চিত্রশিল্পী হওয়াটা কিশোরী ফ্রিদার লক্ষ্য ছিল না কোনদিন। ইচ্ছে ছিল তাঁর ডাক্তার হওয়ার । কিন্ত আঠারো বছর বয়সের এক দূর্ঘটনা তাঁকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত করে ফেলে। এই ঘটনা তাঁর জীবনের গতিপথই পরিবর্তন করে দেয়। তাঁর কথায়, ব্যথা এবং একঘেঁয়েমির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, দূর্ঘটনার পর সুস্থ হয়ে ওঠার মাসেই তিনি ছবি আঁকাকে গ্রহণ করেন নিবিড়ভাবে।
তিনি বলেন আমি বুঝতে পারলাম ডাক্তারি লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার মত শক্তি আমার আছে”। এ নিয়ে বেশি না ভেবে তিনি ছবি আঁকা শুরু করে দিলেন। এভাবেই শুরু হয়ে গেলো ফ্রিদার আরেক জীবন, শিল্পী জীবন।
হাইস্কুলে পড়ার সময় শিল্পকলার কয়েকটা ক্লাস আর বাবার সংগ্রহের শিল্পকলার বই ঘাটাঘাঁটি ছাড়া, শিল্পকলার ওপর ফ্রিদার কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ফ্রিদার শৈল্পিক দক্ষতা যতই পরিপক্ব হতে থাকলো, তাঁর ছবিগুলোও স্পষ্টতঃ স্বতন্ত্র শৈলীতে বিকশিত হলো।
চারপাশের লোকজন, বিভিন্ন শিল্পী, নানা সংস্কৃতি এবং জীবনের বহু বিচিত্র দিক তাঁর ছবিতে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। আলাদা আলাদা রীতি এবং মোটিফ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তিনি। তাঁর `স্যুররিয়ালিস্ট' ধারার কাজ এবং যৌনবিষয় সম্বলিত ছবি শিল্পকলার জগতে দারুণ এক ধাক্কা দেয়।
যদিও তিনি নিজের জন্মতারিখ লিখতেন ১৯১০-এর ৭জুলাই; কিন্তু জন্মসনদ অনুযায়ী তাঁর জন্মতারিখ ১৯০৭-এর ৬ জুলাই মেক্সিকো সিটিতে। নিজের জন্ম সনটা মেক্সিকোর বিপ্লবের বছরের সাথে মিলিয়ে বলতে ভালোবাসতেন ফ্রিদা।
তাঁদের বাড়িটির নাম ছিল ব্লু হাউস। নামটা ছিল বাড়ির রঙের সাথে মিলিয়েই। ছোট্ট শহর কোইয়াকানের এই বাড়িটিতে ফ্রিদার জীবনের শুরু এবং শেষ। গুইলেরমো এবং মাতিল্দা কাহলোর তৃতীয় কন্যা তিনি। মার চেয়ে বাবার সাথেই বেশি ঘনিষ্টতা ছিল ফ্রিদার।
ফ্রিদার বাবা উইলহেম গুইলেরমো(১৮৭২-১৯৪১) কাহলো ছিলেন পেশাদার ফটোগ্রাফার। একজন সৌখিন চিত্রশিল্পীও ছিলেন তিনি। তাঁর কারণেই সর্বপ্রথম ফ্রিদার মনে শিল্প সম্পর্কে আগ্রহ জাগে। গ্রামাঞ্চলে তিনি ছবি আঁকতে গেলে ফ্রিদা প্রায়ই তাঁর বাবার সঙ্গে যেতেন। তিনি ফ্রিদাকে ক্যমেরার ব্যবহার শেখান।
ফটোগ্রাফকে কিভাবে রিটার্চ এবং রঙিন করতে হয় বাবার কাছ থেকে ফ্রিদা সে বিষয়েও জ্ঞান লাভ করেন।
শৈশবেই ফ্রিদা ছিলেন খুব চঞ্চল প্রকৃতির। চোখে অপার কৌতুহল। শুধু ছুটছেন আর দেখছেন সবকিছু। কিন্তু এই কৌতুহলী চঞ্চল শিশুর জীবনে নেমে এল অন্ধকার।
পোলিওতে আক্রান্ত হলেন তিনি। সারা জীবনের জন্য সরু দুর্বল হয়ে গেলো ডান পা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর। কিন্তু তাতে দমে গেলেন না ফ্রিদা। শৈশবের সেই ক্ষতকে তিনি বিজয়ী হতে দেননি।
তাঁর চাঞ্চল্য এবং দূরন্তপনা আরো বাড়লো। ১৯২২ সালে মেক্সিকোর অন্যতম সেরা স্কুল এসকিউলা ন্যাশনাল প্রিপারেটরিতে ভর্তি হলেন ফ্রিদা।
ফ্রিদা তখন প্রিপারেটরি স্কুলের ছাত্রী; সে সময় দিয়েগো রিভেরা সবে ফ্রান্স থেকে ফিরেছেন, আর দেশে এসে ফ্রিদাদের স্কুলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে শুরু করেছেন তাঁর ম্যুরাল “ক্রিয়েশন”। দিয়েগো রিভেরা মেক্সিকোর বিখ্যাত ম্যুরাল শিল্পী। তাঁর সময়ে দিয়েগো ‘মাস্টার অফ ম্যুরালস্’ নামে খ্যাত ছিলেন।
প্রধানত মেক্সিকো এবং আমেরিকাতে তিনি অনেকগুলো ম্যুরাল করেন। স্কুলে ফ্রিদা প্রায়ই তাঁর আঁকা দেখতে যেতেন, আর আড়ে ঠারে নানারকম মন্তব্য করতেন। দিয়েগোর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু বুঝতে পারলেন না তাঁর এই আবেগ কিভাবে প্রকাশ করবেন।
দূর্ঘটনা যেন ফ্রিদার পিছু ছাড়েনা কিছুতেই।
শৈশবের পোলিও চিহ্ন রেখে গেছে ডান পায়ে। এবার এলো আরো ভয়াবহ দূর্যোগ। ১৯২৫ সালে এক ভয়ঙ্কর এক বাস দূর্ঘটনা তাঁর জীবন ওলটপালট করে দেয়। ভেঙে যায় তাঁর মেরদণ্ড, পাঁজর, কলারবোন ও পেলভিস। চুরমার হয়ে গেছে ডান পা; তাতে এগারোটা ফ্রাকচার।
নড়ে গেছে কাঁধের হাড়। একটা লোহার দণ্ড ভেদ করে গেছে তাঁর উদর আর জরায়ু। পেলভিস্ এবং জরায়ুর কঠিন আঘাতের ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণে তাঁর মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হল। আসল সত্যটা হল তিনি কখনোই মা হতে পারবেন না। প্রচন্ড মানসিক জোর এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে ফ্রিদা ফিরে এলেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু এই দূর্ঘটনা তাঁর কাছে রেখে গেলো আরেক বিভীষিকা; প্রচন্ড ব্যথা। প্রায়ই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হত, অথবা দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে হত ব্যথার কারণে। এই দূর্ঘটনার ফলে বাকী জীবনে তাঁর শরীরে পঁয়ত্রিশবার অস্ত্রোপচার করতে হয়; যার বেশিরভাগই পিঠে এবং ডান পায়ে। যখন বাস দূর্ঘটনার ধকল তিনি কাটিয়ে উঠছেন গুইলেরমো তাঁর রঙের বাক্স এবং তুলি তুলে দেন ফ্রিদার হাতে।
ছবি আঁকতে উদ্ভুদ্ধ করেন তাঁকে।
বাস দূর্ঘটনার পর সুস্থ হয়ে উঠলে ফ্রিদা শুনতে পান মেক্সিকো সিটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দিয়েগো একটি ম্যুরাল আঁকছেন। যদিও রিভেরার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত তেমন কোন আলাপ পরিচয় গড়ে ওঠেনি, কিন্তু নিজের কাজ সম্পর্কে রিভেরার মতামত জানতে খুব আগ্রহ ছিলো ফ্রিদার। রিভেরা এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে ফ্রিদার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। তিনি নিজের আঁকা চারটি ছবি নিয়ে মিনিস্ট্রি বিল্ডিং এর উদ্দেশ্যে বাসে উঠে পড়লেন।
দিয়েগোর সাথে সাক্ষাতে খুব আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন ফ্রিদা। ম্যুরালের জন্য বানানো ভারার ওপর কাজ করছিলেন দিয়েগো । নিচ থেকে ফ্রিদা তাঁর আসার কারণ জানালেন। নেমে এলেন দিয়েগো। দেখলেন ছবিগুলো আর কথা বললেন ছবি নিয়ে ।
যে ছবিগুলো তিনি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে তাঁর আঁকা প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি “সেল্ফ পোর্ট্রেট ইন আ ভেলভেট ড্রেস”ও ছিল। ছবিগুলো দেখার পর রিভেরা ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতিটির ব্যাপারে উচ্ছ¡িসত প্রশংসা করলেন; তাঁর মতে “... এটি একেবারেই স্বতন্ত্র”। অন্য তিন ছবি সম্পর্কে বলেন- “...যা দেখে তুমি প্রভাবিত হয়েছো তাই”। তিনি ফ্রিদাকে বাড়ি গিয়ে আর একটি ছবি আঁকতে বললেন। বললেন তিনি দেখতে যাবেন ছবি।
কয়েকদিন পর ফ্রিদার আঁকা ছবি দেখে রিভেরা বললেন, ‘ তোমার প্রতিভা আছে...’। তাঁকে তিনি ছবি আঁকা চালিয়ে যেতে বললেন। এমনও হতে পারতো রিভেরা যদি তাঁর ছবি সম্পর্কে পজিটিভ প্রতিক্রিয়া না দেখাতেন হয়ত তখনই শেষ হয়ে যেতো ফ্রিদার শিল্পীজীবন।
তাঁর শিল্পী জীবনের ভিত গড়াতে আরো একজন মানুষের অবদান আছে। তিনি ফার্নান্দো ফার্নান্দেস।
ফার্নান্দো ফার্নান্দেস ছিলেন ফ্রিদার বাবার বন্ধু। কমার্শিয়াল প্রিন্টমেকার হিসাবে তিনি সবার কাছে সুপরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর তাঁর সাথে কাজ করার জন্য ফ্রিদাকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে যান। ফ্রিদাকে ড্রইং এর কলাকৌশল শেখান এবং সুইডিশ ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী আন্দ্রেস জর্ণ-এর প্রিন্ট কপি করান। সে সময় ফ্রিদার প্রতিভায় আশ্চর্য হন ফার্নান্দেজ।
শিল্পী জীবনের শুরুতে ফ্রিদার ছবিতে নিজস্ব কোন স্টাইল ছিল না। ফ্রিদার প্রথম দিককার ছবিতে তাঁর পছন্দের শিল্পীদের ব্যবহৃত মোটিফ এবং স্টাইল লক্ষ্য করা যায়। ফ্রিদা প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন ১৯২৬ সালে ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট ইন এ ভেলভেট ড্রেস’। ইউরোপিয়ান রেনেঁসাঁস মাস্টারদের কাজ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত উনিশ শতকের মেক্সিকান প্রতিকৃতি শিল্পীদের রীতিতে এটি আঁকা। এই আত্মপ্রতিকৃতিটি যেন বত্তিচেল্লির ‘ভেনাসের’ ফ্রিদা সংস্করণ।
অন্যান্য প্রতিকৃতি চিত্র যেমন- “পোর্ট্রেট অফ এলিসিয়া গ্যালেন্ট”, এবং তাঁর বড় বোনের প্রতিকৃতি চিত্র “পোর্ট্রেট অফ আড্রিয়ানা” তেও ফ্রিদা এই রীতিতে কাজ করেছেন। উনিশ শতকের মেক্সিকান প্রতিকৃতি চিত্রশিল্পীদের ব্যবহৃত আরো কিছু বিষয় ফ্রিদা তাঁর ছবিতে এনেছেন। যেমন, ঝুলন্ত রঙিন পর্দাসদৃশ ছবির পশ্চাদপট। তাঁর “সেল্ফ পোর্ট্রেট-টাইম ফ্লাইস’ (১৯২৬) থেকে শুরু করে পরে আঁকা “পোর্ট্রেট অফ এ উওম্যান ইন হোয়াইট” (১৯৩০), “সেল্ফ পোর্ট্রেট ডেডিকেটেড টু লিওন ট্রটস্কি” সহ আরো বেশ কিছু ছবিতে তিনি এই মোটিফ ব্যবহার করেছেন।
ফ্রিদা এবং দিয়েগো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯২৯ সালের ২১ আগস্ট।
অনেকেই এই বিয়ে নিয়ে আড়ালে হেসেছেন। কেউ কেউ একে হাতির সাথে পায়রার বিয়ে বলে মন্তব্য করেছেন। এই বিয়ে যে ফ্রিদার জীবনে শান্তি এনেছিল তা বলা যাবে না। আর এই অশান্তির কারণ বেশিরভাগ সময়ে ছিলেন দিয়েগো । ফলে বিয়ে পরবর্তীতেও এক কষ্টকর জীবন কাটিয়েছেন ফ্রিদা।
ফ্রিদা ছবি আঁকলেও তখনো তাঁর ছবি তেমন একটা আলোচিত বা প্রচারিত হয়নি। আর তখন দিয়েগো ছিলেন মেক্সিকোর বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় শিল্পী। যার কারণে ফ্রিদার শিল্পী জীবনের প্রথম দিকের অনেকটা সময়ই কেটেছে তাঁর বিখ্যাত স্বামী দিয়েগো রিভেরার শৈল্পিক ছায়ায়। তবে জীবৎকালেই তাঁর কাজ শিল্পকলার জগতে আলোচনার ঢেউ তুলেছিল। আর তারপরের কথা সবার জানা, শিল্পকলার ইতিহাসে বিংশ শতকের অন্যতম মহৎ শিল্পী হিসাবে ফ্রিদার খ্যাতি।
একসময় রিভেরার খ্যাতির আড়ালে থাকলেও এখন তিনি রিভেরার মত এমনকি হয়ত তাঁর চেয়েও বেশি বিখ্যাত।
বিয়ের পর দিয়েগো মেক্সিকান জনপ্রিয় শিল্প- ‘ফোকলোরিক’ ধারায় আঁকতে বললেন ফ্রিদাকে। আরো আঁকতে বললেন মেক্সিকোর আদিবাসী এবং শ্রমজীবি মানুষ, যেরকম তিনি এঁকেছেন তাঁর বিভিন্ন ম্যুরালে। এই উৎসাহের ফলস্বরূপ ফ্রিদা আঁকলেন ‘টু ওমেন’। এই ছবিটির মধ্যে রিভেরার ম্যুরালের অনেক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে প্রকটভাবে।
সেই উজ্জ্বল রঙ, সেই শৈলী, সেই একই ফিগার। এই ছবিটি যেন রিভেরার কোন একটি ম্যুরালের একটি অংশের ক্লোজ আপ। এই ছবির কিছু বৈশিষ্ট্য ফ্রিদার আরো অনেক ছবিতে এসেছে।
দিয়েগো যখন বিভিন্ন জায়গায় ম্যুরাল করতেন কোন কোন সময় তাঁর কাজের জায়গায় তাঁকে সঙ্গ দিতেন ফ্রিদা । তাঁর ম্যুরালের একাধিক ফিগারে ফ্রিদার ছায়া দেখা যায়।
দিয়াগোর ম্যুরালগুলো সাধারণত বড়। ১৯৪৫ সালে ফ্রিদা নিজেই একটি ম্যুরাল আঁকলেন ক্যানভাসে। তবে এটির সাইজ মাত্র ২৪ইঞ্চি বাই ৩০ইঞ্চি (৬১ বাই ৭৫ সেমি.)। এটির নাম ‘মোজেস’ কিংবা ‘নিউক্লিয়াস অফ ক্রিয়েশন’। এই ছবিটির অনুপ্রেরণা পান সদ্য পড়ে শেষ করা সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই “ মোজেস দ্য ম্যান এন্ড মনোথিস্টিক রিলিজিয়ন’ থেকে।
এই ছবির রীতি দিয়েগো দ্বারা অনুপ্রাণিত।
শিল্পী এডোলফো বেস্ট মোগার্ড- এর আদর্শে বিশ্বাসী মেক্সিকান শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি গোষ্টীর সাথে যুক্ত ছিলেন ফ্রিদা। ১৯২৩ সালে একটি বইতে মেক্সিকান শিল্পের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কথা বলেন মোগার্ড। তিনি বলেন, ছবিতে উনবিংশ শতকের মেক্সিকান চিত্রশিল্পীদের ব্যবহৃত উপাদান ও ফর্ম ব্যবহার করা উচিৎ। এই গোষ্ঠী ছবির এই ‘ফোকলোরিক’ রীতিকে বলতেন ‘মেক্সিকানইজম’।
চারুকলার ইতিহাসেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমেরিকানরা এই আন্দোলনের নাম দেয় ‘মেক্সিকান রেনেঁসা’। তাঁর দ্বিতীয় আত্মপ্রতিকৃতি ‘টাইম ফ্লাইস্’-এ ফ্রিদা এই ‘মেক্সিকানইজম’ রীতি প্রয়োগ করেন। এতে উজ্জ্বল বর্ণের ব্যবহার লক্ষণীয়। তাঁর পূর্ববর্তী ছবিগুলোতে ব্যবহৃত অভিজাত রেনেসাঁস ভেলভেট পোশাকের জায়গায় এসেছে তুলাচাষীর সাধারণ পোশাক।
তাঁর পরিধানের অলঙ্কার প্রি-কলাম্বিয়ান এবং উপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবেরই প্রমাণ। এই ছবি দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে তাঁর রক্তে প্রবাহিত মেক্সিকান সংস্কৃতির মূলে ফিরে আসছেন ফ্রিদা। জাতীয় পরিচয়কে আরো স্পষ্ট করতে এই প্রতিকৃতিতে মেক্সিকান পতাকার রঙ- লাল, সাদা ও সবুজ রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। চিত্রশিল্পী হিসাবে ফ্রিদার নিজস্ব স্টাইল দাঁড় করানোর চেষ্টা এই আত্মপ্রতিকৃতিতে স্পষ্ট।
ফ্রিদার ছবিতে প্রি-কলাম্বিয়ান সময়কালের শিল্পকলার গভীর প্রভাব ছিল।
ফ্রিদা-রিভেরার আবাসস্থলের সর্বত্র ঐ যুগের শিল্পের নমুনা দেখা যেতো। দিয়েগো সংগ্রহ করতেন ভাস্কর্য ও নানান আকৃতির দেবমূর্তি। আর ফ্রিদার ঝোঁক ছিল সে সময়কার অলঙ্কার সংগ্রহে। বিভিন্ন সময় তাঁর বিভিন্ন আত্মপ্রতিকৃতিতে যেমন- ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট- টাইম ফ্লাইস’(১৯২৬), ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ মাঙ্কি’ (১৯৩৮), ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ ব্রেইড’ (১৯৪১) এবং আরো কিছু ছবিতে তাঁকে তাঁর সংগ্রহের অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। ফ্রিদার মতে তাঁর ছবিতে এইসব শিল্পের নমুনা যুক্ত করার কারণ এগুলো তাঁকে দিয়েগোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাঁর অনেক ছবিতে দিয়েগোর সংগ্রহের আরো কিছু জিনিসও দেখা যায়। এগুলো কোন কোন ছবির মডেল অথবা প্রেরণা হিসেবেও এসেছে। ১৯৩২ সালে আঁকা তাঁর ‘মাই বার্থ’ ছবিতে তিনি নিজের কল্পনায় তাঁর জন্মদৃশ্য এঁকেছেন। সম্ভবত আজটেক দেবী তাজোল্টিওল্ট এই ছবির মডেল। ১৯৩৭- এর ‘মাই নার্স এন্ড আই’ ছবিতে তিওতিহুয়াকান মুখোশ পরে আছে নার্স এবং ‘ম্যাডোনা এন্ড চাইল্ড’ ছবিটি সম্ভবত একটি প্রি-কলাম্বিয়ান ভাস্কর্যের অনুসরণে আঁকা।
তাঁর আরো কিছু ছবি যেমন, ‘দ্য ফোর ইনহ্যাবিটেন্টস্ অফ মেক্সিকো সিটি’ (১৯৩৮), ‘গার্ল উইথ ডেথ মাস্ক’(১৯৩৮), এবং ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ স্মল মাঙ্কি’ তে (১৯৪৫) প্রি-কলাম্বিয়ান যুগের শিল্প-নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৪৯-এ আঁকা একটি ছবিতে বিষয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন মেক্সিকান পৌরাণিক বিষয়কে।
উনিশ শতকের মেক্সিকান ধর্মীয় সংস্কৃতিতে ক্যাথলিক ধর্মবিষয়ক ছবি ‘এক্স ভোটো’ এবং ‘রিটেবলো’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলো সাধারণত ছোট মাপে (৮ বাই ১০ ইঞ্চি) আঁকা হতো প্রধানত কাঠ কিংবা ধাতব পটে । কিন্তু কোন কোন সময় বেশি দামে কিনতে সক্ষম এমন ক্রেতাদের জন্য এগুলো ক্যানভাসের ওপরও আঁকা হতো।
রিটেবলো হচ্ছে কোন সন্ত বা অন্য কোন ভক্তিমূলক মূর্তির ছবি। ‘এক্স-ভোটো’ ছবি দামে সস্তা; নামগোত্রহীন অনেক শিল্পীই এ ধরণের ছবি আঁকেন, কারণ প্রত্যেক ‘এক্স-ভোটো’ ছবির বিষয় এক। এখনো পর্যন্ত এ ধরণের ছবি হাতে আঁকা হয়। যদিও ‘এক্স-ভোটো, এবং ‘রিটেবলো’ শব্দ দুটি প্রায়শই একই অর্থে ব্যবহার হয়, কিন্তু তারা শিল্পকলার আলাদা দুটি ধারা। ফ্রিদার কিছু ছবিতে আমরা ‘এক্স-ভোটো’ ধারার ছবির প্রভাব দেখতে পাই।
দুই শতাধিক এক্স-ভোটো এবং রিটেবলোর সংগ্রহ ছিলো রিভেরার। ফ্রিদা প্রায়শই এই সব ছবি থেকে উপাদান সংগ্রহ করতেন।
দিয়েগোকে খুশি করার জন্য ফ্রিদা প্রায়ই মেক্সিকোর তেহুয়ানা অঞ্চলের মহিলাদের পোশাক পড়তেন। মাটি পর্যন্ত লম্বা প্রচুর কারুকাজ করা এই পোশাক যে শুধু সুন্দর ছিল তা নয় এটি তাঁর পায়ের শারীরিক অসঙ্গতি আড়াল রাখার পক্ষেওও সুবিধাজনক ছিল। বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর সময় এ পোষাকের কারণে সবার প্রচুর মনযোগ আকর্ষণ করতেন ফ্রিদা।
অনেক ছবিতে ফ্রিদা নিজেকে এই ধরণের পোশাকে উপস্থাপন করেছেন। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দিয়েগো এই ধরণের পোশাক পছন্দ করতেন। ফ্রিদাকে এই ধরণের পোশাকে প্রথম দেখা যায় ১৯৩১ সালে আঁকা তাঁদের যুগল প্রতিকৃতি-‘ফ্রিদা এন্ড দিয়েগো রিভেরা’ তে। এই ছবিটি সম্ভবত তাঁদের বিয়ের ফটোগ্রাফ অনুসরণে আঁকা। এর পরে আঁকা আরো কিছু ছবিতে এই পোশাকের ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায় যেমন, ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট অন দ্য বর্ডারলাইন বিটউইন মেক্সিকো এন্ড ইউনাইটেড স্টেট’(১৯৩১), ‘ট্রি অফ হোপ, কিপ ফার্ম’(১৯৪৬), ‘রুটস’(১৯৪৩), এবং ১৯৫৪ সালে আঁকা তাঁর সর্বশেষ ছবিগুলোর দুটি ‘মার্ক্সইজম উইল গিভ হেলথ টু দ্য সিক’ এবং ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ স্টালিন’।
‘মেমোরি’ (১৯৩৭) এবং ‘মাই ড্রেস হ্যাংস দেয়ার’ (১৯৩৩) নামের আরো দুটি ছবিতে এই তেহুয়ানা পোশাক দেখা যায় কিন্তু ছবিগুলোর এই পোশাক ফ্রিদার পড়নে নয়। তেহুয়ানা পোশাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ (১৯৩৯) ছবিটিতে। তাঁর ডিভোর্সের কিছুদিন পরে এই যুগল আত্মপ্রতিকৃতিটি আঁকেন ফ্রিদা। ছবিতে দুজন ফ্রিদা। তেহুয়ানা পোশাক পড়া ফ্রিদা সেই ফ্রিদারই প্রতিমূর্তি যাকে ভালোবাসতেন দিয়েগো।
আর ইউরোপিয়ান পোশাক পড়া ফ্রিদা হচ্ছেন বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, ভেঙ্গে পড়া ফ্রিদা। ১৯৪৮-এ আঁকা ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট’ এবং ১৯৪৩-এর ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট অ্যাজ তেহুয়ানা’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; এই দুটি ছবিতে তিনি সম্পূর্ণ তেহুয়ানা পোশাকে উপস্থিত।
ফ্রিদা বেশ কয়েকবার আমেরিকা ভ্রমণ করেন । প্রথমবার ১৯৩০-এর নভেম্বরে। তিনি এবং দিয়েগো সান-ফ্রানসিসকো যান: সান-ফ্রানসিসকোতে দিয়েগো ম্যুরাল আঁকার কমিশন পেয়েছিলেন।
সেখান থেকে যান ডেট্রইট, ফিলাডেলফিয়া এবং তারপর নিউইয়র্ক সিটি। একটা সন্তানের জন্য বড় আকাঙ্খা ছিল ফ্রিদার। ১৯৩২ সালে আমেরিকাতে থাকাকালীন তাঁর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনায় ভেঙে পড়েন ফ্রিদা। তাঁর আর ভালো লাগে না আমেরিকা।
ফ্রিদা চাচ্ছিলেন মেক্সিকোতে ফিরে আসতে কিন্তু দিয়েগো বিরোধিতা করছিলেন। সেখানে তাঁর নতুন পাওয়া জনপ্রিয়তায় খুব খুশি তিনি। আমেরিকার ইন্ড্রাস্টিয়াল উন্নতিও তাঁকে উৎসাহিত করেছে। দুজনের মধ্যে খুব ঝগড়াঝাটি শুরু হলো। প্রত্যেকবার ঝগড়ার সময় দিয়েগো ফ্রিদাকে বোঝানোর চেষ্ঠা করছেন যে আমেরিকায় থেকে যাওয়াই তাঁদের পক্ষে লাভজনক।
আমেরিকায় থাকার ব্যাপারে ফ্রিদা ক্রমশ বিরক্ত এবং অস্থির হয়ে উঠেছেন। তাঁর আবেগ প্রশমনের জন্য দিয়েগো তাঁকে পরামর্শ দিলেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে একটা সিরিজ পেইন্টিং করতে। ঐ সিরিজে তাঁর প্রথম কাজ ‘মাই বার্থ’। এই ছবি তাঁর জীবনের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দুটি ঘটনা ধারণ করেছে; তাঁর নিজের জন্ম এবং তাঁর মায়ের মৃত্যু। এই সিরিজের আরেকটি ছবি ১৯৩৭-এ আঁকা ‘মাই নার্স এন্ড আই’।
ছবির ঘটনা এরকম- শিশু অবস্থায় তাঁর জন্য নিয়োজিত ধাত্রী তাঁকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, কারণ তাঁর মা এতে অসমর্থ। ‘দ্য টু ফ্রিদাস্' ছবিটিও সম্ভবত জীবনী সিরিজের অন্তর্ভূক্ত। ক্যানভাসে দিয়েগোর সাথে তাঁর মানসিক সম্পর্কের অবস্থা প্রকাশ করার এটি একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ। এই যুগল আত্মপ্রতিকৃতিটি আঁকা হয় ফ্রিদা এবং দিয়েগোর ডিভোর্স হয়ে যাবার পরপরই। ছবির বাম পাশের ফ্রিদা যাকে দিয়েগো একদা ভালোবাসতেন, দ্বিতীয় ফ্রিদা যাকে দিয়েগো প্রতারণা এবং পরিত্যাগ করেছেন।
ফ্রিদা এবং দিয়েগো মেক্সিকো ফিরে আসেন ১৯৩৩ সালে। নিজের শারীরিক সমস্যা, পায়ে অপারেশন, সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত তিনি। অন্যদিকে দিয়েগোর নতুন নতুন নারীসঙ্গকাতরতা ফ্রিদাকে দিশেহারা করে তোলে। আর এটা তাঁর পক্ষে সহ্য করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠল যখন তাঁর বোন ক্রিস্টিনার সাথে দিয়েগো একটা সম্পর্ক গড়ে তুলল। এরপর ফ্রিদা এবং দিয়েগো আলাদা থাকতে শুরু করলেন।
১৯৩৯ সালে তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান।
এর মধ্যে স্টালিনের রোষ থেকে বাঁচতে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ট্রটস্কি। তিনি এসে পড়লেন মেক্সিকোতে। দিয়েগো তখন মেক্সিকের বিখ্যাত শিল্পী এবং বিপ্লবীও বটেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের খুব ঘনিষ্ট তিনি।
দিয়েগোই বাতলে দিলেন ট্রটস্কির আত্মগোপনের জায়গা। ট্রটস্কি উঠলেন ফ্রিদাদের বাড়িতে। ঘটনাক্রমে ট্রটস্কির সাথে ফ্রিদার একটি হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠল। অবশ্য এই সম্পর্ক কোনরকম পরিণতি লাভ করেনি। গুপ্তহত্যার শিকার হন ট্রটস্কি।
দিয়েগোর বহুগামিতা এবং এর ফলে ফ্রিদার মানসিক যন্ত্রণা সত্বে ও দিয়েগোর প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল ফ্রিদার; হয়ত একইভাবে দিয়েগোর জন্যও এটি সত্য। পরস্পর থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারেননি তাঁরা; ১৯৪০ সালের ৮ ডিসেম্বর, দিয়েগোর ৫৩ তম জন্মদিনে তাঁরা আবার পরস্পরের কাছে চলে আসেন।
১৯৩৮ সালে স্যুরিয়ালিস্ট আন্দ্রে ব্রেতোঁর সাথে ফ্রিদার সাক্ষাৎ হয়। তাঁর ছবির উৎসাহদাতা ছিলেন ব্রেতোঁ। ইউরোপ এবং আমেরিকায় তাঁর একাধিক প্রদর্শনী আয়োজনে ব্রেতোঁ এবং মার্শেল দুচ্যাম্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৪৩ সালে এডুকেশন মিনিস্ট্রিস্ স্কুল অব ফাইন আর্টসে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ফ্রিদা।
ফ্রিদা এবং দিয়েগো দুজনেই রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন এবং সক্রিয় ছিলেন। ১৯২৮ সালে তাঁরা মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি(পিসিএম) এর সদস্য ছিলেন। কিন্তু দুজনেই দল থেকে বেড়িয়ে আসেন, কারণ স্টালিনইজম এর সাথে পার্টির সম্পৃক্ততা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। শিল্পী জীবনের কেরিয়ারের শুরুতে তাঁর শিল্পের উপর রাজনীতির সামান্য প্রভাব ছিল।
কিন্তু ১৯৪৮ সালে ফ্রিদা আবার পিসিএম-এ যোগ দেন; এই ঘটনা তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক মতামত ক্যানভাসে প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ করলো।
১৯৫১ সালে ফ্রিদার স্বাস্থ্য এতই খারাপ হলো যে কিছুদিন তাঁর ছবি আঁকা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ থাকলো। ডায়েরিতে লিখলেন, তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকেন তিনি। ছবির মধ্য দিয়ে তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করতে চান যা সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হবে। এই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি ‘...বেঁচে থাকার একমাত্র যথার্থ কারণ’ বলে উল্লেখ করেন ডায়েরিতে।
১৯৫৩ এর বসন্তে জীবিতাবস্থায় ফ্রিদার একমাত্র চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোতে। ফ্রিদার শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার মানা করেছেন প্রদর্শনীতে যেতে। প্রদর্শনী শুরু হলে দর্শকরা গ্যালারীতে ঢোকার কয়েক মিনিট পরে, বাইরে সাইরেন শোনা গেল। লোকজন দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে মোটর সাইকেল শোভাযাত্রাসহ একটি এম্বুলেন্স; আর এম্বুলেন্সে আছেন ফ্রিদা। হাসপাতালের স্ট্রেচারে করে প্রদর্শনী কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো ফ্রিদাকে। ফটোগ্রাফার এবং সাংবাদিকরা বিস্মিত হয়ে গেলো। তাঁকে নিয়ে রাখা হলো গ্যালারীর মাঝখানে। দর্শকরা একে একে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলো।
ফ্রিদা দর্শকদের সাথে কৌতুক করলেন, গান করলেন সাথে পান করলেন সারাটি সন্ধ্যা। দারুণ সফল একটি প্রদর্শনী হলো।
গ্যাংগ্রিনের ইনফেকশনের কারণে ঐ বছরেই ফ্রিদার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। এই ঘটনায় তিনি খুবই বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। আত্মহত্যার ইচছা প্রবল হয়ে ওঠে তাঁর।
১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই ফ্রিদা মারা যান। অফিসিয়ালি কোন পরীক্ষা কিংবা তদন্ত হয়নি, কিন্তু গুজব ছড়ায় ফ্রিদা আত্মহত্যা করেছে! ডায়েরিতে তাঁর শেষ লেখা ছিল ‘ আই হোপ দ্য লিভিং ইজ জয়ফুল, এন্ড আই হোপ নেভার টু রিটার্ন’।
জীবনের শেষ বছরগুলোতে প্রধানত স্টিল লাইফ আঁকেন ফ্রিদা। কিন্তু সেসব ছবিতে কখনো পতাকা, কখনো শান্তির পায়রা কিংবা বক্তব্য লিখে দিয়ে ওগুলোকে রাজনৈতিক করে তোলেন। ১৯৫৪ সালে আঁকা তাঁর সর্বশেষ আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর একটি ‘মার্ক্সইজম উইল গিভ হেলথ টু দ্য সিক’ পিসিএম-এর পক্ষে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য।
কমিউনিস্ট থিম এর উপর পরে আঁকা একটি ছবি ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ স্টালিন’-এ স্মরণীয় করে রাখেন স্টালিনকে। ১৯৫৪-এর জুলাইয়ে যখন ফ্রিদা মারা যান তাঁর স্টুডিওতে ইজেলের উপর স্টালিনের একটি অসমাপ্ত প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। তাঁর যখন সামর্থ্য ছিলো তখন তিনি এঁকেছেন, পার্টির জন্য কাজ করেছেন যাতে বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়- স্টালিনের অসমাপ্ত ছবিটা যেন তারই প্রমাণ।
ফ্রিদার ছবির বিষয়বস্তুতে যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি সে হচ্ছে তাঁর নিজের জীবন। নিজের বাস্তব জীবনের ঘটনা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি তাঁর জীবনী এঁকেছেন ক্যানভাসে।
এই অসাধারণ শিল্পীর জীবন এবং কাজকে আলাদা করা অসম্ভব। তাঁর ছবিই তাঁর জীবনী। তাঁর কাজগুলো প্রায়শই দর্শককে এক ধরণের কষ্টের অনুভ’তির মুখোমুখি করে। অন্যভাবে বললে তাঁর ছবিগুলো যেন তাঁর ব্যথার প্রতিকৃতি। ফ্রিদার আঁকা ১৪৩টি পেইন্টিং-এর মধ্যে ৫০টিই তাঁর নিজের প্রতিকৃতি, যার মধ্যে প্রায়শই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শারীরিক এবং মানসিক ক্ষত।
বিশেষত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো তাঁর জীবনের ঘটনা কিংবা জটিলতা: তাঁর শারীরিক অবস্থা, সন্তান ধারণে অক্ষমতা, প্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কিত দর্শন আর সবার উপরে দিয়েগোর সাথে অশান্ত-উদ্বেগপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত আবেগ এবং অনুভব ধারণ করে আছে। দূঃখজনকভাবে তাঁর জীবনের এইসব ঘটনার বেশিরভাগই ট্র্যাজিক এবং হতাশার; আর এর বেশির ভাগই দিয়েগোর নারীসঙ্গলিপ্সুতা এবং দাম্প্যত্যের বিশ্বাসভঙ্গের সাথে জড়িত। ফ্রিদা বলেছিলেন তাঁর জীবনে দুটি ভয়ঙ্কর দূর্ঘটনা কথা; এক তাঁর গাড়ী চাপা পড়া আর অন্যটি রিভেরা।
দিয়েগোর কারণে ফ্রিদা যখন বিপর্যস্ত, প্রায়ই দেখা যেতো সেই সময়কার আবেগ- অনুভূতিকে প্রকাশের জন্য তিনি কোন একটা আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছেন। সাদা চোখে ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতির বেশিরভাগই একটাকে অন্যটার মত মনে হবে।
কিন্তু তাঁর ছবির মধ্যে ক্লু আছে যাতে ছবি আঁকার সময়কার তাঁর নিভৃত আবেগ এবং ভাবনা প্রকাশ পায়। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলোতে বেশিরভাগ সময়ে তাঁর চেহারা নির্লিপ্ত- আবেগশূন্য। এতে তাঁর আসল মুড প্রকাশ পায় না। তাঁর ছবির আসল ক্লু থাকে ছবির পশ্চাৎপটে (ব্যাকগ্রাউন্ড), ছবির রঙে, ছবির থিম এবং স্টাইলে। তাঁর প্রত্যেক আত্মপ্রতিকৃতির এক একটা গল্প আছে বলার।
কোইয়াকানের সেই ব্লু হাউস এখন ফ্রিদা কাহ্লো জাদুঘর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক শিল্পী, শিল্পরসিকের স্বপ্ন কোইয়াকানের সেই বাড়িটিতে পর্যটনে যাওয়ার; যে বাড়িতে একদিন ফ্রিদা এই পৃথিবীকে প্রথম দেখেছিলেন; যে বাড়িতে কেটেছে তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।