আমি নতুন কিছু লিখবো
মৌলভীবাজারের ছাতকছড়া গ্রামে সালিশ বসেছে। অভিযুক্ত নূরজাহান ওরফে লক্ষ্মী ও তার পরিবার। নূরজাহানের দোষ সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। প্রথম বিয়ের তালাকনামা থাকলেও সেটাকে ভুয়া দাবি করে গ্রামের কয়েক দুর্বৃত্ত এ সালিশের আয়োজন করে। তাদের মতে, প্রথম বিয়েতে তালাক না হওয়ায় নূরজহানের দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ।
এ কারণে স্বামী, বাবা-মাসহ তাকে পাথর ছুড়ে ও বেত্রাঘাত করে শাসত্মি দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিল তাদেরও শাসত্মি দেয়া হবে। সালিশে নূরজাহানকে বিদ্রূপ করে বলা হয়, 'বিয়ে বসিতে এত শখ কেন তোর, বিষ খাইয়া মরিতে পারস না। ' অতঃপর.... ১০১টি পাথর নিৰেপের কষ্ট সহ্য করলেও অপমানের জ্বালা দীর্ঘ করার কোন সুযোগ দেয়নি নূরজাহান। ঘটনার পরপরই বিষ পানে আত্মহত্যা করে ২২ বছরের তরম্নণী নূরজাহান।
সংশিস্নষ্টরা জানান, ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারির চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনাকে ফতোয়াবাজির প্রথম প্রকাশ্য শিকার বলা হয়। নূরজাহানের মৃতু্যর তিন দিন পর ওই সংবাদ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে সময় নূরজাহানের মৃতু্যর সংবাদ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ৰোভে ফেটে পড়েন বিবেকবান মানুষ। গ্রামে গ্রামে ফতোয়াবাজির নির্মমতার ঘটনার কথা প্রথমবার এত প্রকাশ্যে উঠে আসে।
এরপর অনেক বছর পেরিয়েছে। দেশও এগিয়েছে। বিজ্ঞান, শিৰা, প্রযুক্তির বিসত্মার ঘটেছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক ৰেত্রে। শুধু পরিবর্তন ঘটেনি ফতোয়াবাজির।
সেই নূরজাহান থেকে আজকের হেনা_ ফতোয়ার বর্বর শিকারের উদাহরণ হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছে সমাজকে; দেশের প্রচলিত আইনকে। সর্বশেষ ফতোয়া দিয়ে রাজবাড়ীতে ২৮ বাউলের চুল-দাড়ি কেটে অঙ্গুলি তোলা হয়েছে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকেও।
ফতোয়াবাজির বিরম্নদ্ধে আদালতের রায়ও থমকে গেছে মৌলবাদী আগ্রাসনে। ২০১০ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্টের একটি রায়ে ফতোয়ার নামে বিচারবর্হিভূত কার্যক্রম ও শাসত্মি প্রদানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
ওই রায়ের বিরম্নদ্ধে এখনও আপীল শুনানি চলছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশে ৯টি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেসব ফতোয়াবাজির শিকার হয়েছেন ৩৬ জন। আর গত বছর ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে মৌখিক তালাক, শত্রম্নতা, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রসত্মাব, ধর্ষণ, অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক এ পাঁচটি ৰেত্রে গ্রামে ফতোয়াবাজির ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ মার্চ পর্যনত্ম মৌখিক তালাকের কারণে ১টি হিলস্না বিয়ে হয়েছে। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ও ধর্ষণের ২টি ঘটনায় দোররা মারা হয়েছে। দেবরকে বিয়ে ও শস্নীলতাহানির চেষ্টার ২টি ঘটনায় ফতোয়ার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ ৫টি ফতোয়ার ঘটনায় ১ জন আত্মহত্যা করেছে এবং ১ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক তথ্যে দেখা যায়, গত বছর মৌখিক তালাকের কারণে ২টি হিলস্না বিয়ে দেয়া হয়েছে।
শত্রম্নতাবশত ফতোয়া দেয়া হয়েছে ৪টি। ২০০৯ সালে ৩৬টি ফতোয়ার ঘটনায় মৌখিক তালাককে কেন্দ্র করে ২টি হিলস্না বিয়ে দেয়া হয়েছে। ৬টি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার দুজনকেই ফতোয়াবা শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে ১টিতে দোররা মারা হয়েছে দুজনকেই। যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রসত্মাব করার ২টি ঘটনায় ফতোয়া দেয়া হয়েছে।
অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে ২টি ফতোয়ার ঘটনায় নারী-পুুরম্নষ দুজনকেই শাসত্মি দেয়া হয়েছে। আর শত্রম্নতাবশত ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে দু'টি।
ফতোয়া কি আরবী 'ফতোয়া' শব্দের অর্থ 'জিজ্ঞাসা' বা 'আইন সম্পর্কিত মত। ' ধমর্ীয় আইন বিশেষজ্ঞ বা মুফতি প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধানকে ফতোয়া বলে। তবে সংশিস্নষ্টদের মতে, বর্তমানে ফতোয়ার রূপ একেবারেই ভিন্ন।
একশ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ নারীকে দমিয়ে রাখতে, নির্যাতন করতে, নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রসত্ম করতে, নারীর চলার পথকে সঙ্কীর্ণ করে তোলার জন্য নিজেদের মনগড়া কিছু আইন তৈরি করে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, ৯০ দশক থেকে আমরা দেখছি নারী নির্যাতনের নতুন পদ্ধতি এলো। নারীর মৌলিক মানবাধিকার ব্যক্তিগত ইসু্যতে ফতোয়া দেয়া শুরম্ন হলো। বাংলাদেশের প্রেৰাপটে ফতোয়া প্রদানের প্রধান স্থান হচ্ছে নারী-পুরম্নষের সম্পর্ক। সেৰেত্রে প্রথম আক্রমণ হচ্ছে সমাজের পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী নারী।
তিনি বলেন, গ্রাম্য মাতবর, মাদ্রাসার মুদাররিস, মোলস্না, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর, স্থানীয় প্রভাবশালী লোক, গ্রামের স্কুলশিৰক, গ্রাম্য ডাক্তার কখনও একযোগে, কখনও স্বতন্ত্রভাবে ফতোয়া দিয়ে আসছে। দোররা মারা, হিলস্না বিয়ে দেয়া, একঘরে করে রাখা, মুখে চুনকালি মেখে প্রদর্শন, পাথর নিৰেপ, জানাজা না দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ফতোয়া দেয়া চলছেই। ফতোয়াবাজির কারণে অনেক অসহায় ও দরিদ্র পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
ফতোয়াবাজি থেমে নেই নতুন নতুন ফতোয়াবাজির ঘটনায় ১৮ বছর আগে নূরজাহানের কাহিনী অনেকেই ভুলে গেছেন। সে সময় ফতোয়ার শিকার নূরজাহানের মৃতু্য ছিল সমাজের প্রতি প্রবল চপেটাঘাত।
আদালতও দাঁড়িয়েছিল নূরজাহানের পৰে। এরপরও ফতোয়াবাজি থেমে নেই। তাই নূরজাহানদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ফতোয়ার নতুন নতুন রূপ। ফতোয়ার শিকার হওয়ার সাড়ে চার বছর আগে মৌলভীবাজারের শেরপুর গ্রামের রব্বান মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় নূরজাহানের।
সেই সংসার দুই বছরের বেশি টেকেনি। হতদরিদ্র পিতা আশ্রবউলস্না একই গ্রামের মতলিবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। মেয়ের প্রথম বিয়ের তালাকনামা দেখিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে দেয়া বৈধ হবে কিনা তা ছাতকছড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নানের কাছে জানতে চান। ২শ' টাকা পারিশ্রমিক নেয়ার পর মাওলানা নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়েতে কোন বাধা নেই বলে জানান। সেই ফতোয়া পেয়েই মেয়ের আবারও বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আশ্রবউলস্না।
১৯৯২ সালে মতলিবের সঙ্গে নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই এটাকে ইসু্য করতে থাকে গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া। সঙ্গে যোগ দেয় মান্নান মাওলানা। গ্রাম্য সালিশে সিদ্ধানত্ম হয়, নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে শরিয়ত অনুযায়ী হয়নি। এটা অবৈধ বিয়ে। নূরজাহানের বাবা মেয়ের প্রথম বিয়ের তালাকনামা দেখানোর পর গ্রাম্য সালিশে তা জাল বলে উড়িয়ে দিয়ে শাসত্মি কার্যকরের ঘোষণা দেয়।
মাওলানা মান্নানের ফতোয়া অনুযায়ী হাঁটু সমান গর্তে নূরজাহান ও তার দ্বিতীয় স্বামীকে ১০১টি পাথর ছুড়ে মারা হয়। নূরজাহানের বাবা আশ্রবউলস্না ও মা সায়রা বিবিকে ৫০টি করে বেত্রাঘাত করা হয়। আর বিয়েতে উপস্থিত প্রত্যেককে দশবার করে কানে ধরে ওঠ-বস করতে হয়। ওই ঘটনায় নূরজাহানের মৃতু্যতে অভিযুক্ত ৯ জনের সাত বছর করে কারাদ- হয়। আদালত মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর ও ঐতিহাসিক রায় বলে মনত্মব্য করে।
গত ২৪ জানুয়ারি ফতোয়ার শিকার ১৪ বছর বয়সী হেনার মৃতু্য এখনও আদালতে বিচারাধীন। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষকের মেয়ে হেনা ধর্ষণের শিকার হয়েও গ্রাম্য সালিশে ফতোয়ার শিকার হয়। ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার উভয়কেই ১০১টি দোররা মারার রায় দেয়া হয়। কিশোরী হেনাকে ৭০টি দোররা মারার পর সে অচেতন হয়ে পড়ে। তাকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নঙ্ েভর্তি করা হয়।
৩১ জানুয়ারি মৃতু্য হয় হেনার।
হাইকোর্টের নির্দেশে হেনা হত্যা মামলা ফতোয়ার বিরম্নদ্ধে মামলার রূপ পেয়েছে। আদালতের আদেশে উলেস্নখ করা হয়, হেনা হত্যার বিরম্নদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তা হত্যাজনিত অপরাধ। কিন্তু ধর্ষণ আড়াল করার চেষ্টা এবং ফতোয়া দিয়ে দোররা মারার অভিযোগ এ মামলায় উলেস্নখ করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে ফতোয়া প্রদানকারীরা পার পেয়ে যাবে এবং ধর্ষকের বিচার হবে না।
হাইকোর্ট এ দুই বিষয়ে নতুন করে মামলা করার নির্দেশ দেয়।
চলতি বছরের ৬ এপ্রিল বগুড়ার নাহেরখাগা গ্রামের শুকুর আলীর পরিবার ফতোয়াবাজির আরেক নির্মম শিকারে পরিণত হয়। দিনমজুর শুকুর আলীর কিশোরী মেয়ের সঙ্গে স্থানীয় দোকানি আবুল কালামের শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে ধূর্ত প্রেমিক উপজেলা সদরের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত করায় এবং দায়িত্ব এড়াতে এলাকা থেকে সটকে পড়ে। এ ঘটনা গ্রামে এক কান দুই কান করে ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম্য সালিশ বসে।
একপেশে সেই সালিশে শুধু মেয়েটি ও তার পরিবারকেই শাসত্মি দেয়া হয়। মেয়ে 'নষ্টা' আর 'নষ্টা' মেয়েকে ঘরে রাখার জন্য পুরো পরিবারকে 'একঘরে' করে রাখা হয়েছে। ফতোয়ার রায় অনুসারে সমাজচু্যত পরিবারটিকে কেউ এক গস্নাস পানি পর্যনত্ম দেয় না। আর যে ছেলে মেয়েটির ৰতি করল সালিশে তার কোন বিচার হয়নি।
গত ৫ এপ্রিল রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় লালনভক্ত ২৮ বাউলকে 'তওবা' পড়িয়ে তাদের মাথার চুল ও দাড়ি-গোঁফ কেটে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
৪ এপ্রিল পাংশার হাবাসপুর ইউনিয়নের চররামনগর গ্রামে লালনভক্ত বাউল মোহাম্মদ ফকিরের বাড়িতে দু'দিনব্যাপী বার্ষিক সাধু সংঘ উৎসব শুরম্ন হয়। অনুষ্ঠানে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লালনভক্ত বাউলরা আসেন। ৫ এপ্রিল সমাপনী দিনে বাউলরা রীতি অনুযায়ী ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র অনুষ্ঠান শুরম্ন করে। সে সময় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি সেখানে গিয়ে বাউলদের সঙ্গে শরিয়ত ও মারফত নিয়ে কথা বলা শুরম্ন করে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তারা বাউলদের ধরে পাশের একটি মসজিদে নিয়ে যায় এবং জোর করে সবার চুল ও দাড়িগোঁফ কেটে দেয়।
দেশজ সংস্কৃতির ধারকবাহক বাউলদের এভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা হতবাক করেছে দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের। মৌলভীবাজারের ছাতকছড়া গ্রামে সালিশ বসেছে। অভিযুক্ত নূরজাহান ওরফে লক্ষ্মী ও তার পরিবার। নূরজাহানের দোষ সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। প্রথম বিয়ের তালাকনামা থাকলেও সেটাকে ভুয়া দাবি করে গ্রামের কয়েক দুর্বৃত্ত এ সালিশের আয়োজন করে।
তাদের মতে, প্রথম বিয়েতে তালাক না হওয়ায় নূরজহানের দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ। এ কারণে স্বামী, বাবা-মাসহ তাকে পাথর ছুড়ে ও বেত্রাঘাত করে শাসত্মি দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিল তাদেরও শাসত্মি দেয়া হবে। সালিশে নূরজাহানকে বিদ্রূপ করে বলা হয়, 'বিয়ে বসিতে এত শখ কেন তোর, বিষ খাইয়া মরিতে পারস না। ' অতঃপর.... ১০১টি পাথর নিৰেপের কষ্ট সহ্য করলেও অপমানের জ্বালা দীর্ঘ করার কোন সুযোগ দেয়নি নূরজাহান।
ঘটনার পরপরই বিষ পানে আত্মহত্যা করে ২২ বছরের তরম্নণী নূরজাহান।
সংশিস্নষ্টরা জানান, ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারির চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনাকে ফতোয়াবাজির প্রথম প্রকাশ্য শিকার বলা হয়। নূরজাহানের মৃতু্যর তিন দিন পর ওই সংবাদ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে সময় নূরজাহানের মৃতু্যর সংবাদ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ৰোভে ফেটে পড়েন বিবেকবান মানুষ।
গ্রামে গ্রামে ফতোয়াবাজির নির্মমতার ঘটনার কথা প্রথমবার এত প্রকাশ্যে উঠে আসে। এরপর অনেক বছর পেরিয়েছে। দেশও এগিয়েছে। বিজ্ঞান, শিৰা, প্রযুক্তির বিসত্মার ঘটেছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক ৰেত্রে।
শুধু পরিবর্তন ঘটেনি ফতোয়াবাজির। সেই নূরজাহান থেকে আজকের হেনা_ ফতোয়ার বর্বর শিকারের উদাহরণ হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছে সমাজকে; দেশের প্রচলিত আইনকে। সর্বশেষ ফতোয়া দিয়ে রাজবাড়ীতে ২৮ বাউলের চুল-দাড়ি কেটে অঙ্গুলি তোলা হয়েছে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকেও।
ফতোয়াবাজির বিরম্নদ্ধে আদালতের রায়ও থমকে গেছে মৌলবাদী আগ্রাসনে। ২০১০ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্টের একটি রায়ে ফতোয়ার নামে বিচারবর্হিভূত কার্যক্রম ও শাসত্মি প্রদানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এর আগে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরম্নদ্ধে এখনও আপীল শুনানি চলছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশে ৯টি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেসব ফতোয়াবাজির শিকার হয়েছেন ৩৬ জন। আর গত বছর ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে মৌখিক তালাক, শত্রম্নতা, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রসত্মাব, ধর্ষণ, অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক এ পাঁচটি ৰেত্রে গ্রামে ফতোয়াবাজির ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ মার্চ পর্যনত্ম মৌখিক তালাকের কারণে ১টি হিলস্না বিয়ে হয়েছে। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ও ধর্ষণের ২টি ঘটনায় দোররা মারা হয়েছে। দেবরকে বিয়ে ও শস্নীলতাহানির চেষ্টার ২টি ঘটনায় ফতোয়ার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ ৫টি ফতোয়ার ঘটনায় ১ জন আত্মহত্যা করেছে এবং ১ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক তথ্যে দেখা যায়, গত বছর মৌখিক তালাকের কারণে ২টি হিলস্না বিয়ে দেয়া হয়েছে। শত্রম্নতাবশত ফতোয়া দেয়া হয়েছে ৪টি। ২০০৯ সালে ৩৬টি ফতোয়ার ঘটনায় মৌখিক তালাককে কেন্দ্র করে ২টি হিলস্না বিয়ে দেয়া হয়েছে। ৬টি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার দুজনকেই ফতোয়াবা শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে ১টিতে দোররা মারা হয়েছে দুজনকেই।
যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রসত্মাব করার ২টি ঘটনায় ফতোয়া দেয়া হয়েছে। অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে ২টি ফতোয়ার ঘটনায় নারী-পুুরম্নষ দুজনকেই শাসত্মি দেয়া হয়েছে। আর শত্রম্নতাবশত ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে দু'টি।
ফতোয়া কি আরবী 'ফতোয়া' শব্দের অর্থ 'জিজ্ঞাসা' বা 'আইন সম্পর্কিত মত। ' ধমর্ীয় আইন বিশেষজ্ঞ বা মুফতি প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধানকে ফতোয়া বলে।
তবে সংশিস্নষ্টদের মতে, বর্তমানে ফতোয়ার রূপ একেবারেই ভিন্ন। একশ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ নারীকে দমিয়ে রাখতে, নির্যাতন করতে, নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রসত্ম করতে, নারীর চলার পথকে সঙ্কীর্ণ করে তোলার জন্য নিজেদের মনগড়া কিছু আইন তৈরি করে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, ৯০ দশক থেকে আমরা দেখছি নারী নির্যাতনের নতুন পদ্ধতি এলো। নারীর মৌলিক মানবাধিকার ব্যক্তিগত ইসু্যতে ফতোয়া দেয়া শুরম্ন হলো। বাংলাদেশের প্রেৰাপটে ফতোয়া প্রদানের প্রধান স্থান হচ্ছে নারী-পুরম্নষের সম্পর্ক।
সেৰেত্রে প্রথম আক্রমণ হচ্ছে সমাজের পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী নারী। তিনি বলেন, গ্রাম্য মাতবর, মাদ্রাসার মুদাররিস, মোলস্না, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর, স্থানীয় প্রভাবশালী লোক, গ্রামের স্কুলশিৰক, গ্রাম্য ডাক্তার কখনও একযোগে, কখনও স্বতন্ত্রভাবে ফতোয়া দিয়ে আসছে। দোররা মারা, হিলস্না বিয়ে দেয়া, একঘরে করে রাখা, মুখে চুনকালি মেখে প্রদর্শন, পাথর নিৰেপ, জানাজা না দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ফতোয়া দেয়া চলছেই। ফতোয়াবাজির কারণে অনেক অসহায় ও দরিদ্র পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
ফতোয়াবাজি থেমে নেই নতুন নতুন ফতোয়াবাজির ঘটনায় ১৮ বছর আগে নূরজাহানের কাহিনী অনেকেই ভুলে গেছেন।
সে সময় ফতোয়ার শিকার নূরজাহানের মৃতু্য ছিল সমাজের প্রতি প্রবল চপেটাঘাত। আদালতও দাঁড়িয়েছিল নূরজাহানের পৰে। এরপরও ফতোয়াবাজি থেমে নেই। তাই নূরজাহানদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ফতোয়ার নতুন নতুন রূপ।
ফতোয়ার শিকার হওয়ার সাড়ে চার বছর আগে মৌলভীবাজারের শেরপুর গ্রামের রব্বান মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় নূরজাহানের। সেই সংসার দুই বছরের বেশি টেকেনি। হতদরিদ্র পিতা আশ্রবউলস্না একই গ্রামের মতলিবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। মেয়ের প্রথম বিয়ের তালাকনামা দেখিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে দেয়া বৈধ হবে কিনা তা ছাতকছড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নানের কাছে জানতে চান। ২শ' টাকা পারিশ্রমিক নেয়ার পর মাওলানা নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়েতে কোন বাধা নেই বলে জানান।
সেই ফতোয়া পেয়েই মেয়ের আবারও বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আশ্রবউলস্না। ১৯৯২ সালে মতলিবের সঙ্গে নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই এটাকে ইসু্য করতে থাকে গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া। সঙ্গে যোগ দেয় মান্নান মাওলানা। গ্রাম্য সালিশে সিদ্ধানত্ম হয়, নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে শরিয়ত অনুযায়ী হয়নি। এটা অবৈধ বিয়ে।
নূরজাহানের বাবা মেয়ের প্রথম বিয়ের তালাকনামা দেখানোর পর গ্রাম্য সালিশে তা জাল বলে উড়িয়ে দিয়ে শাসত্মি কার্যকরের ঘোষণা দেয়। মাওলানা মান্নানের ফতোয়া অনুযায়ী হাঁটু সমান গর্তে নূরজাহান ও তার দ্বিতীয় স্বামীকে ১০১টি পাথর ছুড়ে মারা হয়। নূরজাহানের বাবা আশ্রবউলস্না ও মা সায়রা বিবিকে ৫০টি করে বেত্রাঘাত করা হয়। আর বিয়েতে উপস্থিত প্রত্যেককে দশবার করে কানে ধরে ওঠ-বস করতে হয়। ওই ঘটনায় নূরজাহানের মৃতু্যতে অভিযুক্ত ৯ জনের সাত বছর করে কারাদ- হয়।
আদালত মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর ও ঐতিহাসিক রায় বলে মনত্মব্য করে।
গত ২৪ জানুয়ারি ফতোয়ার শিকার ১৪ বছর বয়সী হেনার মৃতু্য এখনও আদালতে বিচারাধীন। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষকের মেয়ে হেনা ধর্ষণের শিকার হয়েও গ্রাম্য সালিশে ফতোয়ার শিকার হয়। ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার উভয়কেই ১০১টি দোররা মারার রায় দেয়া হয়। কিশোরী হেনাকে ৭০টি দোররা মারার পর সে অচেতন হয়ে পড়ে।
তাকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নঙ্ েভর্তি করা হয়। ৩১ জানুয়ারি মৃতু্য হয় হেনার।
হাইকোর্টের নির্দেশে হেনা হত্যা মামলা ফতোয়ার বিরম্নদ্ধে মামলার রূপ পেয়েছে। আদালতের আদেশে উলেস্নখ করা হয়, হেনা হত্যার বিরম্নদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তা হত্যাজনিত অপরাধ। কিন্তু ধর্ষণ আড়াল করার চেষ্টা এবং ফতোয়া দিয়ে দোররা মারার অভিযোগ এ মামলায় উলেস্নখ করা হয়নি।
ফলে ভবিষ্যতে ফতোয়া প্রদানকারীরা পার পেয়ে যাবে এবং ধর্ষকের বিচার হবে না। হাইকোর্ট এ দুই বিষয়ে নতুন করে মামলা করার নির্দেশ দেয়।
চলতি বছরের ৬ এপ্রিল বগুড়ার নাহেরখাগা গ্রামের শুকুর আলীর পরিবার ফতোয়াবাজির আরেক নির্মম শিকারে পরিণত হয়। দিনমজুর শুকুর আলীর কিশোরী মেয়ের সঙ্গে স্থানীয় দোকানি আবুল কালামের শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে ধূর্ত প্রেমিক উপজেলা সদরের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত করায় এবং দায়িত্ব এড়াতে এলাকা থেকে সটকে পড়ে।
এ ঘটনা গ্রামে এক কান দুই কান করে ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম্য সালিশ বসে। একপেশে সেই সালিশে শুধু মেয়েটি ও তার পরিবারকেই শাসত্মি দেয়া হয়। মেয়ে 'নষ্টা' আর 'নষ্টা' মেয়েকে ঘরে রাখার জন্য পুরো পরিবারকে 'একঘরে' করে রাখা হয়েছে। ফতোয়ার রায় অনুসারে সমাজচু্যত পরিবারটিকে কেউ এক গস্নাস পানি পর্যনত্ম দেয় না। আর যে ছেলে মেয়েটির ৰতি করল সালিশে তার কোন বিচার হয়নি।
গত ৫ এপ্রিল রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় লালনভক্ত ২৮ বাউলকে 'তওবা' পড়িয়ে তাদের মাথার চুল ও দাড়ি-গোঁফ কেটে দেয়ার ঘটনা ঘটে। ৪ এপ্রিল পাংশার হাবাসপুর ইউনিয়নের চররামনগর গ্রামে লালনভক্ত বাউল মোহাম্মদ ফকিরের বাড়িতে দু'দিনব্যাপী বার্ষিক সাধু সংঘ উৎসব শুরম্ন হয়। অনুষ্ঠানে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লালনভক্ত বাউলরা আসেন। ৫ এপ্রিল সমাপনী দিনে বাউলরা রীতি অনুযায়ী ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র অনুষ্ঠান শুরম্ন করে। সে সময় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি সেখানে গিয়ে বাউলদের সঙ্গে শরিয়ত ও মারফত নিয়ে কথা বলা শুরম্ন করে।
এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তারা বাউলদের ধরে পাশের একটি মসজিদে নিয়ে যায় এবং জোর করে সবার চুল ও দাড়িগোঁফ কেটে দেয়। দেশজ সংস্কৃতির ধারকবাহক বাউলদের এভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা হতবাক করেছে দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।