আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুতেও তুমি জয়ী হুগো চাভেজ

যদি মানুষ না হই তবে যেন আবার জন্ম নিই মানুষ হয়ে. . . মৃত্যুতে যিনি যত ভালোবাসা পান, জীবনে তিনি ততটাই বড়। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মৃত্যুর শোক তাই মত-মতাদর্শ আর দেশজাতি ছাপিয়ে বিশ্বজনীনতা পেয়েছে। মনের ভেতরে উঠে দাঁড়িয়ে অনেকে আজ বলছে, ‘সালাম কমরেড, বিদায় বন্ধু। ’ আমার কোনো স্কুলশিক্ষক বন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে শিশুদের অবাক করে দিয়ে কেঁদে ফেলবেন। থমথমে মুখে বলবেন দূর কোনো মহাদেশের এক নেতার কথা।

তারা অবাক হয়ে শুনবে। অনেকেই ভুলে যাবে। কিন্তু তাদের কারও কারও মনে চাভেজ নামটি অক্ষয় দাগ ফেলবে। তারাও হতে চাইবে দেশের সেবক, জনতার নায়ক। চাভেজের মৃত্যু নয়, তাই জীবনটাই সত্য।

সেই জীবনের সত্যিকার আরম্ভ এই মৃত্যুর পর। ক্যালেন্ডারের ছোট সময়ে তিনি ক্যানসারের কাছে পরাজিত হলেন ৫ মার্চ। আর ইতিহাসের বড়কালে কবে তাঁর মৃত্যু হবে, জানা নেই। মৃত্যুর পর যাঁর শিক্ষা যত টেকে, তিনি ততটাই সার্থক। এ জন্যই চাভেজের মৃত্যুতে শোকও আছে, আশাবাদও আছে।

আর আছে ভালোবাসা। চাভেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, ‘মন ছোট করবেন না, সহিংসতায় জড়াবেন না। কোনো ঘৃণা নয়। আমাদের হূদয়ে আসুক একটি মাত্র আবেগ—ভালোবাসা। ভালোবাসা, শান্তি ও শৃঙ্খলা।

’ এই বক্তৃতায় তিনি সাবেক শাসক আর তাঁদের বিদেশি বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের অশান্তির পাঁয়তারার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করেন। চাভেজের উত্থান এক ‘ঘাড়ভাঙা ঘোড়ার উঠে দাঁড়ানোর’ গল্প। যেন এক রূপকথা। যেন এক সফল কর্নেল তাহের। জাঁদরেল অফিসাররা চ্যাংড়া সেনা অফিসার চাভেজের চরিত্রগুণে আঁতকে উঠে পাঠিয়ে দেন প্রত্যন্ত এলাকায়।

অসুবিধাকে সুবিধা বানিয়ে ফেলার ওস্তাদি এই তরুণের জানা ছিল। পাহাড়ি এলাকার নির্বাসনে আদিবাসীদের ঘনিষ্ঠ হলেন। ক্ষমতায় এসে তার প্রতিদানও দিলেন। সেই পাহাড়ি প্রাদেশিক প্রান্ত থেকেই সরাসরি আঘাত করেন কেন্দ্রে। ১৯৯২ সালে সেনা-অভ্যুত্থান ঘটান—যদিও ব্যর্থ হন।

পরাজয়টাকেও তিনি ছোট জয় বলে দেখালেন। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘সহযোদ্ধাগণ, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এবারের জন্য, আমরা রাজধানীতে লক্ষ্য হাসিল করতে পারলাম না। ’ বার্তাটা পরিষ্কার: এবারের জন্য রাজধানী হাতছাড়া হলো বটে, পরেরবার আর ছাড়ান নাই। দুই বছর জেলবাসের পর রাস্তা বদলে ফেললেন। দলকে জনগণের কাছে নিয়ে গেলেন।

জনগণের অসন্তোষকে চে গুয়েভারার মতো বিদ্রোহী পথে না নিয়ে নিলেন গণজাগরণের পথে। ফলাফল নির্বাচনে বিপুল বিজয়। সিমন দ্য বলিভার তাঁর নায়ক, তাঁর গুরু চিলির নিহত নেতা সালভাদর আলেন্দে, কাস্ত্রো তাঁর প্রেরণা। এই তিন পদার্থে গড়া তাঁর বলিভারীয় জাতীয় সমাজতন্ত্র। এ ব্যাপারেও তিনি সৃষ্টিশীল।

চাভেজের ভাষায়, ‘আলেন্দের মতোই আমরা শান্তিবাদী গণতন্ত্রী। তবে তাঁর মতো নিরস্ত্র নই। ’ এই প্রেসিডেন্ট বারবার প্রয়োজনমতো অস্ত্র ও পথ বদলেছেন। প্রথমে ধরলেন বন্দুক, পরের দফায় ধরলেন কলম আর মাইক্রোফোন। ক্ষমতায় এলেন ভোটের মাধ্যমে, কিন্তু উৎখাত হলেন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে।

মজার ব্যাপার হলো, ওয়াশিংটনে যখন চাভেজের ‘পতনে’ উল্লাস চলছে, তখনই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আবার তিনি ফিরে এলেন প্রেসিডেন্ট ভবনের বারান্দায়। উল্লসিত জনতার অভিবাদন গ্রহণ করে বললেন, ‘হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু’। ঘাড়ভাঙা ঘোড়া সত্যিই উঠে দাঁড়াল। ক্যুয়ের ঘটনা তাঁকে বদলে দিল। তাঁর শৃঙ্খলা হয়ে উঠল ইস্পাতকঠিন, ধৈর্য দুর্ভেদ্য আর রাজনীতি আরও পরিষ্কার।

লিখতেন, পড়তেন আর বেশিটাই বলতেন। সপ্তাহে অন্তত ৪০ ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকের চেয়ে বেশি সময় দিতেন বস্তিতে, গ্রামাঞ্চলে আর জনসভায়। এ এক সত্যিকার তৃণমূল গণতন্ত্র। বিপ্লবী পার্টির চেয়ে জনতাকে বিপ্লবী করে তোলাই ছিল তাঁর প্রধান কর্মসূচি।

খাদ্য, বাসস্থান আর কাজের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে ছড়াতেন বিপ্লবী আত্মবিশ্বাস। যেমন রেডিও-টিভিতে প্রতি সপ্তাহে সরাসরি জনগণের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। বিষয় ছিল, বস্তির স্বাস্থ্যসেবা বা গৃহায়ণ কীভাবে চলবে ইত্যাদি। যে কেউ ফোন করে প্রশ্ন বা মতামত দিতে পারে। এভাবেই তৈরি হতো তাঁর নীতি ও কর্মসূচি।

দলীয় ও প্রশাসনিক আমলাদের ডিঙিয়ে তিনি স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা দিলেন। ফলাফল হলো জাদুকরি: মাত্র তিন বছরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামল। বেকারত্ব ২০ থেকে ৭ শতাংশে কমল। শাসনামলের ১৩ বছরে ভেনেজুয়েলা থেকে নিরক্ষরতা বিদায় নিল। বাজেটের ৪৩ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয় সামাজিক কর্মসূচিতে।

১০ বছরে নির্মিত হয়েছে ২২টিরও বেশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকের সংখ্যা ৬৫ হাজার থেকে হয়েছে সাড়ে তিন লাখ। চলছে শতবর্ষ ধরে আটকে রাখা কৃষি সংস্কার কার্যক্রম। হাতে নিয়েছেন ২০ লাখ পরিবারের জন্য আবাসন কর্মসূচি। সমৃদ্ধ তেলসম্পদের জনমুখী ব্যবহার মানুষের জীবন ও চিন্তা দুটোকেই বদলে দিতে শুরু করল।

রাজনীতির কেন্দ্রীয় শক্তি হয়ে উঠল গরিব জনসাধারণ। সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের এই মডেল বিশ্বে অভূতপূর্ব। লেনিনের বিপ্লবী স্পর্ধার সঙ্গে আলেন্দের জনবন্ধুতা মিলে গেল। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আদর্শে পার্টিকেন্দ্র ও ক্ষমতাকেন্দ্রকে জনতার জবাবদিহির মুখে রাখা হলো। এটাই হলো তৃণমূল গণতন্ত্র।

এলিট আর সম্পত্তিবানদের কাগুজে গণতন্ত্র নয়। বিপ্লবী গণতন্ত্র নির্বাচনকে ভয় পায় না, বরং তাকে শ্রেণী-সংগ্রামের দারুণ হাতিয়ার বানাতে পারে। এরই নাম চাভেজমো বা চাভেজ পন্থা। ভেনেজুয়েলার পথ ধরে বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া ও চিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী বাম সরকার। হন্ডুরাস ও প্যারাগুয়েতে নির্বাচিত বাম সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সামরিক ষড়যন্ত্রে হটানো হলেও, তাদের ফিরে আসা সময়ের ব্যাপার হয়তো।

এদের বলা হয় চাভেজমো। অন্যদিকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, পেরু ও চিলির মধ্য বাম সরকারগুলোকে ব্রাজিলের সাবেক জনপ্রিয় বাম প্রেসিডেন্ট লুলার নামে লুলিজমো ডাকা হয়। এরা সবাই মিলে মার্কোসুর নামে আঞ্চলিক ঐক্য আর ইউনিসুর নামে অর্থনৈতিক জোট গঠন করে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসছে। গঠন করেছেন চতুর্দেশীয় জোট অ্যালবা। ক্যারিবীয় দেশগুলো এবং মেক্সিকোও এর সদস্য হতে যাচ্ছে।

ভিয়েতনাম হতে যাচ্ছে পর্যবেক্ষক সদস্য। সোজা কথায়, সত্তর-আশির দশকে যে লাতিন আমেরিকাই মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যে পিষ্ট হয়েছে, সেই লাতিন আমেরিকার অবসান হচ্ছে। শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে জাগছে সেখানকার ইতিহাস। একে ধরে রাখার সাংগঠনিক কাঠামো তৈরিই এখনকার কাজ। পশ্চিমা শাসকদের অভিযোগ, চাভেজ ব্যক্তিতন্ত্র তৈরি করেছেন, প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের সীমা উঠিয়ে দিয়েছেন এবং ক্ষমতা স্বহস্তে কুক্ষিগত করেছেন।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীও পর পর তিনবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পারেন শতবার। এ ক্ষেত্রে কি স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে না? মৃত্যুর সংবাদে নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছে, চাভেজ বিভক্ত দেশ রেখে যাচ্ছেন। মিথ্যা নয় কথাটা, চাভেজের আগে ৫ ভাগ ধনী বনাম ৯৫ ভাগ গরিবের বিভক্তি ছিল। ছক এখন উল্টে গেছে।

৫ ভাগের দাপটের জায়গায় বসেছে ৯৫ ভাগের ক্ষমতায়ন। চাভেজ এমনই এক ‘স্বৈরশাসক’, যিনি ১৫টি নিরপেক্ষ নির্বাচন জিতেছেন। তিনি এমনই এক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা, যা গণতন্ত্রকে জনমানুষের হাতিয়ার করেছে। তিনি এমনই এক পার্টির নেতা, যে পার্টির কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তৃণমূলের প্রতিনিধিদের হাতে। তিনি কোনো উত্তরাধিকার বসিয়ে যাননি।

নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী ৩০ দিনের মধ্যে। চাভেজ কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গেছেন। চাভেজ দোষ-গুণের মানুষই ছিলেন, দেবতা বা দানব নন। যে মানুষ জনগণের সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলেন, ইতিহাসের গতি বুঝে ইতিহাস নির্মাণ করেন, নিজের ভেতরে ধারণ করেন দেশের আত্মাকে, তাঁকে স্বাভাবিক পথে হাঁটলে চলে না। বিশ্বনন্দিত কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, চাভেজ এক জোরদার কংক্রিট, যিনি তাঁর দেশকে বাঁচাতে পারেন।

শত্রুর কাছে তিনি বুনো ষাঁড়। জনগণের সামনে তিনি নাচেন, গান গান, বেসবল খেলেন, গল্প বলেন বক্তৃতার মধ্যে। যিনি যিশুর উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে এখন নিয়ো না প্রভু, এখনো অনেক কাজ বাকি। ’ অনেক কাজ সত্যিই বাকি। চাভেজমো যেন চে গুয়েভারার মতো ভক্তিতে শেষ না হয়, তা যেন টিকে থাকে মুক্তির তাকদ নিয়ে।

বৃদ্ধ বয়সে তিনি হতে চেয়েছিলেন বাচ্চাদের শিক্ষক, গাইতে চেয়েছিলেন ‘কোপলা’ নামের পল্লিগীতি। লাতিন আমেরিকার নিষ্পেষিত মানুষের বুকচেরা ফরিয়াদ থেকে জন্মেছিলেন চাভেজ। ফিরে গেলেন তাঁর আপন মানুষের মনের মর্মে। আসুন, তাঁকে বিদায়ের সালাম জানাই। তাঁকে বলি, মানুষ যা পারে, ততটুকু তুমি করেছ, তোমাকে ধন্যবাদ কমরেড।

জীবনের কোনো লড়াইয়ে যিনি হারেননি, ৫৮ বছর বয়সে রহস্যময় ক্যানসারের কাছে তিনি হেরে গেলেন। দুঃখটা এখানেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।