বাক্সবন্দী সময় জট... যাচ্ছে জীবন উদ্ভট...
_____________________________
অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি গত বছরের একটি ছবির নাম “উড়ান”। এক বন্ধুর বদৌলতে দেখার সুযোগ পেলাম। ছবিটি দেখে এত ভালো লাগলো যে আপনাদের সাথে আমার ভাবনাটা শেয়ার করার ইচ্ছা জাগলো। নিচে আমার চিন্তা ভাবনাগুলো গুছিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কোন মুভি বোদ্ধার রিভিউ ভাববেন না যেন।
আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত মতামতকে রিভিউ আকারে লিখার প্রচেষ্টা বলতে পারেন।
_____________________________
পরিচালনাঃ বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে
কাহিনীঃ বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে, আদিত্য কাশ্যপ
অভিনয়ঃ রনিত রয়, রাম কাপুর, রজত বার্মেচা, আয়ান বোরাডিয়া
ছবি মুক্তিঃ ১৬ জুলাই,২০১০ (ভারত)
IMDb রেটিং : 8.4/10
কাহিনী সংক্ষেপঃ
ছবির শুরু হয় সিমলার এক স্কুল হোস্টেল থেকে চার বন্ধুর রাতের বেলা পালিয়ে অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখতে যাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওয়ার্ডেনের কাছে ধরা পড়ে যায় চারজনই এবং ফলাফল স্কুল থেকে বহিঃষ্কার। অতঃপর হোস্টেল ছাড়তে হয় চার বন্ধু মুনিন্দর, বিক্রম, বিনয় এবং রোহানকে। সবাই রওনা দেয় নিজ নিজ গন্তব্যে এবং এখান থেকেই শুরু হয় রোহানের (রজত বার্মেচা) গল্প।
রোহান,১৭ বছর বয়সী এক ছেলে যে বাড়ি ফিরছে ৮ বছর পর। মা মারা যাওয়ার পর বাবা(রনিত রয়) ওকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয় এবং গত ৮ বছরে বাবার সাথে ওর দেখাও হয়নি। বাড়ি ফিরে রোহান আবিষ্কার করে ৬ বছর বয়সী ওর সৎ ভাই অর্জুনকে(আয়ান বোরাডিয়া) । জানতে পারে মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। অর্জুনের মাও অর্জুনের ছোটবেলাতেই মারা যায়।
জমশেদপুরে ফিরে এসে শুরু হয় রোহানের নতুন জীবন।
রোহানের ইচ্ছা লেখক হওয়ার তাই আর্টস-এ পড়তে চায় কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছেলে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ুক। এই নিয়ে ওর চাচার (রাম কাপুর) সাথে কথা বলার সময় ঝগড়া হয় বাবা ছেলের। রোহানের বাবা,যাকে রোহানের দাদা বড় করেছেন কড়া শাসন এবং নিয়ম শৃংখলার মাঝে এখন চান তার ছেলেকেও সেভাবে মানুষ করতে। জোর করে রোহানকে ভর্তি করিয়ে দেন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে এবং নিজের ফ্যাক্টরিতে পার্ট টাইম কাজে লাগিয়ে দেন।
কঠিন সব নিয়মের মাঝে বন্দী হতে হয় রোহান এবং অর্জুনকে। যেমন, প্রতিদিন ভোরে উঠে জগিং এ যেতে হয় এবং জগিং শেষে ফেরার সময় বাবা ছেলের রেস হয়। রোহানকে বরাবরই হারিয়ে দেয় বাবা। এতসব নিয়মের মাঝেও রোহান কবিতা লিখে,গল্প লিখে; স্বপ্ন দেখে একদিন বড় লেখক হওয়ার। বাবাকে লুকিয়ে সিগারেট খায়, একরাতে বাবার গাড়ী চুরি করে নিয়ে বারে যায়।
সেখানে বন্ধুত্ব হয় কলেজের সিনিয়ার কয়েকজনের সাথে।
এদিকে বাবার অত্যাচার বাড়তে থাকে দিন দিন। কারণে অকারণে দুই ভাইয়ের উপর হাত তুলে। ধীরে ধীরে সৎ ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো হতে থাকে রোহানের। জমতে থাকে বাবার উপর বিতৃষ্ণা এবং ক্রোধ।
যখন বাবা তৃতীয়বারের মত বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ নিয়ে নিজের ভাই আর ছেলের সাথে ঝগড়া করে তখন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাবা তখন ধরতে যায় ওকে কিন্তু প্রথমবারের মত বাবাকে দৌড়ে হারিয়ে দেয় রোহান। সিদ্ধান্ত নেয় যে নিজের জীবন নিজের মত করে কাটাবে, নিজের স্বপ্নকে আর বন্দী থাকতে দিবেনা এবং ছোট ভাইকেও এমন জীবন পেতে দিবেনা। নীল আকাশে মুক্ত হয়ে উড়তে দিবে ওর স্বপ্নের ঘুড়িকে।
বিশ্লেষনঃ
আপাতঃ দৃষ্টিতে উড়ানের গল্প আমাদের সমাজের ঘটে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনার প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এটাও সত্যি কথা যে সহজ সরল ঘটনাকে সাবলীল ভাবে তুলে ধরতে পারা সহজ কাজ নয়। পরিচালক ছবির কাহিনীর সাথে অত্যন্ত সুবিচার করেছেন এবং ফলশ্রুতিতে আমাদের সামনে উড়ানের গল্প খুব সাধারণ হয়েও অসাধারণ রূপ লাভ করেছে।
যারা ২০০৯ সালের বিখ্যাত মুভি 3 IDIOTS দেখেছেন তাদের নিশ্চই প্রফেসর ভাইরাস (বোমান ইরানী) এর কথা মনে আছে। সেই মুভিতেও দেখা যায় যে বোমান ইরানীর একটি ছেলে ছিল যে ইঞ্জিনীয়ারিং না পরে সাহিত্যে পড়তে চাইত এবং লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখত কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তে বাধ্য হয় ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে এবং একসময় লেখাপড়ার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উড়ান মুভিতে দর্শকরা 3 IDIOTS এর পিতা পুত্রের সেই না বলা গল্পের অংশটার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন।
উড়ানের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বাস্তবতাকে তুলে ধরা সুনিপুণভাবে। একদিকে দাম্ভিক,অত্যাচারী বাবা এবং অন্যদিকে কিশোর ছেলের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন প্রতিটি দর্শকের মনে নাড়া দিবে।
ছবির বেশ কিছু দৃশ্য মনে রাখার মত যার মাঝে আমি আমার পছন্দের কয়েকটা উল্লেখ করছি।
-রোহান যখন স্কুল ছাড়ার আগে প্রিয় বন্ধুকে কবিতা পরে শোনায়।
-রোহান এবং সৎ ভাই অর্জুনের প্রথম দেখা হওয়া।
-চাচার বাসায় রোহানের ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে বাবা ছেলের ঝগড়া।
-চাচার অনুরোধে বাবাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনানো।
-অর্জুন যখন হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং রোহানের সাথে বন্ধুত্ব হয়।
-তৃতীয় বিয়ে নিয়ে বাবা এবং চাচার মাঝে দন্দ্ব।
-যখন রোহান আর ক্রোধ চেপে রাখতে পারেনা এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ছবিতে রোহানের বেশ কিছু কবিতা আবৃত্তি আছে এবং কবিতাগুলো ভালোলাগার মত।
ছবির সঙ্গীত পরিবেশনা বেশ ভালো এবং গানগুলো ছবির দৃশ্যগুলোকে আরও সুন্দর করে বিবৃত করেছে।
ছবির সংলাপ গুলো নাটকীয়তা বর্জিত এবং দৈনন্দিন জীবন থেকে তুলে নেয়া। আমি শেষ দৃশ্যের একটি প্রিয় সংলাপের একাংশ তুলে ধরছি (বাংলায়ঃ)-
“ এটি একটি এমন শব্দ যা আপনি কখনও বুঝার কিংবা অনুভব করার চেষ্টা করেননি এবং কখনও করবেনও না...... ভালোবাসা ”
পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে পিতা-পুত্র, বড় ভাই-ছোট ভাই, বন্ধত্বের সম্পর্কগুলোকে যেভাবে ব্যক্ত করেছেন তা প্রশংসনীয়।
কাহিনী শুনে হয়ত মনে হতে পারে যে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বর্ণনা করার মত কাহিনী এটা নয় তবে মুভিটি দেখার সময় কোন দৃশ্যই অতিরিক্ত সংযোজন মনে হবে না।
পর্যাপ্ত সময় নিয়ে প্রতিটি দৃশ্যকে বাস্তব রূপ দেয়ার মাঝ দিয়ে পরিচালক তার নৈপুন্য দেখিয়েছেন।
ছবির চরিত্রায়ন অসম্ভব ভালো হয়েছে। রনিত রয় এবং রাম কাপুর ভারতের জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং তারা কতটুকু গুণী অভিনেতা তা এই ছবিতে আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে। রোহান চরিত্রে রজত বার্মেচার অভিনয় প্রতিভা পরিস্ফুট হয়েছে এবং দক্ষ পরিচালক তার পুরোটুকু ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটভাই অর্জুনের চরিত্রে আয়ান বোরাডিয়ার অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটে যাবে বিশেষ করে তার কান্না চেপে রাখার দৃশ্য দেখে অনেকেই তার অব্যক্ত কান্নার অনুভূতি অনুভব করবেন।
ছবির শেষ অংশের দৃশ্যে অর্জুন কেন ভাইয়ের সাথে যাওয়ার সময় নিজের ব্যাগ নিয়ে যায় না তা দেখে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল।
স্বল্প বাজেটে নির্মিত ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি ফিল্মফেয়ার,স্টারস্ক্রিন সহ প্রায় সব কটি বিভাগে পুরষ্কার অর্জন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবং সুপারস্টার কাস্টিং ছাড়াও স্বল্প বাজেটে কিভাবে ভালো ছবি তৈরি করা যায় তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে।
অতিরিক্ত সংযোজন (খুটিনাটি)-
পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের পরিচালিত এটি প্রথম চলচ্চিত্র।
ছবির শ্যুটিং হয়েছে ঝাড়খণ্ডের জমশেদপুর এবং সিমলায় যদিও পরিচালক প্রথমে দিল্লীর কথা ভেবে গল্প সাজিয়েছিলেন।
ছবির “মটু মাস্টার” গানটি আদিত্য কাশ্যপের লিখা।
ছবিতে ব্যবহারের জন্য যে গাড়িটি কেনা হয়েছিল তা যে চোরাই গাড়ি ছিল তা শ্যুটিং ইউনিটের কেউ জানত না এবং তা পরবর্তীতে এই তথ্য উদঘাটন হয়।
ছবিতে ফ্যাক্টরির কাজে অভিনয় করার জন্যে রজত বার্মেচা সত্যি সত্যিই তিনদিন একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছিলেন।
ছবিতে রোহানের বাবা ভৈরব সিং-এর যে বাড়িটি দেখানো হয়েছে তা আসলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বাড়ির অংশ।
ছবিতে ফটো অ্যালবামে রোহানের মার যে ছবি দেখানো হয় তা আসলে পরিচালকের স্ত্রী ইশিকার।
ছবির প্রাথমিক চিত্রনাট্য লিখা হয়েছিল ২০০৩ সালে।
____________________________________
পরিশেষে এই বলতে চাই যে যদি হিন্দি মুভি দেখার অভ্যাস থাকে তাহলে দেরি না করে মুভিটি দেখে ফেলুন। সস্তা রসিকতার বিনোদনধর্মী হিন্দি মুভি দেখার থেকে এই মুভিটি দেখার সময় আপনার সময় আরও ভাল কাটবে বলে আমার বিশ্বাস।
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
স্টেজ ভ্যুঃ এইখানে খোঁচা মারুন
টরেন্টঃ এইখানে খোঁচা মারুন
মিডিয়া ফায়ারঃ এইখানে খোঁচা মারুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।