাশিশুকে ইচ্ছামূলকভাবে হত্যা করা হয় [১]।
অন্য এক রিপোর্টে বলা হয় ২০০১ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র ভারতেই প্রায় ৫০ মিলিয়ন (পাঁচ কোটি) কন্যাশিশুকে গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয় Missing: 50 million Indian girls [২]। বিশ্বে ভারত ও চীন ইচ্ছামূলকভাবে গর্ভজাত কন্যাশিশু হত্যাযজ্ঞে কু-খ্যাতি অর্জন করেছে। আমেরিকার Princeton ইউনিভার্সিটি’র এক গবেষণাপত্রে দেখা যায় গত ৩০ বছরে চীনে প্রায় ৪০ মিলিয়ন (চার কোটি) কন্যাশিশুকে গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে [৩]।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কন্যাশিশু হত্যা ও সাধারণ গর্ভপাত এক সাথে মিলানো যাবে না। সাধারণ গর্ভপাত হচ্ছে লিংগ নিরপেক্ষ, যেখানে শিশুটি ছেলে বা মেয়ে যে কেউ হতে পারে।
প্রসংগত, Consortium on National Consensus for Medical Abortion-এর তথ্য অনুসারে ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১১ মিলিয়ন গর্ভপাত ঘটে এবং ২০ হাজার গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয় [৪]। যেমন ২০০০ সালে সাত লক্ষের বেশী বৈধ গর্ভপাত হয়। এ সমস্ত গর্ভপাত বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন ধর্ষণ বা বিবাহ বহির্ভূত গর্ভসঞ্চারণের জন্য, অসুস্থতা বা দূর্ঘটনাজনিত কারণও এতে অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশেও এ ধরণের সাধারণ গর্ভপাত ঘটে।
লিংগ নির্ধারণে আধুনিক প্রযুক্তি
সাধারণত ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহ বয়সের গর্ভস্থ শিশুকে আল্ট্রাসাউন্ড বা সনোগ্রাফ প্রযুক্তির মাধ্যমে লিংগ নির্ধারণ করার জন্য বিবেচনা করা হয়[৫]।
তবে বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ১২ সপ্তাহের মধ্যেও লিংগ নির্ধারণ সম্ভব। চীনে প্রস্তুতকৃত সস্তা সনোগ্রাফ মেশিনের সহজ লভ্যতার কারণে ভারতের সব জায়গায় ব্যাঙ-এর ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে লিংগ-নির্ধারণ ক্লিনিক। এমনকি গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত এলাকায় হাতুড়ে ডাক্তাররা যমদূতসদৃশ ফেরিয়াওয়ালার মতন এই ডেথ মেশিন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যদি সন্তানটি কন্যা হয়, তার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে যায় সাথে সাথে। তাছাড়া আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে লিংগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুলের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আল্ট্রাসাউন্ড নেবার সময় যদি ছেলের লিংগ ঠিকভাবে দেখা না যায়, তবে তাকে মেয়ে হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যদিও ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, সব রকমের গর্ভপাতই অপরাধ, মা হয়তো ছেলের আশায় গর্ভপাত করলো; কিন্তু আদতে দেখা গেলো সে ছেলেই ছিল। হায়রে নিষ্ঠুরতার পরিহাস! একেই কি বলে সভ্যতা? একেই বলে মানবতা?
বস্তত, ভারতে কন্যাশিশু হত্যার প্রবনতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। এজন্য আইন করেও এটা রোধ করা যাচ্ছে না। ভারতের ১৯৯৪ সালের Prenatal Diagnostic Techniques (Regulation and Prevention of Misuse)’ আইন অনুযায়ী গর্ভস্থ শিশুর লিংগ প্রকাশ করা বা বলে দেয়া আইনত দন্ডনীয়।
কিন্তু রূঢ বাস্তবতা হচ্ছে আইন শুধুমাত্র খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ। যেমন ২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী লক্ষ লক্ষ ইচ্ছামূলক গর্ভপাতের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও গত ১৩ বছরে মাত্র একজন চিকিৎসককে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে [৬]।
গর্ভপাত কীভাবে ঘটানো হয়?
গর্ভপাত মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্তর্গত। এ প্রক্রিয়ার আদ্যপান্ত ও খুঁটিনাটি বর্ণনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য বহির্ভূত। তবে এর ভয়াবহতা ও নির্মমতা তুলে ধরতে প্রাসংগিকভাবেই এর সাধারণ কিছু অংশ উল্লেখ করা জরুরী।
সাধারণত গর্ভধারণের সাত সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত ঘটাতে চাইলে ঔষধ প্রয়োগে ভ্রূণকে হত্যা করা হয়। তবে এ সময়ে ভ্রূণের লিংগ নির্ধারণ করা যায় না।
গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের পর গর্ভপাত ঘটাতে চাইলে সবচেয়ে বেশী যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে Suction Aspiration. এ পদ্ধতিতে একটি ভ্যাকুয়াম নল মাতৃজঠরে প্রবেশ করানো হয়। প্রসংগত এটি কাজ করে ভ্যাকুয়াম ক্লীনারের মতই, তবে এখানে কমপক্ষে ২৯ গুন বেশী চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই প্রচণ্ড চাপে শিশুটি মুহূর্তের মধ্যেই টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
এ পদ্ধতির সবচেয়ে বীভৎস অংশ হচ্ছে, যেহেতু শিশুটির মাথা অনেক বড় থাকে সেহেতু এটি নলের মাধ্যমে বের করা যায় না। সেজন্য চিমটার মতন একপ্রকার ধাতব যন্ত্র দিয়ে শিশুটির মাথা দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়। আরেকটু বড় শিশুর (গর্ভধারণের ১৮-২০ সপ্তাহের পর) ক্ষেত্রে ভ্যাকুয়াম নল দিয়ে বের করা অত্যন্ত কঠিন গর্ভস্থ ২০ সপ্তাহ বয়সের শিশু দেখতে কেমন এখানে জানা যাবে। তাই আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যার নাম Dilation and Evacuation (D&E)[৭]। এখানে এক জাতীয় চিমটার মাধ্যমে বাচ্চাকে মুচড়ানো হয় এবং জীবন্ত শিশুটির দেহের বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগগুলো টেনে টেনে আলাদা করা হয়।
মাথাটিকেও প্রচন্ড চাপ দিয়ে বিচূর্ণ করা হয়। যতক্ষণ না বাচ্চাটি সম্পূর্ণভাবে টুকরো টূকরো করে সহজে বের করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত বারংবার এই মুচড়ানো ও বিচূর্ণ করার প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। অবশেষে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বিচূর্ণ অংগ-প্রত্যংগ গুলো জড়ো করে মিলানো হয় যে সম্পূর্ণ শিশু বের হয়েছে কিনা। কারণ যদি শিশুর কোন অংগ মাতৃজঠরে রয়ে যায় তবে তা মায়ের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই লিঙ্কে Dilation and Evacuation পদ্ধতির ভিডিও রয়েছে।
বীভৎসতার কারণে ভিডিওটি না দেখার অনুরোধ করছি। তবুও বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াসে এটি যুক্ত করা হলো তাদের জন্য যারা সত্যকে জেনে শিক্ষা নিতে চায়।
গর্ভপাতের আরেকটি অতি সস্তা পদ্ধতি হচ্ছে মাতৃজঠরে লবন বা বিষ প্রয়োগে গর্ভজাত শিশুটিকে ধীরে ধীরে হত্যা করা। পরবর্তীতে শিশুটি মরে যাওয়ার সাধারণত ২৪ ঘন্টার পরে মা মৃত বাচ্চা প্রসব করে। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা মরে না এবং জীবিতই প্রসব হয়।
সেক্ষেত্রে মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়। আরেকটি ব্যয় বহুল পদ্ধতি হলো prostaglandin নামক একটি হরমোনের ব্যবহার, যা সাধারণত গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পরে প্রয়োগ করা হয়। এটির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে প্রসব বেদনা তৈরী করে জীবিত শিশুকে প্রসব করানো হয়। পরে শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সুতরাং কেউ যদি গর্ভস্থ শিশুর লিংগ নির্দিষ্টভাবে জানতে চায় তাহলে শিশুর বয়স অবশ্যই ২০ সপ্তাহের কাছাকাছি হতে হবে।
তার মানে দাঁড়ায় এই যে যদি দূর্ভাগ্যক্রমে শিশুটি কন্যা হয় তাকে গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করতে হলে D&E, Birth abortion (নীচে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে) বা লবন পদ্ধতি সাধারণভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রসংগত, ভারতে গর্ভপাত আইন অনুযায়ী গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত আইনগতভাবে গর্ভপাত ঘটানো যায় (বিস্তারিত তথ্য উপরের ভিডিওতে পাওয়া যাবে ও নীচের বিবিসি’র ডকুমেন্টারীতেও জানা যাবে) [৮]।
গর্ভস্থ কন্যা শিশুটি কি ব্যথা পায়?
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং বিতর্কিত বিষয়ও বটে। গর্ভস্থ শিশুরা ব্যথা পায় কিনা তা এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায়নি [৯]। আদৌ প্রমাণ করা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, কেননা এর সাথে জড়িত রয়েছে রাজনীতি, ব্যবসা ও নারীর অধিকার।
একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে গর্ভস্থ শিশুরা ৬/৭ সপ্তাহ থেকে ব্যথা অনুভব করতে পারে। যেমন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট এবং de Veber Institute for Bioethics and Social Research এর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট Dr. Paul Ranalli এই মত পোষণ করেন [১০]। গর্ভস্থ শিশু ব্যথা পায় কিনা এ ব্যাপারে একটি বিশ্ববিখ্যাত হৃদয়বিদারক ভিডিও রয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে ১২ সপ্তাহের শিশু সাকশন টিউবকে এড়ানোর জন্য কী প্রচণ্ডভাবে ছটফট করে। গর্ভপাত বিশেষজ্ঞ Dr. Bernard Nathanson ভিডিওটি ব্যাখ্যা করেছেন, যিনি বিখ্যাত Center for Reproductive and Sexual Health (CRASH) এর ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি নিজেও সারাজীবনে ৭৫ হাজারেরও বেশী গর্ভপাতের সাথে জড়িত ছিলেন।
তার মতে কোন সন্দেহ নেই যে গর্ভস্থ শিশু ব্যথা পায়। এদের দাবী গর্ভপাতকে নিরুৎসাহিত করে বলে তাদের কন্ঠরোধ করার জন্য এদের গায়ে ধার্মিকের তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়!
কিন্তু অন্যদলের চিকিৎসকদের মতে গর্ভস্থ শিশুরা ব্যথা পায়-ই না, বরং ঘুমিয়ে থাকে! গর্ভপাত ব্যবসা হচ্ছে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাষ্ট্রি [১১] এবং এতে চিকিৎসকরা জড়িত। তাই যারা গর্ভপাতের সাথে জড়িত তারা যেভাবেই হোক এর পক্ষে নৈতিকভাবে অবস্থান নিবে। সুতরাং এর প্রভাব পড়বে গবেষণাতেও। যদি প্রমাণ হয় বা স্বীকার করা হয় যে গর্ভস্থ শিশুরা (২০ সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ে) ব্যথা অনুভব করে তাহলে গর্ভপাত করা বাস্তবিকই কঠিন হবে [১২]।
তখন গর্ভপাত বিরোধী আইন করা খুব সহজ হয়ে যাবে। এতে যারা বিবাহ বহির্ভূত (সহমতের ভিত্তিতে মেলামেশা অথবা ইনসেস্টের কারণে) গর্ভসঞ্চারণের জন্য গর্ভপাত ঘটাতে চায় তাদের সামাজিক সন্মান ও অবস্থান রক্ষা করাও বেশ কষ্টসাধ্য হবে। প্রসংগত, ২০০৭ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে আমেরিকার ৮৪% গর্ভপাতের ঘটনায় অবিবাহিতরা জড়িত এবং ৫০% গর্ভপাতকারীর বয়স ২৫ বছরের নিচে [১৩]। যার ফলে এ গ্রুপটিও নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য গর্ভপাতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘গর্ভস্থ শিশুরা ব্যথা পায় না’ গ্রুপে যোগ দেয়! নারীবাদীরাও জরায়ুর স্বাধীনতার নামে গর্ভপাতের পক্ষে অবস্থান নেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতে এই গ্রুপটি বেশ শক্তিশালী! গর্ভপাতের পক্ষের বা ‘ব্যথা পায় না’ বিশ্বাসীরা ধর্ষণের মাধ্যমে গর্ভসঞ্চারনের ইস্যুটিকে ব্যবহার করে বস্তুত নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রয়াস চালায়, কেননা পশ্চিমা বিশ্বে মূলত ধর্ষিতার মানসিক কষ্টের দিকটি বিবেচনা করেই গর্ভপাতকে আইনগতভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
গর্ভস্থ শিশুদের কান্না শোনা যায় না বলে এ ধারণা করার কোন মানে নেই যে সে ব্যথা পায় না। হায়রে মানবতা! অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস! যেখানে মা ব্যথানাশক (Local anesthesia) নিচ্ছে সেখানে বাচ্চাটি ব্যথায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এটি কি দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের চরম দৃষ্টান্ত নয়? বর্তমানে উন্নত বিশ্বে গবেষণাগারগুলোতে ছোট্ট মাছকেও ব্যবচ্ছেদ করার আগে চেতনানাশক পদ্ধতি ব্যবহার করা বৈজ্ঞানিক নৈতিকতার অন্তর্গত[১৪]। ইঁদুর কিংবা গিনিপিগের কথা বাদ-ই দেয়া হলো। আর সে হচ্ছে নিষ্পাপ ও অসহায় মানব শিশু।
শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ভাবধারা বা জীবন পদ্ধতিকে সমর্থন করতে গিয়ে গর্ভস্থ শিশু ব্যথা পায় কিনা তা নিয়েও বিতর্ক হয় বর্তমান সভ্যজগতে! এবং এটি করা হয় মানবতার নামে! ব্যথা পাক, বা না পাক; গর্ভপাতের মাধ্যমে শিশু হত্যা নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর অপরাধ।
দারিদ্র্য ও অশিক্ষা কি কন্যাশিশু হত্যার জন্য দায়ী?
সব সমাজেই কম-বেশী পুত্র সন্তানের কদর করা হয়। যদি প্রত্যেক পরিবারের জন্য একটি সন্তান বরাদ্দ থাকে, তবে পছন্দ হিসেবে সাধারণত পুত্র সন্তানকেই বেছে নিতে দেখা যায়। তার মানে এই নয় যে গর্ভস্থ কন্যা সন্তানকে হত্যা করা সব সমাজে প্রচলিত আছে। এদিক বিবেচনায়, ভারত ও চীন বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষ স্থান দখল করেছে, কেননা তাদের সমাজে অবলীলায় কন্যাশিশুকে হত্যা করা সামাজিক রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
চীনের গণবিমুখী কম্যুনিষ্ট সরকারের কুখ্যাত ‘পরিবারপিছু এক সন্তান নীতি’ লক্ষ লক্ষ কন্যাশিশুর নৃশংসভাবে হত্যার জন্য দায়ী। অন্যদিকে ভারত হচ্ছে গণতান্ত্রিক দেশ। ভবিষ্যত শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত যেমন বিশ্বে আত্নপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, তেমনিভাবে এই দেশকেই কন্যাশিশু হত্যার বদ্ধভুমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
পূর্বে সমাজ বিজ্ঞানীরা কন্যাশিশু হত্যার মূলে দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করতেন। কিন্তু নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ১৯৯০ সালে তথ্যের মাধ্যমে সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রচলিত এই ভুল ধারণাকে ভেঙ্গে দেন [১৫]।
দারিদ্র্যই যদি কন্যাশিশু হত্যার কারণ হয়, তবে আফ্রিকা মহাদেশের অত্যন্ত দরিদ্র ও দূর্ভিক্ষ পীড়িত দেশগুলোতে কন্যাশিশুর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতায় ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে। আফ্রিকার দেশগুলোতে মেয়ের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং বেশীই। সাম্প্রতিক Lancet-এ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ভারতে ধনাঢ্য বা অবস্থাশালী পরিবারে কন্যাশিশু হত্যার হার আশংকাজনকভাবে বেশী [১]। আরো মজার তথ্য হচ্ছে ভারতে তুলনামূলকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী রাজ্যগুলোয় (যেমন, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা) গর্ভস্থ কন্যাশিশু হত্যার প্রবণতা বেশী পরিলক্ষিত হয়।
হরিয়ানায় নির্বিচারে কন্যাশিশু হত্যার ফলে অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে ছেলে্দের বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। (আরো বিস্তারিত জানতে BBC Documentary: India's Missing Girls Part 2।
একই গবেষণাপত্রের (Lancet) সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে যে, শিক্ষিত সমাজে কন্যাশিশু হত্যার প্রবণতা অনেক বেশী [১]। পূর্বে প্রকাশিত ইউএন-এর ২০০১ সালের সমীক্ষাতেও একই চিত্র ফুটে উঠে। পড়াশুনায় প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণকারী (পঞ্চম শ্রেনী) মেয়েদের মধ্যে কন্যাশিশু গর্ভপাতের হার সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটেদের মধ্যে গর্ভস্থ কন্যাশিশু হত্যার হার সবচেয়ে বেশী [২]। আরো অবাক করা তথ্য হচ্ছে কন্যাশিশু হত্যার প্রবণতা আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ও আমেরিকান-চায়নিজ পরিবারে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়[১৬]। এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক Lancet এর গবেষণাপত্রেও আলোকপাত করা হয়েছে। এমনকি আমেরিকাতে ফার্টিলিটি ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনগুলোতেও Sex-selective abortion এর (অন্যকথায়-ইচ্ছামূলক গর্ভস্থ কন্যাশিশু গর্ভপাত) কথা উল্লেখ করা হতো, যা পরবর্তীতে প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হয়। ভারতে নিরাপদ গর্ভপাতের জন্য ইন্টার্নেটে অনেক বিজ্ঞাপন বা ওয়েবসাইট রয়েছে।
অনেক প্রতিষ্ঠান ভিআইপি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এমনকি প্রবাসী ভারতীয় অথবা বিদেশীদের জন্য চার্টার্ড বিমানের ব্যবস্থাও আছে! যেমন এখানে একটি ওয়েবসাইটের লিল্ক-Fly to India for Safe and Legal Abortion.
যৌতুক প্রথা ও কন্যাশিশু হত্যার যোগসূত্র
ভারতে যৌতুক হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রথা, কেননা এর শিকড় প্রোথিত আছে হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রে। অষ্টেলিয়ার ABC টিভির ডকুমেন্টারীর তথ্য অনুযায়ী ভারতের ৯৯% পুরুষ বিয়েতে যৌতুক নিয়ে থাকে। বর্তমানে ছেলে পক্ষের বিত্তশালী হওয়ার সহজ মাধ্যম হচ্ছে যৌতুক। এটা রীতিমত ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, যা আর শুধু বিয়েতে সীমাবদ্ধ নেই।
বাচ্চা গর্ভধারণ, বাচ্চা প্রসব, প্রতিটি পূজা-পার্বনেও যৌতুক দিতে হয়। এর ফলে নির্মম ও নিদারুনভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে মেয়েরা ও তাদের পরিবারবর্গ। অভিধানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন টার্ম। যেমন Dowry Cannibalism. এতে অভিযোগ করা হয় যে যৌতুকের দাবী মিটাতে না পারায় এক স্বামী প্রত্যহ তার স্ত্রীর রক্ত পান করত যাতে ধীরে ধীরে সে মারা যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের এক কন্যাকে বিয়ে দিতেই পুরো পরিবারকে হতে হয় নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন (বিস্তারিত জানতে দেখুন BBC Documentary- India’s Missing Girls।
গত ষাট বছরের ভারতের ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যৌতুকে আদায়কৃত অর্থ বা সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ উর্ধমুখী হচ্ছে। যেমন ১৯২০ সালের ২০০০ রুপি সমমূল্যের যৌতুক বেড়ে ১৯৮০ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ লক্ষ বা দশ রুপিতে [১৭]। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, গড়ে যৌতুকে আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে এক পরিবারের সমস্ত অর্থের ৬৮% অথবা ছয় বছরের বাৎসরিক আয়ের সমান [১৮]। বিয়ের বাজারে প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারের মূল্য অনেক বেশী। প্রতি বছর হাজার হাজার প্রবাসী ভারতীয়রা বিয়ে করার নামে যৌতুক নিয়ে পালিয়ে যায়।
ভারতের NTV’র এই প্রতিবেদনে পাঞ্জাবের কন্যাবাজারের তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
যৌতুক ক্যালকুলেটর (Dowry Calculator) নামে সফটওয়ারও ইন্টার্নেটে পাওয়া যায়। যদিও বলা হয় এসব স্যাটায়ারমূলক, তথাপি এতে সমাজের বাস্তবচিত্রই ফুটে উঠেছে। বস্তুত এই স্যাটায়ারমূলক সফটওয়ার বানাতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বিখ্যাত সাদি ডট কমের (Shaadi.com) প্রতিষ্ঠাতা অনুপম মিতাল, যিনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি রয়টার্সে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিশ্বে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক দেশগুলোর মধ্যে ভারত হচ্ছে চতুর্থ [১৯]।
পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশের ২১৩ জন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ নিয়ে এ সমীক্ষাটি চালানো হয়। ভারতের আগের তিনটি দেশগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে হচ্ছে আফগানিস্তান, কঙ্গো, আর পাকিস্তানের মতন দারিদ্র্যপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পঞ্চম স্থানে রয়েছে সোমালিয়া। লেখার প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনায় ওই লিস্ট নিয়ে কথা বাড়াচ্ছি না। ভারতের এই সন্মানহানীকর অবস্থার মূলে রয়েছে নারী নির্যাতন, গর্ভস্থ কন্যা শিশু হত্যা, বাল্যবিবাহ, নারী শিশু শ্রম, পতিতাবৃত্তি, গৃহস্থালী কিংবা হাট-বাজারে হালকা কাজের নামে নারীদের উপর অস্বাভাবিক নির্যাতন ইত্যাদি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাধুকা গুপ্তার তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে ১০০ মিলিয়ন নারী শিশু বিভিন্ন দিক থেকে পন্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত শতাব্দীতে দেশটিতে ৫০ মিলিয়নের চেয়েও বেশি কন্যা শিশু নিখোঁজ হয়েছে (যেটার পিছনে দায়ী ইচ্ছামূলকভাবে কন্যাশিশু হত্যা)। শতকরা ৪৫.৫ ভাগের চেয়েও বেশী নারীর ১৮ বৎসর হবার পূর্বেই বিবাহ হয়ে থাকে। সুতরাং এ সমস্ত ঘটনা থেকে সমাজ বিজ্ঞানীরা উপসংহার টেনেছেন যে ভারতে কন্যাশিশু হত্যার মূলে রয়েছে যৌতুক প্রথা নামক একটি সামাজিক ব্যাধি।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যৌতুক প্রথার তথ্যচিত্র
এবার ভারতের সীমান্তবর্তী দুটি মুসলিম প্রধান দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দিকে আলোকপাত করা যাক।
মুসলিম বিশ্বে মূলত এ দুটি দেশ ছাড়া আর অন্য কোথাও যৌতুক প্রথা প্রচলিত নেই, বরং পাত্রকেই মুসলিম আইন অনুযায়ী পাত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। প্রসংগত, ভারত বিভাগের সময় মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথা তেমন প্রচলিত ছিল না। এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৪৫-১৯৬০ সালে যৌতুকের হার ছিল ৩% এবং তা ১৯৬০-১৯৭৫ সালে বেড়ে ১১% -এ উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে আইনগতভাবে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যে, তারপর থেকে যৌতুকের হার অনেকাংশে বেড়েছে, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭৬% [২০]।
পাকিস্তানেও কমবেশী একই ধরণের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। তাহলে এ অবস্থার কারণ কী? গবেষণাপত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবই বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার পিছনে দায়ী [২১]। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী আমাদের দেশে যৌতুক প্রথা প্রতিষ্ঠার পেছনে মুসলিম বিবাহ সংক্রান্ত আইন-কানুন পরিবর্তন ও বাকীতে মোহরানা (deferred bride price) দেওয়ার প্রবণতাকেও দায়ী করা হয়েছে [২২]। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে (যদিও তারা মুসলিম প্রধান দেশ) ইসলামের মূল চেতনার বহিঃপ্রকাশ সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, সমাজের একটি অংশ যারা ইসলাম ধর্মে আস্থাভাজন বলে পরিচিত তাদেরকে যৌতুক নামক ব্যাধিতে সাধারণত আক্রান্ত হতে দেখা যায় না।
যৌতুক প্রথা-ই কি কন্যাশিশু হত্যার মূল কারণ?
যৌতুক প্রথাই যদি কন্যাশিশু হত্যার পেছনে মূল কারণ হয় তবে যুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমাজেও Sex-selective abortion বা ইচ্ছামূলক গর্ভস্থ কন্যাশিশু হত্যা সচরাচর পরিলক্ষিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এটি সমাজে প্রচলিত তো নয়ই, বরং এর তেমন গ্রহণযোগ্যতাও নেই। সম্প্রতি বিখ্যাত জার্নাল PNAS-এ এই কথাই উল্লেখ করা হয়েছে [২৩]। বাংলাদেশে মফস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জে খোঁজ করলে এখনও দেখা যায় যে ছেলের আশায় অনেকগুলো কন্যাসন্তান (যেমন ৫/৭ জন) হয়ে থাকে। এজন্য আশির দশক থেকে পরিবার পরিকল্পনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ শ্লোগানটি সেসময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাছাড়া জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পর্যায়ক্রমিক উন্নতির ফলে এ দু-দেশের ‘হারিয়ে যাওয়া’ মেয়েদের (missing girls) সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গত দশ বছরে তা ৮.৯% থেকে কমে ৬.৯%-তে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ১১% থেকে নেমে ৬.৩%- এ দাঁড়িয়েছে [২৪]। অর্থাৎ এ দু’দেশে মেয়ে শিশুদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালোর দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এ দিক থেকে ভারতের অবস্থান বড়ই হতাশাজনক যার তথ্যচিত্র বিখ্যাত Lancet জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে [১]।
ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাক-ইসলামিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যেও কন্যাশিশু হত্যা রীতি সমাজে প্রচলিত ছিল। ইসলাম আবির্ভাবের পরে এই বর্বর রীতি সমূলে উৎপাটিত হয়। ইসলামী চেতনায় যেকোন শিশু হত্যাই সবচেয়ে বড় ধরণের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না।
তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ। ” (১৭:৩১) কন্যাশিশু হত্যার ব্যাপারে সরাসরি সতর্ক করা হয়েছে এভাবে, “যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্য করা হল?” (৮১:৮-৯) শুধু তাই নয়, পুত্রসন্তান জন্ম নিলে মাত্রাতিরিক্ত খুশী হওয়া এবং কন্যাসন্তান জন্ম নিলে হতাশ হতে নিষেধ করা হয়েছে (১৬:৫৮-৫৯)। ইসলামে নারী বা কন্যাশিশু সবসময় বিশেষ মর্যাদার পাত্র। হাদিসে বর্ণিত আছে-
Ibn `Abbas transmitted that the Prophet (blessings and peace be upon him) said, "A Muslim who has two daughters whom he treats well when they accompany him or when he accompanies them is admitted to Paradise". [Transmitted by Bukhari in Al Adab Al Mufrad (77); Ibn Abu Sheiba, 8/551; Ahmad which is corrected by Sheikh Shaker (2104); Ibn Majah (3670); and others.]
On the authority of Abu Huraira: "The Prophet (blessings and peace be upon him) said, `Whoever had three daughters and showed patience in their keeping, their pleasure and displeasure, Allah admits him to Paradise for his mercy over them. A man asked, `And what about two daughters, O Messenger of Allah? He said, `And two daughters as well." Another asked, `O Messenger of Allah, what about one daughter?" He said, `And one daughter as well". [Transmitted and its authority amended by Al-Hakim, agreed upon by Al-Zahaby, 4/176] Ibn `Abbas recounted, "Whoever had a female who was not buried nor insulted by him, and had not preferred his male children to her, Allah admits him to Paradise. [Transmitted by Abu Dawud, 5/5146; and Al-Hakim who corrected it 4/177, approved by Al-Dhahaby.]
যদিও বর্তমানে মুসলিম সমাজ প্রকৃত ইসলামিক চেতনা থেকে অনেক সরে গিয়েছে এবং এর ফলে অনেক অনৈসলামিক কার্যকলাপ দ্বারা কলুষিত হয়েছে, তথাপি আধ্যাত্নিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম সমাজে শিশু অথবা কন্যাশিশু হত্যার মতন জঘন্য অপরাধকে এখনও প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করা হয়।
যৌতুক প্রথার মূল কোথায় প্রোথিত?
ভারতে কন্যাশিশু হত্যার প্রধান কারণ হিসেবে যৌতুক প্রথাকেই দায়ী করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমাজে কীভাবে যৌতুক প্রথা প্রতিষ্ঠিত হলো? যৌতুক প্রথার উৎপত্তি হিসবে ‘কন্যাদান’ অথবা ‘স্ত্রীদান’ নামক বৈদিক যুগের একটি ধর্মীয় রীতিকে গন্য করা হয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে কন্যার কোন অধিকার নেই। বিয়ের পর থেকে কন্যার দায়-দায়িত্ব আর পিতার থাকে না, যা কন্যার স্বামীর উপরে বর্তায়। এজন্য বিয়ের সময় পিতা কন্যাদান রীতির মাধ্যমে কন্যার স্বামীকে খুশী হয়ে কিছু উপহার বা দক্ষিনা দেন (সামর্থ অনুযায়ী)।
আবার পিতার দক্ষিনা ছাড়া কন্যাদান তথা বিবাহ ধর্মীয়ভাবে অসম্পূর্ন থেকে যায়। বৈদিক সময়ের সামর্থ্যানুযায়ী দক্ষিনাই কালাতিক্রমে বর্তমানে বাধ্যতামূলক ও সাধ্যাতিরিক্ত যৌতুকে বিবর্তিত হয়েছে [২৫]। শুরুর দিকে কন্যাদান উচ্চবর্নের হিন্দু তথা ব্রাহ্মন সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে নিম্নতর বর্নের হিন্দুরাও তা অনুসরণ করা শুরু করে।
পাশ্চাত্য সমাজেও একসময় যৌতুকসদৃশ প্রথা প্রচলিত ছিল।
পরবর্তীতে শিল্প বিপ্লবের জোয়ারে নারীদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা এবং স্বাধীনতা তথা আধুনিকায়নের ফলে বর্তমানে সেখানে এ প্রথাটির বিলুপ্তি ঘটেছে [২৬]। বিশ্বায়নের যুগে শিল্পায়নের ছোঁয়া ভারতেও লেগেছে, এমনভাবেই লেগেছে যে বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্নপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য যৌতুকহীন সমাজের দৃষ্টান্ত সামনে রাখলে ভারতেও যৌতুক প্রথার প্রকোপ ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হওয়ারই কথা। কিন্তু বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি আরো সমস্যাপুর্ন হয়েছে, যার তথ্যচিত্র পূর্বেই বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
এই যে শিক্ষা ও আধুনিকায়নের ফলে ইউরোপ থেকে যৌতুক প্রথা উঠে গেল, অথচ ভারতে যৌতুক প্রথা না উঠে গিয়ে বরং কেন এই প্রথাটির আরো অবনতি হলো তা নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা করা হয়েছে। এর কারন হিসেবে মূলত ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বর্ণ প্রথাকে চিহ্নিত করা হয়েছে [২৭]।
কন্যাশিশু হত্যা’ সমস্যার সমাধান কোথায়?
সন্দেহাতীতভাবে কন্যাশিশু হত্যা অতি নিকৃষ্টতম অপরাধ যা কিনা উন্নত বিশ্বে দেখা যায় না। তাহলে কি কন্যাশিশু হত্যা রোধে উন্নতবিশ্ব তথা পাশ্চাত্য সমাজের জীবনধারা ও দর্শন অনুসরণ যোগ্য? বর্তমান সেক্যুলার বিশ্বে যে পাশ্চাত্য জগতকে মানবতাবাদের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, চলুন দেখি সেখানে সভ্যতা ও মানবতাবাদের চিত্রটি কী রকম। UK-তে ২০০৭ সালের পরিসংখ্যানে কন্যাশিশু হত্যার তথ্য পাওয়া না গেলেও প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার শিশুকে গর্ভপাতের নামে হত্যা করা হয়, যেখানে ৫০% মা হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী কিশোরী [২৭]।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেখানে গর্ভসঞ্চারন রোধে ৮১% মানুষ জন্মনিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এজন্য ইউরোপের প্রায় সব দেশেই নেগেটিভ জন্মহার বিরাজমান। অথচ ইউরোপের প্রায় সবদেশেই জরায়ুর স্বাধীনতার নামে গর্ভপাত করা বা না করা নারীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল (বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের ১০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে)[২৮]। অন্যদিকে আমেরিকাতে ২০০০ ও ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ও ১ লক্ষ ২১ হাজার শিশুর গর্ভপাত ঘটানো হয়। ১৯৯৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় ধর্ষন ও ইনসেস্টের কারনে মাত্র ১% ও স্বাস্থগত কারণে ৬% গর্ভপাত ঘটে।
অর্থাৎ গর্ভপাতের ৯৩% হচ্ছে অপরিকল্পিত গর্ভধারণজনিত গর্ভপাত [২৯]। অবাধ মেলামেশের কারণে কম বয়সে মা হওয়া, কেরিয়ার, পড়াশুনা, দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, লিভ টুগেদার ইত্যাদি কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যে সমাজ গর্ভপাতের মাধ্যমে অনাকাংখিত শিশুকে হত্যা করছে, সেই একই সমাজ আবার শিশু কামনার্থে In Vitro Fertilization-এর পসার জমিয়ে বসেছে! সমস্যা সমাধানের নামে একি পরিহাস নয়? মানবতার উন্নতি সেখানে এতই চরমে পৌঁছেছে যে, জীবন্ত অবস্থায় যে শিশুটি ছিল অনাকাংখিত, মৃত্যুর পরে সেই শিশুটিই হয়ে উঠেছে বহু আকাংখিত; তবে মায়ের কাছে নয়, রিসার্চ সেন্টার ও প্রসাধন ইন্ডাষ্ট্রীর কাছে [৩০]। অবহেলিত, অনাকাংখিত হত্যাকৃত শিশুদের রক্ত মাংসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে Fetal Harvesting Firms [৩১]। যারা ফেলে দেওয়া শিশুদের অংগ, প্রত্যংগ, মস্তিষ্ক, টিস্যু ইত্যাদি অর্ডার মাফিক সযত্নে পৌঁছে দিচ্ছে রিসার্চ সেন্টারগুলোতে।
এসব মানবতার নামে মশকরা নয় কি? গর্ভপাতের এমন ভয়ংকর বিবর্তন ঘটেছে যে Live abortion -এর মতন নিষ্ঠুর ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে, যেখানে শিশুটিকে (সাধারনত গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহের পর থেকে) জীবন্ত প্রসব করিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমেরিকাতে Live abortion-এর নিষ্ঠুরতা ও তৎসম্পর্কিত জনরোষের কারণে ২০০৩ সালে Partial-Birth Abortion Ban Act আইন পাশের মাধ্যমে তা নিষিদ্ধ করা হয়। মানবতা এতই নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আইন করেও কাজ হচ্ছে না, বের করা হচ্ছে নতুন নতুন ফাঁক-ফোঁকর। যেমন গাইনোকলজিস্ট শিশুটির মাথা ছাড়া দেহের বাকী অংশটুকু বের করেন; এতে করে আইনগতভাবে বলা যাবে না যে শিশুটি জীবন্ত প্রসব হয়েছে, কেননা মাথাটি এখনো বের হয়নি। তারপর ছটফট করতে থাকা শিশুটির মাথায় ফুটো করে পাইপের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে শুষে বের করে আনা হয় (নীচের ভিডিও দেখুন)।
এর ফলে মাথাটিও সহজে বের করে আনা যায় (নিষ্ঠুরতা তুলে ধরতে প্রমান হিসেবে কিছু বীভৎস ছবি এখানে যুক্ত করার জন্য দুঃখিত)। এতে গর্ভপাতও হলো, আইনও রক্ষা হলো! সাপও মরল, লাঠিও ভাঙ্গল না! হারয়ে মানবতা!!
শিশুটি কন্যাই হোক বা পুত্রই হোক সে আমাদেরই মতন একজন মানুষ। তারও আছে বাঁচার অধিকার। অবুঝ, অবলা শিশুটি সশব্দে নিজের অধিকারের কথা প্রকাশ করতে পারে না বলে মানবতার ধব্জাধারী আমরা আমাদের স্বার্থরক্ষা ও নিজেদের ভুল আড়াল করতে নিষ্পাপ, নির্মল শিশুটিকে নির্দ্বিধায় নিক্ষেপ করছি পঙ্কিল আস্তাকুঁড়ে। কন্যাশিশু হত্যা রোধ তথা সত্যিকারের মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বস্তুত ইসলামিক আধ্যাত্নিকতা ও জীবনাদর্শ ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে কি? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।